স্যাংশন পাত্তা না দিলে কী হয়

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৩, ১১:৫৯ এএম

আমীন আল রশীদ। ফাইল ছবি

আমীন আল রশীদ। ফাইল ছবি

গত ২১ মে রবিবারের কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম:
* আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে, প্রস্তুত সরকার (কালবেলা)।
* নিষেধাজ্ঞা আর আসছে না, ধারণা কৃষিমন্ত্রীর (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর)।

নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো লাভ হয় না: তথ্যমন্ত্রী (বাংলা ট্রিবিউন)।
আগামী নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কায় বাংলাদেশে চলাচলে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সতর্ক করল মার্কিন দূতাবাস (চ্যানেল টোয়েন্টিফোর)।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে ১০ দিনের সফরে রাতে ঢাকা ছাড়ছে আওয়ামী লীগের ১৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল (যমুনা টেলিভিশন)। 

একটু পেছনে ফেরা যাক
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আলাদাভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর সরকারের যে নির্বাহী আদেশে (নম্বর ১৩৮১৮) এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্তের কথা বলা আছে। (প্রথম আলো, ১১ ডিসেম্বর ২০২১)।

এর বছর খানেক পর গত বছরের ২৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে এবং গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলেছিলেন, এ নিষেধাজ্ঞাই শেষ নয়, দেশের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আসছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, যাদের নামে এ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যাদের নামে জারি হবে, তাদের খুবই ভারী ভারী ডোসিয়ার (ব্যক্তিগত ও পেশাগত তথ্যসমৃদ্ধ ফাইল) তৈরি হয়েছে। দুর্নীতি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বড় বড় ডোসিয়ার আছে সবার। ডোসিয়ারগুলো আর কয়েক দিনের মধ্যেই কমপ্লিট হবে। তারা ডোসিয়ার কমপ্লিট করে কাজটা করে এই কারণে যে, যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাদের বিরুদ্ধেও যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ নিয়েই করে। কারও কথা শুনে কিংবা কোনো বিরোধী দলের কথা শুনে কারও নামে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিল এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। খুব হেভি ডকুমেন্টেশন নিয়ে এই কাজগুলো করা হয়। (যুগান্তর, ২৯ জানুয়ারি ২০২২)।

র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে হার্ড লাইনে যেতে শুরু করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যদিও ড. ইউনূস ইস্যুতে দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের টানাপড়েন আগে থেকেই ছিল, যেটি আরও শক্ত হয় স্যাংশন ইস্যুতে। সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় চায় না। আর এ কারণেই বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’ স্মরণ করা যেতে পারে, গত ১৬ মে বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের এক মাস আগেই তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পাল্টাতে পারে।’ 

ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আঁতাত করে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসার পাঁয়তারা করছে বিএনপি। যদিও কোনো একটি বিদেশি রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের সরকার ফেলে দিতে পারে কি না; অন্তত বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম এবং উঠতি অর্থনীতির দেশের ক্ষমতায় কে থাকবে বা থাকবে না, সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে কি না, সেই আলোচনাটিও বেশ পুরনো। কিন্তু ক্ষমতা থেকে কোনো দলকে সরানো কিংবা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারুক বা না পারুক, তারা যদি কোনো দেশের সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা দেয়, তার শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্ব আছে। তাছাড়া স্যাংশন ইস্যুতে যদি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও খারাপ হতে থাকে, তাহলে এটি শুধু নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্যই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্যও নানা ধরনের বিপদ তৈরি করতে পারে। 

মনে রাখতে হবে, সমালোচনা ও বিতর্ক যতই থাকুক, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখনো একটি বড় ফ্যাক্টর। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো যুক্তরাষ্ট্র যা চায়, তার বাইরে খুব একটা যেতে পারে না। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে নানা বিষয়ে কাজ করতে হয়। বিশেষ করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সদস্যরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন এবং যে মিশনে প্রচুর বাংলাদেশি যাওয়ার সুযোগ পান; যার মধ্য দিয়ে ওই সদস্যদের পেশাগত ও আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি বাংলাদেশও নানাভাবে লাভবান হয়, সেই মিশনে বাংলাদেশের সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির পথে যুক্তরাষ্ট্র চাইলে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। 

দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা স্যাংশন দেবে তাদের কাছ থেকে কিছু কিনব না।’ এটা নিঃসন্দেহে খুবই সাহসী উচ্চারণ। কিন্তু বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু না কেনে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও কি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক তার দেশের বাজারে ঢুকতে দেবে?

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র চাইলে কি বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকা- এবং ঋণ ইস্যুতে এই দুই প্রতিষ্ঠান যাতে যুক্ত না হয়, সে ব্যপাারে চাপ দিতে পারে না?

তার মানে কয়েকজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন আরোপের নানামাত্রিক প্রতিক্রিয়া আছে। এটি নির্ভর করে বাংলাদেশ কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তার ওপর। 

এটা ঠিক যে, বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির সমীকরণ বদলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার একক মোড়লগিরির দিন শেষ। এখন শুধু চীন ও ভারতের মতো বড় দেশই নয়, ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তার রয়েছে বঙ্গোপসাগর। আছে ১৮ কোটি মানুষ। তার নিকটতম প্রতিবেশী শক্তিশালী ভারত। উন্নয়ন সহযোগী জাপান ও চীন, যে চীন রাশিয়ারও বন্ধু। অতএব  ভূরাজনীতির খেলায় বাংলাদেশ ছোট রাষ্ট্র বলে কেউ এসে একটা ধমক দিয়ে যাবে আর বাংলাদেশ সেটি মাথা নিচু করে মেনে নেবে, সেই দিন গত হয়েছে। 

কিন্তু তারপরও ভাবা দরকার যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করে বা বাড়িয়ে বাংলাদেশ আখেরে খুব বেশি লাভবান হবে কি না, যেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল কথাই হলো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী অর্থনীতি ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি দেশের সঙ্গে বৈরিতায় জড়ানোর মতো শক্তি ও সামর্থ্য কি বাংলাদেশ অর্জন করেছে? 

আবার এটিও ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ যদি বৈরিতা সৃষ্টি করে, বাংলাদেশ কি সেখানে চুপ থাকবে? নিশ্চয়ই না। দেখতে হবে সমস্যাটা কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন ইত্যাদি ইস্যুতে যেসব প্রশ্ন তুলছে, সেগুলোর কি বাস্তবতা আছে? যুক্তরাষ্ট্র কি যথেষ্ট পরিমাণে তথ্যপ্রমাণ না পেয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা দেয়? তারা কি চাইলেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে, একটি দেশের সরকারকে পছন্দ করছে না, শুধু এই অজুহাতে সে দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্যাংশন দিয়ে দিতে পারে?

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন, স্বচ্ছতা, বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমতের স্বাধীনতা ইত্যাদি কী অবস্থায় আছে, সেটি দেশের মানুষ নিজের চোখেই দেখতে পায়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে স্যাংশন দেবে কি না বা দিলেও তার প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হবে, সেটি এক ধরনের আলোচনা। বরং আত্মসমালোচনা জরুরি যে, আসলেই আমরা সঠিক পথে আছি কি না? শুধু রাজনৈতিক পরিচয় ও আদর্শ বিবেচনায় নয়, বরং একজন দলনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষ হিসেবে সে কেমন আছে, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং সেখানে যেসব ব্যত্যয় রয়েছে, সেগুলোর সুরাহা জরুরি। 

যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত-জাপান-রাশিয়া তাদের মতো করে কূটনীতির খেলা খেলুক। আমাদের রাজনীতিবিদদের উচিত নিজেদের ঘর সামলানোর চেষ্টা করা। কেননা অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনীতিবিদরা যখন নিজেদের ঘর সামলাতে ব্যর্থ হন, তখন সেই ঘর অন্য কেউ এসে দখল করে নেয় বা দখলের চেষ্টা করে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh