স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৩, ১১:৪১ এএম
মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। ছবি: বিবিসি
সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মিয়ানমারে ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ দানা বাঁধতে থাকে। একদিকে দেশটির সামরিক বাহিনী জনগণের ওপর তাণ্ডব চালাচ্ছে; অপরদিকে প্রতিরোধ যোদ্ধারা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। এতে হতাহতের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তবে আন্তর্জাতিক মহলের নিম্নগামী সুর ও নতুন পরাশক্তি চীনের সমর্থনে মানবাধিকারের প্রতি কোনো তোয়াক্কা নেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর। ফলে দেশটিতে গন্তব্যহীন সহিংসতা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, ১১ এপ্রিল মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলীয় সাগাইং অঞ্চলের কান্ত বালু পৌর শহরে সামরিক সরকারের (জান্তা) বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ প্রায় ১০০ জন নিহত হয়েছে। জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) শ্রম মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ওই হামলায় শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ বহু নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছেন। এই ‘জঘন্য কর্মকাণ্ড’ যুদ্ধাপরাধের শামিল। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় ঐক্যের সরকারের নতুন দপ্তর উদ্বোধন উপলক্ষে জড়ো হওয়া লোকজনের ওপর জান্তা সরকারের যুদ্ধবিমান থেকে বোমাবর্ষণ ও গুলি চালানো হয়। স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশ করা ভিডিও ও ছবিতে বিমান হামলার পর ভুক্তভোগীদের মরদেহের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত ভবন, গাড়ি ও ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এর আগে গত অক্টোবরে কাচিন রাজ্যে একটি কনসার্টে বিমান হামলা চালানো হয়েছিল। এতে অন্তত ৫০ জন নিহত হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী ও সশস্ত্র জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যরা।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনারা গত ১০ মে বাগো অঞ্চলের হতানতাবিন টাউনশিপে পাঁচ শিশুসহ ১৮ গ্রামবাসীকে হত্যা ও পুড়িয়ে দিয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুজন পাঁচ বছর বয়সী, একজন সাত বছর বয়সী, নয় বছর বয়সী, ১৫ বছর বয়সীসহ সত্তরোর্ধ্ব পুরুষ ও নারীও রয়েছেন। ওই গ্রামের কাছাকাছি প্রতিরোধ গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের সশস্ত্র শাখা কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির আক্রমণে জান্তা সেনারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ার পর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরপর মিয়ানমারের সৈন্যরা নিয়াং পিন থার গ্রামে অভিযান চালায়। বাসিন্দাদের মতে, এ সময় যাকেই সামনে পেয়েছে, তারাই সেনাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক গ্রামবাসী ইরাবতীকে জানান, তার বোন, শ্যালিকা ও ভাতিজিকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আক্রমণের শিকার হননি। কারণ ঘটনার সময় তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা জানান, আটক কয়েকজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ইরাবতী অবশ্য স্বাধীনভাবে এসব তথ্য যাচাই করতে পারেনি। তবে হামলার পর ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে পোড়া দেহাবশেষসহ মৃতদেহ দেখা গেছে বলে জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যম ইরাবতী।
প্রতিরোধ বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এটি ফ্যাসিবাদী সামরিক বাহিনীর অন্যতম অমানবিক কাজ।’ মিয়ানমারের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের প্রতিষ্ঠিত নির্বাসিত জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত মিয়ানমার জুড়ে জান্তা সেনাদের ৬৪টি গণহত্যার ঘটনা রেকর্ড করেছে। আর এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৭৬৬ জন।
সামরিক বাহিনীর এ হামলার পেছনে রয়েছে যোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ। সম্প্রতি সাগাইং ও মান্দালয় অঞ্চলে বিমান হামলা জোরদার করেছে জান্তা বাহিনী। এসব হামলায় শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। তবে মাঝে মাঝেই পাল্টা গেরিলা হামলাও চালাচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। মে মাসের প্রথম দিকে সাগাইং ও মান্দালয় অঞ্চলে সরকারি বাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা বাড়িয়েছে মিয়ানমারের ছায়া সরকারের নেতৃত্বাধীন পিপল’স ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ)। এসব হামলায় অন্তত ৩০ জান্তা সেনা নিহত হয়েছে। এর মধ্যে একটা ঘটনায় প্রতিরোধ যোদ্ধার সাতজনের একটি দল সাগাইংয়ে একটি সামরিক ঘাঁটিতে অভিযান চালায়। ওই অভিযানে অন্তত ২০ সরকারি সেনা নিহত হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি অভিযান চালিয়েছে পিডিএফ।
এদিকে অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অন্ততপক্ষে ১০০ কোটি ডলারের অস্ত্র আমদানি করেছে। অধিকাংশ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রাশিয়া, চীন ও সিঙ্গাপুরের ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আমদানি হয়েছে। গত ১৭ মে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। তাতে সমরাস্ত্র ও কাঁচামাল হস্তান্তর এবং ২৫৪ সরবরাহকারীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র এবং সেনাবাহিনীর দেশীয় অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করার জন্য কাঁচামাল আমদানি করেছে। রাশিয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ কিছু কোম্পানির কাছ থেকে ৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং চীনের কাছ থেকে ২৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারের অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে ২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সরঞ্জাম আমদানি করা হয়েছে।’
আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের (এসিএলইডি) তথ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত অন্তত ৩৩ হাজার ৯৮৮ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৩৯ জন বেসামরিক নাগরিক। অ্যাসিস্টেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানিয়েছে, এ সময়ে অন্তত ১৭ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে সামরিক বাহিনী। অন্তত ৩০ লাখ মানুষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ও আশপাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
২০২০ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন হয়। জয় পায় অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার অভিযোগ তুলে অভ্যুত্থান করে সামরিক বাহিনী। আটক করা হয় রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও এনএলডির অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের। সামরিক বাহিনী এক বছরের জন্য দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং হন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। সার্বিক পরিস্থিতিও সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল। এ কারণে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে সময় লাগেনি মিয়ানমারবাসীর। দেশটির জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ আর আগের মতো সামরিক শাসনে ফিরে যেতে চায়নি। ফলে অভ্যুত্থানের পর দেশ জুড়ে বিক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে ক্ষমতার প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয় তাতমাদাও (মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম)। প্রতিদিনই প্রাণ ঝরছে মিয়ানমারের জনগণের। রাজপথ থেকে এ সংগ্রাম ছড়িয়েছে গহিন জঙ্গলে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এখন রূপ নিয়েছে সহিংস গেরিলা যুদ্ধে। বহুধা বিভক্ত দেশটি নিয়ে কার্যত সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমারের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। কারণ এখন সব পক্ষের সাধারণ শত্রু সামরিক বাহিনী।