শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন

অস্ত্র নির্মূল, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বরাষ্ট্র গঠনে এক অনবদ্য সংগ্রাম

আলমগীর খান

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৩, ১২:১৮ পিএম | আপডেট: ২২ মে ২০২৩, ০১:৪৬ পিএম

আলমগীর খান। ফাইল ছবি

আলমগীর খান। ফাইল ছবি

আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, তিনি নাকি বিজ্ঞানী না হলে একজন বেহালাবাদক হতেন। সঙ্গীতের জগতে এই মহান বিজ্ঞানীর বিচরণ ছিল পানিতে মাছের সাঁতার কাটার মতো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার সাক্ষাতের সময়ে দুজনের কথোপকথনের একটি অংশ ছিল সঙ্গীতকে ঘিরে। একজন মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত, সূক্ষ্ন অনুভূতিপ্রবণ এবং লোভলালসাহীন। 

ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তাকে, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অসম্মতি জানিয়েছেন। এর বাইরে আরও একটি পূর্ণাঙ্গ পরিচয় আছে আলবার্ট আইনস্টাইনের-তিনি ছিলেন শান্তির অগ্রদূত। স্বপন কুমার গায়েনের লেখা ‘শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন’ বইটি শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এ মানুষটির সেই পরিচয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন। বইটি এ বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করেছে অনুপম প্রকাশনী। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ধ্রুব এষের। 

মোট ১২টি অধ্যায়ে স্বপন কুমার গায়েন শান্তির সৈনিক হিসেবে শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব আইনস্টাইনের ঐতিহাসিক ভূমিকাটি তুলে ধরেছেন। যে আন্তর্জাতিক ঝঞ্ঝাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে আইনস্টাইন এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বা হতে বাধ্য হন তা লেখক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ধারাবাহিকভাবে। এসেছে প্রথম মহাযুদ্ধের ঘনঘটা, সমঝোতার চেষ্টা, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, যুদ্ধ প্রতিরোধ, নাৎসিবাদের উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পারমাণবিক বোমা, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা, কমিউনিজমের উত্থানের প্রেক্ষাপটে স্নায়ুযুদ্ধ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ। আর এসব ঘিরে তৎকালীন বিশ্বের অন্যান্য বিজ্ঞানী, দার্শনিক, লেখক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রমুখের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বশান্তির পক্ষে আইনস্টাইনের আপসহীন লড়াই।

ভূমিকায় স্বপন কুমার গায়েন লিখেছেন, “জীবনের শেষ চার দশক ধরে তিনি বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি যুদ্ধ প্রতিরোধ, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবকল্যাণের কাজে নিরন্তর সক্রিয় ছিলেন। বিজ্ঞান গবেষণা এবং শান্তি অন্বেষায় আইনস্টাইনের অবদান সম্পর্কে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, আইনস্টাইন তার প্রজন্মের সবচেয়ে সেরা বিজ্ঞানীই শুধু ছিলেন না, একজন জ্ঞানী মানুষও ছিলেন, যা ভিন্ন কিছু। রাষ্ট্রনায়করা যদি তার কথা শুনতেন, তবে মানব ইতিহাসের গতিপথ যা হয়েছে তার চেয়ে কম বিপর্যয়কর হতো।” 

আইনস্টাইনের রাজনৈতিক মতাদর্শ, শান্তির সন্ধান, যুদ্ধবিরোধিতা, মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রাম, তার বিশ্ব সরকার গঠনের প্রচেষ্টা ইত্যাদির চমৎকার প্রতিফলন ঘটেছে এ বইয়ে। আইনস্টাইনকে তিনি সকল দোষগুণের ঊর্ধ্বে একজন দেবতা বানানোর চেষ্টা করেননি; তার সরলতা, ঐতিহাসিক ভ্রান্তি, দোদুল্যমানতা ও পথ পরিবর্তনের ছবিও তুলে ধরেছেন। শান্তির অহিংস প্রবক্তা থেকে একজন দৃঢ়চেতা সৈনিক হয়ে ওঠার পরিবর্তনটিও আইনস্টাইনের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য মোড় পরিবর্তন যার রয়েছে বৈশ্বিক অভিঘাত যেটি এ বইয়ে নাটকীয় বর্ণনাভঙ্গিতে উপস্থাপিত। 

শান্তির জন্য অহিংসনীতির প্রবক্তা হিসেবে আইনস্টাইনের মনোভাব ১৯২৮-এর ৪ জানুয়ারি দেওয়া বিবৃতি থেকে পরিষ্কার: “যুদ্ধের রীতিনীতি ও সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রচেষ্টা আমার কাছে একবারে নিরর্থক মনে হয়। যুদ্ধ খেলা নয়। নিয়ম মেনে খেলা চলে, কিন্তু যুদ্ধ করা যায় না। আমাদের সংগ্রাম করতে হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। শান্তির সময় জনসাধারণ যদি সামরিক চাকরি গ্রহণ পুরোপুরি অস্বীকার করার সংগঠন গড়েন, তবেই যুদ্ধ অনুষ্ঠানের কার্যকর বিরোধিতা করা সম্ভব হতে পারে।” 

যে কোনো ধরনের সমরতন্ত্রের প্রতি ছিল তার তীব্র বিরোধিতা। ১৯৩১ সালে লেখা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ আই সি ইট’ শীর্ষক লেখায় তিনি সমরতন্ত্রকে ‘যূথবদ্ধ জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট আগাছা’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, “ব্যান্ডের তালে তালে দল বেঁধে মার্চ করে যারা আনন্দ পায় তাদের প্রতি আমি ঘৃণা বোধ করি। সভ্যতার শরীরে এই লজ্জাজনক কলঙ্ক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুছে ফেলা উচিত। ... মানুষের সুস্থ কাণ্ডজ্ঞান যদি বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে স্কুল আর সংবাদপত্রের মাধ্যমে কলুষিত করা না হতো, তাহলে যুদ্ধের ভ‚ত অনেক আগেই ছেড়ে যেত।” 

সামরিক যে কোনো কিছুর প্রতি ছিল তার বিদ্বেষ। তিনি মনে করতেন যে, সমরতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখে পৃথিবী থেকে যুদ্ধ কখনো নির্মূল করা যাবে না। একদিকে মানুষ হত্যার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ, সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের নীতি আর অন্যদিকে যুদ্ধ বন্ধের আশা তার কাছে দ্বিমুখী নীতিতুল্য। এ ব্যাপারে তিনি বহু সময় খুব স্পষ্ট মত প্রকাশ করেছেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের একটি সংগঠন তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বিরোধিতা করে। এ নিয়ে কৌতুককর মন্তব্য করেন আইনস্টাইন: “আগে কখনো আমি রমণীদের দ্বারা এমন নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যাত হইনি। ... যে ঝানু পুঁজিবাদীদের গিলে খেতে চায়, তার জন্য ঘরের দরজা খোলা রাখা কেন? সে আবার এত খারাপ যে একমাত্র নিজের স্ত্রীর সঙ্গে অনিবার্য যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো ধরনের যুদ্ধ করতে নারাজ।” 

কিন্তু আইনস্টাইনের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে যায় জার্মানিতে হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর এবং ইউরোপে ফ্যাসিবাদ বিস্তারের কালে। ১৯৩৩ সালে লেখা এক চিঠিতে আইনস্টাইন বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি সামরিক চাকরি গ্রহণ করতে অসম্মত হব না।” সেই সময় প্রকাশিত এক কার্টুনে আইনস্টাইনকে দেখা যায় তলোয়ার হাতে। নিউ ইয়র্ক টাইমস শিরোনাম দেয় : “আইনস্টাইন শান্তিবাদী মতামত পরিবর্তন করেছেন, জার্মান ভীতির বিরুদ্ধে অস্ত্র সংগ্রহ করতে বেলজিয়ানদের পরামর্শ দিয়েছেন।” 

এরপর ঘটে আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৩৯ সালে আইনস্টাইন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লিখে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য পরামর্শ দেন। তিনি আশঙ্কা করছিলেন যে, জার্মানিতে হিটলার আগেভাগেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলবে এবং ইউরোপিয়ান সভ্যতার জন্য তারা আরও বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। রুজভেল্ট এ চিঠির জন্য আইনস্টাইনকে ধন্যবাদ দেন এবং ১৯৪১-এ পারমাণবিক গবেষণা খাতে বিরাট অনুদান নিশ্চিত করেন। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক বোমা তৈরির লক্ষ্যে আমেরিকায় শুরু হয় ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোপনীয় কর্মকাণ্ড: ম্যানহাটান প্রজেক্ট।

এরই ফল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে অপ্রয়োজনীয়ভাবে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মর্মান্তিক পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ। এই অর্থহীন হত্যাযজ্ঞ আইনস্টাইনকে খুবই ব্যথিত করে। তিনি মনে করেন, মানববসতিহীন কোনো স্থানে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে শক্ত প্রতিরোধের বার্তা দেওয়া যেত। 

যদিও পারমাণবিক বোমা তৈরির ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না, তবু ১৯৪৬ সালে টাইম ম্যাগাজিন প্রচ্ছদে আইনস্টাইন ও ‘ই সমান এমসি স্কয়ার’ সমীকরণসহ ব্যাঙের ছাতাকৃতির ছবি দিয়ে তাকে ‘বোমার জনক’ আখ্যা দেয়। মুহূর্তে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর পর তিনি স্বীকার করেন ও পরে বহুবার বলেন, “জীবনে আমি একটা বড় ভুল করেছি-প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লেখা চিঠিতে যখন আমি পারমাণবিক বোমা তৈরির সুপারিশ করি।” 

স্বপন কুমার গায়েন লিখেছেন, এই মর্মান্তিক ঘটনার ফলে “সফররত জাপানি পদার্থবিদ হিদেকি ইউকাওয়ার কাছে অশ্রুসজল চোখে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। আর জীবনের পরবর্তী দশ বছর পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার সংগ্রাম করে গেছেন।” 

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মানবসৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে আরেকটি পরিবর্তন আনে। তিনি পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূল আর বিশ্ব সরকার গঠনের অভিযানে আত্মনিয়োগ করেন। তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে মানবমুক্তির একমাত্র পথ জাতীয় সামরিক বাহিনীর বিলুপ্তি এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসমূহ মিলে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে গড়ে তোলা একটি গণতান্ত্রিক বিশ্বরাষ্ট্র। 

স্বপন কুমার গায়েনের লেখা ‘শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন’ বইটি মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় বিস্তৃতভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে। আইনস্টাইনের দর্শন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ ইত্যাদির চমৎকার প্রতিফলন ঘটেছে এ বইয়ে যা আমাদের প্রকাশনা জগৎকে করেছে আরও খানিকটা সমৃদ্ধ।

সম্পাদক

বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh