এমএইচ রশিদ
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৩, ১০:২৭ এএম | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩, ১০:৪৪ এএম
প্রতীকী ছবি
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও রিজার্ভ, তারল্য সংকট, বাণিজ্য ঘাটতি, ব্যাংকিং খাতে অনিয়মসহ নানা কারণে চাপে রয়েছে সার্বিক অর্থনীতি। এর মধ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হচ্ছে। আগামী ১ জুন মহান জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামাল।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে সবার নজর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তপূরণের দিকে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের শর্ত মোতাবেক আগের মতো বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি থাকবে না বা কমানো হবে। করছাড় সুবিধা কোনো ক্ষেত্রে বাতিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমানো হবে। অনেক ধরনের প্রণোদনাও বাতিল বা কমানো হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে করের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়তে পারে। তাই আইএমফের শর্তগুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশের মানুষের চাহিদার নিরিখে প্রয়োজনে সংস্কারের উদ্যোগ থাকতে হবে জাতীয় বাজেটে। বিশেষ করে পণ্যের মূল্য বা মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ থাকতে হবে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা এবং এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) হবে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। আর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হতে পারে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগামী বাজেট হতে হবে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও ঝুঁকি কমানোর বাজেট। এ জায়গা থেকে সবচেয়ে আগে নজর দিতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার দিকে। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ, নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতির লাগাম ধরে রাখার দিকে।
আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম কিস্তি ছাড় হয়েছে। পরবর্তী কিস্তি দেওয়ার আগে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে আইএমএফ। সে অনুযায়ী মূলত পাঁচ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশকে নিতে হবে। যেমন সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতির কাঠামো আধুনিক করা, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, বাণিজ্য পরিবেশ ভালো করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার সামর্থ্য বাড়ানো। এই পাঁচ ধরনের বিষয়ের মধ্যে মূল বিষয় হচ্ছে, ভর্তুকি কমাতে হবে, যাতে সরকার বেশি অর্থ উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় করতে পারে। এ জন্য সরকারকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানি ও সারের দাম বাড়াতে হবে। এই পাঁচ পণ্যেই সরকারকে বেশি ভর্তুকি দিতে হয়। সরকার এ কাজ সহজেই করে ফেলছে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর শর্তও এবার রয়েছে। এ জন্য নানা খাতে যেসব করছাড় দেওয়া হয়, তা কমানোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের বাজেট এখন অনাথ আর আইএমএফ তার পালক পিতা। আইএমএফ যখন কোনো দেশে কর্মসূচি নিয়ে যায়, তখন সেই দেশের অর্থনীতির ওপর এক কর্তৃত্ব আরোপ করে বা আরোপের চেষ্টা করে। আইএমএফ যখন কোনো দেশে কর্মসূচি নিয়ে যায়, তখন অনেক সময় সে দেশে বৈষম্য বেড়ে যায়। তারা যেসব শর্ত দেয়, তার কারণেই এটি হয়।
ভর্তুকি প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় আরও বলেন, ভর্তুকি অনেক সময় ভালো হয়, আবার খারাপও হয়। বিদ্যুৎ খাতে যে বিপুল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে সার ও ডিজেলের মতো খাতেও ভর্তুকি বাড়ানো সম্ভব।
একদিকে যেমন ভর্তুকি বা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে অন্যদিকে বিভিন্ন খাতে করহার বাড়ানো, নতুন করে কর আরোপ করা এবং বিদ্যমান করছাড় সুবিধা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে নতুন বাজেটে। স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা ও বিকাশে বিভিন্ন করসুবিধা দেওয়া আছে, সেগুলো নতুন করে বাড়ানো হবে না এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপ করা হতে পারে। ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকলেও ন্যূনতম ২০০০ টাকা করে কর আদায়ের কথা ভাবা হচ্ছে নতুন বাজেটে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণিতে টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৮৬ লাখ। এর মধ্যে মাত্র ৩২ লাখ ব্যক্তি আয়কর রিটার্ন জমা দেন। যে ৩২ লাখ ব্যক্তি আয়কর রিটার্ন জমা দেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৮ লাখের করযোগ্য আয় নেই। এই ৮ লাখ ব্যক্তির ওপর ন্যূনতম কর ধার্য করা হলে সরকারের বাড়তি ১৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে। ন্যূনতম করের নিয়মটি যদি সব টিআইএনধারীর ওপর প্রয়োগ করা হয়, তবে এটি ৬২ লাখ ব্যক্তির (৮৬ লাখ থেকে ২৪ লাখ বাদ) ওপর আরোপ করা হবে, যার ফলে ১,২৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হবে।
বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ন্যূনতম কর আরোপ করা ঠিক হবে না। এতে নিম্ন-আয়ের মানুষ সমস্যায় পড়বে। যদি কোনো করযোগ্য আয় না থাকে, তাহলে কোনো করও থাকবে না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা ভাইরাস মহামারি পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রভাব পড়েছে। ফলে শুল্ক খাত থেকে আয় কমেছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির জন্য শুধু আন্তর্জাতিক সংকটগুলো দায়ী নয়। রাজস্ব আহরণ ক্রমশ কমছে। এর জন্য অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও এনআরবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বর্তমান যে ধারা তা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ৭৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। রাজস্ব আহরণে গত সাত মাসে ৩.১ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবছর এনবিআরকে বড় ধরনের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় এবং সেটা কখনোই তারা পূরণ করতে পারে না।
আরও কিছু আবহমান সংকট আর্থিক খাতে রয়ে গেছে। সুশাসনের অভাবে দুর্নীতিতে ধুঁকছে দেশের ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজার। দেশের অর্থনীতি যখন তারল্য সংকটে ভুগছে তখন সরকার নিজেই ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছে সরকার। এছাড়া বড় ধরনের ঋণ সংক্রান্ত অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে কয়েকটি ব্যাংকে। কিছু কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে থমকে রয়েছে পুঁজিবাজার। এসব সংকট উত্তরণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ থাকতে হবে জাতীয় বাজেটে।