দুই মানবদরদী চিকিৎসকের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধ ও বর্তমান রাষ্ট্র

আলমগীর খান

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৩, ০২:১২ পিএম | আপডেট: ২২ মে ২০২৩, ০৪:১৭ পিএম

‘দুই অদম্য মুক্তিযোদ্ধার আখ্যান’ বইয়ের প্রচ্ছদ।

‘দুই অদম্য মুক্তিযোদ্ধার আখ্যান’ বইয়ের প্রচ্ছদ।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হারালো এমন এক মহান ব্যক্তিকে যিনি আমাদের ইতিহাসে একটি অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন, যাঁর কোনো বিকল্প নেই। আজীবন গণমানুষের মুক্তির জন্য নিবেদিত-প্রাণ, অকুতোভয়, সৎ, নির্লোভ, পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক, দূরদর্শী, বন্ধুবৎসল, উদারচিত্ত ও এক অতি বৃহৎ হৃদয়ের মানুষ ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। 

এই উপমহাদেশের গৌরব এই অনন্য ব্যক্তিত্বের জীবন তাঁর স্বদেশে সবসময় কণ্টকমুক্ত থাকেনি। জীবৎকালে তিনি এমন বহুজনের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন ইতিহাস যাদেরকে কখনো আনুকূল্যের চোখে দেখবে না। এই বিরাট মানুষটিরই একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন আরশাদ সিদ্দিকী। সেই সঙ্গে তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্যের আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা ডা. এম এ মবিনেরও একটি সাক্ষাৎকার নেন তিনি। 

এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারকে এক মলাটের অন্তর্ভুক্ত করে প্রকাশিত হয়েছে আরশাদ সিদ্দিকীর গ্রন্থ ‘দুই অদম্য মুক্তিযোদ্ধার আখ্যান’, সম্প্রতি প্রকাশ করেছে সৌম্য প্রকাশনী। বইয়ের এ দুটি সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে চিকিৎসাশাস্ত্রের এ দুজন শিক্ষার্থীর সর্বস্ব ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, তাঁদের সংগ্রামী বর্ণিল জীবন, সাফল্য-ব্যর্থতা ও এক উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন। 

এই দুজন অদম্য ব্যক্তিত্বের দুটো ছবি দিয়ে বইয়ের অনাড়ম্বর প্রচ্ছদটি করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। তবে আরশাদ সিদ্দিকীর একটি দুঃখ রয়ে গেল যে, বইটি তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাতে তুলে দিতে পারেননি। তা না পারলেও এ দুজন সংগ্রামী মানুষের নিজস্ব বয়ানে এ আখ্যান পাঠকদের জন্য অনেক প্রেরণার ও চিন্তার খোরাক দিবে।

বর্তমানে প্রবাসী অর্থোপেডিক সার্জন ডা. এম এ মবিন ১৯৭১এ লন্ডনে পড়ালেখা ও চাকরি করছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে টেনে নিয়ে আসে মুক্তির সংগ্রামে। ডা. মবিন ও ডা. জাফরুল্লাহ দুই বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা লন্ডনে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ালেখা সমাপ্ত না করেই ছুটে আসেন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। 

তাজউদ্দীনের কথাটা এখনও স্পষ্ট ডা. মবিনের কানে বাজে, তিনি তাকে বলেছিলেন, “দেখ যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলবে। কিন্তু বেনবেল্লা, বেনখেদ্দার মত আমরাও মারা যাব, তাদের মত আমরাও মারা যাব। দেশ স্বাধীনের পর আমরাও মারা যাব।” আশ্চর্যজনকভাবে নিজের জন্য আলজেরিয়ার বিপ্লবী নেতাদের ভাগ্য অনুমান করেছিলেন তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের সময়ই।  

সাদেক খানের লেখা চিঠি নিয়ে তাঁরা আগরতলায় আসলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য তারা স্থাপন করেন ৪৮০ শয্যা বিশিষ্ট বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। চিকিৎসা করে রক্ষা করেন অনেক মুক্তিযোদ্ধার জীবন। ডা. জাফরুল্লাহ এই হাসপাতালের জন্য নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলেন। তার এই সেবাপদ্ধতি বিশ্বখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়।  

আরশাদ সিদ্দিকী লিখেছেন, “স্বাধীনতার পর ডা. জাফরুল্লাহ গ্রামে গিয়ে শুরু করেন স্বাস্থ্যযুদ্ধ। ফিল্ড হাসপাতালটিকেই কুমিল্লাতে স্বাধীন দেশের প্রথম হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলেন। ... গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু রূপে গড়ে তোলার জন্য ‘চলো গ্রামে যাই’ স্লোগান নিয়ে তিনি নতুন এক স্বাস্থ্যযুদ্ধ শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাাতালটির নামকরণ করেন ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। ঢাকার অদূরে সাভারে হাসপাতালটির জন্য ৩১ একর জমিও বরাদ্দ করেন।” 

১৯৪৮ সালে ডা. জাফরুল্লাহর বাবা লালবাগ থানার ওসি হয়ে ঢাকায় আসলেন। বলতে গেলে পুরো ঢাকা তার বাবার জমিদারি, অথচ নিজের জন্য একটু জায়গাও করেননি। তাঁর মা বলতেন, তুমি যে পড়েছ তা গরিব মানুষের পয়সায়, অতএব তাদেরকে দেখা ও দেশের সেবা করা তোমার দায়িত্ব। সে কারণে লন্ডনে যে জাফরুল্লাহর জামা তৈরি করত রাণির দর্জি, যিনি সেখানে চালাতেন মাার্সিডিজ বেঞ্জের চেয়ে দামী গাড়ি, ছিল ব্যক্তিগত বিমান চালানোর লাইসেন্স, যিনি হতে পারতেন পাকিস্তানের সেরা হার্টসার্জন, সেই তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি হামলার খরব শুনে তার পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন, এফআরসিএস চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে আসেন আগরতলা আর তারপর থেকেই বছরের পর বছর এক প্যান্ট ও এক জামা পরে জীবন নিবেদন করেন দরিদ্র মানুষের সেবায়।

তাঁর লেখা ‘পলিটিক্স অফ ড্রাগস’ লন্ডন থেকে প্রকাশিত আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে অনুদিত ‘ঝগড়াপুর’ বইটি জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত। ইন্ডিয়ান হাইকমিশন রাত বারোটায় সাভারে গিয়ে তাঁকে ভিসা দিয়ে এসেছে কারণ প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান, ভারতীয় বিমানে করে তারা নিয়ে গেছে তাঁকে।

আরশাদ সিদ্দিকী লিখেছেন, “ডা জাফরুল্লাহ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করে বাকশালে যোগ দেননি, জিয়াউর রহমানের দেয়া মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন ৪ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে। ফিরিয়ে দেন এরশাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবও।” 

এরশাদ সাহেব একদিন তাঁকে ডেকে বলেন, কত লোক তার কাছ থেকে কত সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে, ‘কিন্তু আপনি কখনো কিছু চাইলেন না।’ ডা. জাফরুল্লাহর জবাব, ‘তা আমি কী চাইব? আমি কি না খেয়ে থাকি?” না না, তা নয়। এরশাদ সাহেব তার জন্য ১০ কাঠা জমি ঠিক করে রেখেছেন বারিধারাতে, শুধু একটা সাইন করলেই হবে। জাফরুল্লাহ জবাব দেন, “আরে আপনি কী মনে করেন, আমার বাড়ি-ঘর নেই?” 

ডা. জাফরুল্লাহর অন্যতম একটি অবদান ১৯৮২ সালে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন। এরশাদ সাহেবকে তিনি অংক কষে বোঝাতে সক্ষম হন ওষুধ নীতি কী পরিবর্তন আনতে পারে। ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, “এতটুকু একটা ট্যাবলেটের দাম কেন ৩২ টাকা হবে। এটা কী সোনা?” ... এটা বাটপারি, ধাপ্পাবাজি।” 

আরশাদ সিদ্দিকী লিখেছেন, “তাঁর প্রচেষ্টায় ওষুধের আমদানি সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২৫-এ। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে গড়ে উঠছে।” এ নীতির ফলে দেশে স্বার্থান্বেষী চিকিৎসকদের ক্ষুদ্রস্বার্থে আঘাত লাগে। তাই বিএমএ-র নেতারা বিনা বিচারে ডা. জাফরুল্লাহর ফাঁসি চেয়ে পোস্টার ছাপিয়ে আন্দোলন করেন। 

সাক্ষাৎকারে স্বপ্নবান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শেষ বক্তব্য হলো: “পরিবর্তন, আমাদের পরিবর্তন দরকার। যেন সবাই ভাল থাকি। জনকল্যাণকর বাংলাদেশ, যেটা পৃথিবীর আদর্শ হবে। আমরা পৃথিবীর সবার কাছে আদর্শ হবো। এখন তো পুঁজিপতিরা আমাদের পিঠ থাপড়ায়। আমাদেরকে ভুল কাজে প্রবাহিত করে। আমাদের তরুণরা সেটা আনবে।” 

তবে এ বইটি প্রকাশে যত্নের অভাব লক্ষণীয়, বিশেষ করে বানান ও পরিচ্ছন্ন বাক্য গঠনে। বইটির উপক্রমণিকা লিখেছেন আহমেদ কামাল। যার শুরুর বাক্য- আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এসেছে অনেকটা আকস্মিকভাবে। আর এ চমৎকার উপক্রমণিকার শেষ বাক্যগুলো দিয়ে এ আলোচনার ইতি টানছি: ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধের এ মহাআখ্যানের পাশাপাশি ছোট ছোট আখ্যানগুলো যতো বেশি আমাদের কাছে আসবে, ততোই এই যুদ্ধের কাহিনী সমৃদ্ধ হবে এবং জনগণের ভূমিকা আরও স্পষ্ট হবে। সে বিবেচনায় ডা. এম এ মবিন এবং ডা. জাফরুল্লাহর সাথে আরশাদ সিদ্দিকীর কথোপকথন ইতিহাসের ক্ষুদ্র আখ্যান হিসেবে অনেক অনালোকিত অধ্যায়ের দিকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হবে।    

লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh