জুয়া প্রতিরোধে আসছে নতুন আইন

শাহরিয়ার হোসাইন

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৩, ১১:৪৮ এএম

বাংলাদেশ সরকার লোগো। ফাইল ছবি

বাংলাদেশ সরকার লোগো। ফাইল ছবি

বর্তমানে জুয়া আইনটি ১৮৬৭ সালের। দেড়শ বছরেরও বেশি পুরনো ‘দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৯৬৭’ জুয়া আইনটি যুগোপযোগী করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে। নতুন আইনে হাল আমলের অনলাইন জুয়া, পাতানো খেলা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। খসড়া আইনে জুয়ার শাস্তি সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আগে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৫০০ টাকা জরিমানা ও ৩ মাসের জেল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৮৬৭ সালের জুয়া আইন হালনাগাদ করতে জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব লিপিকা ভদ্রকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি গত ফেব্রুয়ারি মাসে ‘জুয়া আইন, ২০২৩’-এর খসড়া জমা দেয়।

এখন খসড়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত নেওয়া হয়েছে বলে জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। শিগগিরই আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় খসড়াটি চূড়ান্ত করে তা মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এস এম রেজাউল মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের জুয়া প্রতিরোধে যে আইন রয়েছে, তা অনেক পুরনো। এর মধ্যে জুয়া সংশ্লিষ্ট অনেক নতুন নতুন বিষয় এসেছে। সেই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন আইন করতে যাচ্ছি আমরা। ইতোমধ্যে একটা খসড়া করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতামত নিয়ে আমরা শিগগিরই একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করব। সেখানে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর আমরা এটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য পাঠাব।’

তিনি আরও বলেন, ‘খসড়া আইনে অনলাইন জুয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়েছে। এছাড়া শাস্তির পরিমাণ বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়েছে।’

খসড়া আইন অনুযায়ী ‘জুয়া খেলা’ বলতে বুঝাবে সরকার বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন ছাড়া সব ধরনের বাজি ধরা, অর্থ কিংবা পণ্যের বিনিময়ে প্রতিযোগিতামূলক সব ধরনের হাউজি, সব ধরনের লটারি, অর্থ বা আর্থিক মূল্যমানের কোনো পণ্যের বিনিময়ে ভাগ্য কিংবা ভাগ্য ও দক্ষতার সংমিশ্রণে কোনো আর্থিক ঝুঁকিপূর্ণ খেলা। ‘বাজি (বেটিং)’ ও ‘বাজিকর’-এর সংজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে খসড়া আইনে।

অনলাইন বেটিং
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ বা অন্য কোনো অনলাইন বা ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে খেলাধুলা বা এ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে বাজি ধরেন, বা বাজি ধরার জন্য নগদ বা ক্যাশবিহীন ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন----ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি) বা মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন- বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, পেপাল ইত্যাদি) বা বিট কয়েনসহ অন্য যে কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি বা অন্য কোনো ধরনের ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন করেন তবে তা অনলাইন বেটিং বা জুয়া হবে।

এছাড়া নিজ বা অন্যের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অনলাইন বেটিং সাইট বা অ্যাকাউন্ট রেজিস্টার করেন বা হোস্টিং দেন বা জুয়ার এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বা মাসিক ভাড়া বা অন্য কোনো প্রতিশ্রুতিতে দেশে বা বিদেশে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন বা এ উদ্দেশ্যে পরামর্শের জন্য ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচালনা করেন তবে তাও অনলাইন জুয়ার আওতাভুক্ত হবে।

খসড়ায় আরও বলা হয়, মালিক বা পরিচালনাকারী হয়ে কোনো ঘর, সাইবার ক্যাফে বা এমন অন্য কোনো স্থানকে অনলাইন বেটিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে দেন, তাহলে তা এ আইনের অধীনে অনলাইন বেটিং বলে গণ্য হবে।

‘পাতানো খেলা (ম্যাচ ফিক্সিং)’ বলতে আগে থেকে কোনো প্রতিযোগিতামূলক খেলা বা খেলার অংশবিশেষের ফল নির্ধারণ করে খেলাকে বুঝাবে এবং এটা স্পট ফিক্সিংকে (তাৎক্ষণিকভাবে কোনো খেলা বা খেলার অংশবিশেষের ফল নির্ধারণ) অন্তর্ভুক্ত করবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

অতিরাষ্ট্রিক এখতিয়ার
কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে এ আইনের কোনো অপরাধ করলে তাকে এই আইনের অধীনে এমনভাবে বিচার করা যাবে যেন তিনি ওই অপরাধ বাংলাদেশের ভেতরে করেছেন বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রবেশ করা ও পুলিশের তল্লাশির ক্ষমতা
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মনোনীত যে কোনো অফিসার বা জেলা পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট নির্ভরযোগ্য সংবাদ পেয়ে ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণ বা প্রাচীরবেষ্টিত স্থানে দিনে বা রাতে যে কোনো সময় (প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ করে) প্রবেশ করতে এবং ওই সময় ক্রীড়ারত ব্যক্তিদের নিজে বা ভারপ্রাপ্ত অফিসার গ্রেপ্তার করতে পারবেন। একই সঙ্গে জুয়া খেলার কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী আটক করতে পারবেন।

জুয়া বা বাজি আয়োজনের শাস্তি
খসড়া আইন অনুযায়ী প্রকাশ্য স্থান, ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণে, প্রাচীরবেষ্টিত স্থান বা যানবাহন বা ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে যে কেউ জুয়া খেলার উদ্দেশ্যে অর্থ আদান-প্রদান বা নিয়োজিত করলে তিনি সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জুয়া খেলা বা বাজির শাস্তি
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে প্রকাশ্য স্থান, ঘর, তাঁবু, কক্ষ, প্রাঙ্গণ, প্রাচীরবেষ্টিত স্থান বা যানবাহনে বা ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে বাজি বা জুয়ার উদ্দেশ্যে উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। জুয়া খেলতে এসেছেন প্রমাণ না হলেও যে কোনো বাজি বা জুয়া খেলার স্থানে কোনো ব্যক্তি উপস্থিত থাকলে তিনিও জুয়া খেলার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন বলে গণ্য হবে এবং বাজি বা জুয়া খেলার জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বাজিকরের শাস্তি
যদি কোনো ব্যক্তি বাজিকর হিসেবে কাজ করেন তাহলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ডে বা সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

মিথ্যা নাম ও ঠিকানা দেওয়ার শাস্তি
এ আইনের অধীনে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ অফিসার সাধারণ জুয়ার আখড়ায় প্রবেশ করে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করলে ওই ব্যক্তি নিজের নাম ঠিকানা জানাতে অস্বীকার করলে বা মিথ্যা নাম বা ঠিকানা দিলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট দোষী সাব্যস্ত করলে যে কোনো যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ ধার্য করতে পারবেন। আরোপ করা জরিমানা বা ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ না করলে ম্যাজিস্ট্রেট ৩ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারবেন।

পাতানো খেলার শাস্তি
পাতানো খেলার খেলোয়াড়, আয়োজনকারী বা অন্যান্য যারা এতে অংশগ্রহণ করেছেন বা ওই খেলাকে পাতানো করতে যারা বাজি ধরেছেন, সবাই এ আইনের অধীনে অপরাধী বলে গণ্য হবেন। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২ বছরের করাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।

অনলাইন বেটিং
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, অনলাইন বেটিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ ৩ বছরের জেল বা সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

বারবার অপরাধের শাস্তি
এই আইনের অধীনে অপরাধের শাস্তি ভোগ করার পর কোনো ব্যক্তি যদি ফের অপরাধ করেন তাহলে তিনি ওই অপরাধের জন্য এই আইনে সর্বোচ্চ যে শাস্তি রয়েছে এর দ্বিগুণ পর্যন্ত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

সাধারণ ব্যতিক্রম
সরকার ইচ্ছা করলে কোনো পর্যটন এলাকা বা বিশেষায়িত এলাকা, হোটেল বা ক্লাবকে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে এই আইনের আওতামুক্ত ঘোষণা করতে পারবে বলে খসড়া জুয়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh