ড. আতিউর রহমান
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৩, ১১:৫০ এএম | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩, ০১:১৫ পিএম
ড. আতিউর রহমান। ফাইল ছবি
এখন পর্যন্ত আসছে বছরের বাজেট বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে যে উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতি তারা সময়োপযোগী সংবেদনশীলতা দেখাতে আন্তরিকভাবেই আগ্রহী। পত্র-পত্রিকার খবর থেকে যতোটুকু জানা গেছে তাতে মনে হচ্ছে বাজেটের আকার হবে ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকার বেশি।
রাজস্ব আয় বাড়ানোর যে চাপ রয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা নির্ধারিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ঘাটতি হবে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো, যা জিডিপির ৫ শতাংশর কিছু বেশি। ঘাটতির এই অনুপাত তাই বিপদসীমা অতিক্রম করেনি বলা যায়। তবে অনেকেই আসছে বছরের জন্য ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী বলে সমালোচনা করছেন। আমার মতে প্রবৃদ্ধির হার এ মুহূর্তে বিতর্কের বিষয় হওয়াই উচিত নয়। বরং শুরুতেই যেমনটি বলেছি আপদকালীন বাজেটে বিপাকে পড়া মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিগুলো কী করে আরও কার্যকর করা যায় সেটিই বরং মূল ভাবনার বিষয় হোক। আমাদের চিন্তকরা প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে আলাপের চেয়ে বিপন্ন কম আয়ের মানুষের সুরক্ষা নিয়ে বেশি বেশি ভাবলেই ভালো হয়।
আসছে বছরে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে থাকবে বলে ধারণা করছে সরকারের অর্থ বিভাগ- এমন খবর পড়েছি পত্রিকায়। বাস্তবে এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি এর চেয়ে অনেক বেশি। নিশ্চয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও সফল হবে। তবে যতক্ষণ না সে সাফল্য আসছে সে সময়কালের জন্য জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া চাই। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কিংবা ভর্তুকি দেওয়ার মতো পথে না হাঁটার পরামর্শই আসছে। কারণ এ ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সুবিধা দেওয়ার কারণে যাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দরকার তাদের কাছে পৌঁছানোর ব্যয় বেড়ে যায়। তার চেয়ে যথাযথ টার্গেটিংয়ের মাধ্যমে আসলেই যাদের সহায়তা দরকার তাদের কাছে নগদ টাকা পৌঁছানোটাই বেশি কার্যকর। করোনাকালীন অভিজ্ঞতাও তাই বলে।
ভর্তুকি কমিয়ে আনা এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার ওপর জোর দিতেই হবে। মনে রাখতে হবে সর্বশেষ খানাভিত্তিক আয়-ব্যয়ের জরিপ মতে আমাদের দারিদ্র্য হার ১৮ শতাংশের কিছু বেশি এবং অতিদারিদ্র্য ৫ শতাংশের আশপাশে নেমে এসেছে। আর দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য হার যত কমে আসে তা আরও কমিয়ে আনাটি ততই বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ‘পোভার্টি পকেটস’গুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য উপযোগী বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া একটি চমৎকার সমাধান হতে পারে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বৃহত্তর জনগণকে, বিশেষ করে কম আয়ের পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া। এবারের বাজেট অধিবেশনের আগে প্রাক-বাজেট আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনাগুলোতেও কেন্দ্রে থাকছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। তবে এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই শুধু বাজেটারি উদ্যোগ দিয়ে নয়, বরং বাজেট ও মুদ্রানীতির পরিপূরক ও সুসমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমেই কেবল কার্যকরভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গেল বছরের শেষ দিকে এ প্রসঙ্গে আইএমএফের ফিসক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক ভিটোর গ্যাসপার যথার্থ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘উচ্চমূল্যস্ফীতি, ব্যাপক ঋণের বোঝা, বর্ধিষ্ণু সুদের হার এবং ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে মুদ্রানীতি ও জাতীয় বাজেটের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতকরণ সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবিদার। এজন্য অধিকাংশ দেশেই জাতীয় বাজেটকে সংকোচনমুখী রাখা বাঞ্ছনীয়।’
অনেকে অবশ্য বাংলাদেশের চলমান সঙ্কট মোকাবিলায় মুদ্রানীতির মাধ্যমে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না- এমন ধারণা দিচ্ছেন। তবে সত্যি হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি দরকারি ধাপ হলো মুদ্রানীতির মাধ্যমে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ নিশ্চিত করা। সুদের হার না বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর নজির নেই। তবে এর সঙ্গে কিছু বাজেটারি পদক্ষেপও দরকার হবে। কেননা সাপ্লাই সাইড সক্রিয় করেও মূল্যস্ফীতি খানিকটা নিশ্চয় কমানো সম্ভব। মূল্যস্ফীতির পেছনে সরবরাহ ঘাটতির বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ ও কম বা বিনামূল্যে কম আয়ের মানুষকে খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে সামাজিক সংরক্ষণে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সঙ্কট উত্তরণের জন্য মুদ্রানীতি ও বাজেটের মধ্যে সুসমন্বয় যে একান্ত জরুরি- এ কথা মানতেই হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হলে সরকারের অর্থ দরকার হবে। কাজেই প্রথমেই ভাবা চাই সরকারের রাজস্ব আয় নিয়ে। রাজস্ব প্রসঙ্গে যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে সে তুলনায় রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। জিডিপির তুলনায় আমাদের রাজস্ব ১০ শতাংশেরও কম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কখনোই এই অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি হতে পারেনি। কিন্তু সমতুল্য অন্য দেশগুলোতে এই অনুপাত আরও বেশি হওয়ায় আমি মনে করি বাংলাদেশে জিডিপির অন্তত ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ কর আহরণ খুবই সম্ভব। ইদানীং আইএমএফসহ অন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও সরকারের আয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাটি জোর দিয়ে বলতে শুরু করেছে। জিডিপির অন্তত আধা শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায়ের তাগিদ দিচ্ছে তারা।
তাই আসছে বছরের বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিকে আগের তুলনায় বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন নীতিনির্ধারকরা। সন্দেহ নেই, এটি একটি চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য। তবে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এ লক্ষ্য অর্জন খুবই সম্ভব। নিত্য নতুন করের উৎস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও উদ্ভাবনী হতে হবে। যেমন- সিগারেট ও অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের ওপর কর বাড়ালে এসবের ব্যবহার কমবে। তামাক পণ্যে যথাযথ করারোপ করলে শুধু জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে তা-ই নয়, এ থেকে বাড়তি রাজস্বও আসতে পারে। যেমন- চলতি অর্থবছরে বাজেটে বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের ঘোষিত খুচরা মূল্য বাজার মূল্যের চেয়ে কম হওয়ায় সরকার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসছে বছরে বাজার মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সিগারেটের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করলে এবং সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করলে এ থেকে বাড়তি ৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আসতে পারে।
আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় সঙ্কোচনের দিকেও নজর দেওয়া চাই। আসন্ন বাজেটে সরকারি ব্যয়ের লাগাম তো টেনে ধরতেই হবে। তবে তা হতে হবে বাস্তবতার নিরিখে এবং সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা মানুষদের সুরক্ষাকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিয়েই। সঙ্গত কারণেই আমাদের বাজেট প্রণেতারা আসছে বছরের জন্য কিছুটা সঙ্কোচনমুখী বাজেট তৈরি করতে চাইবেন। তবে এ সঙ্কোচনের প্রভাব সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতগুলোর ওপর যত কম পড়বে ততই মঙ্গল।
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ২০২০-২১, ২০২১-২২, এবং ২০২২-২৩- এই তিনটি বাজেট মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটির ক্ষেত্রেই বিদ্যমান বাস্তবতায় (মহামারি মোকাবিলা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিরসন) গতানুগতিক বাজেটের পরিবর্তে উদ্ভাবনী সময়োপযোগী বাজেট প্রণয়নের চাহিদা ছিল। সরকারের তরফ থেকে সে রকম বরাদ্দ ও তা বাস্তবায়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। তবে হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিনের বরাদ্দ-বাস্তবায়নের যে ধারা প্রচলিত রয়েছে তা থেকে চাইলেও বেরিয়ে আসা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। তবু আশা করা যায়, বিগত তিনটি অর্থবছরে সঙ্কটকালীন বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে তার ভিত্তিতে আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীলতা দেখাতে সক্ষম হবেন আমাদের বাজেট প্রণেতারা।