ইউক্রেনকে কেন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে ব্রিটেন

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৩, ০৯:৪৮ এএম

ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দেড়শ ফুটের কম উচ্চতা দিয়ে উড়ে গিয়ে টার্গেটে হামলা করে। ছবি: সংগৃহীত

ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দেড়শ ফুটের কম উচ্চতা দিয়ে উড়ে গিয়ে টার্গেটে হামলা করে। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনকে ‘স্টর্ম শ্যাডো’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার ব্রিটেনের ঘোষণার পর তা মিডিয়াতে বেশ আলোচিত হচ্ছে। সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেটের পাল্লা প্রায় ৮০ কিলোমিটার, যার তুলনায় স্টর্ম শ্যাডোর পাল্লা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। এই ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া হয়ে থাকে। মার্কিন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সেডরিক লেইটন বলেছেন, এই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দেড়শ ফুটের কম উচ্চতা দিয়ে উড়ে গিয়ে টার্গেটে হামলা করে বলে এগুলো খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। 

ইউক্রেন বলছে, তারা এই ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার ভূখণ্ডের ভেতর হামলায় ব্যবহার করবে না। তবে যেহেতু ব্রিটেন ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে ইউক্রেনের অংশ বলে স্বীকৃতি দেয়, তাই এগুলো হয়তো ক্রিমিয়ায় রুশ সামরিক ঘাঁটির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার ‘এটাকমস’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিতে রাজি হয়নি। স্টর্ম শ্যাডোর পাল্লা কিছুটা কম হলেও তা এটাকমসের চেয়ে আরও অনেক বেশি সক্ষমতার; কারণ স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা বেশ কঠিন। 

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটটিউটের (রুসি) সিনিয়র ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং এক লেখায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে হিমারস আর্টিলারি রকেট এবং এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় ইন্টেলিজেন্স সরবরাহ করার পর থেকে রুশ লজিস্টিকস ব্যবস্থা এবং কমান্ড সেন্টারগুলো চাপে পড়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া তাদের কমান্ড সেন্টার ও লজিস্টিকস হাবগুলোকে ফ্রন্টলাইন থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে বা রকেটের পাল্লার বাইরে নিয়ে গেছে। 

রুশ কমান্ড সেন্টারগুলো এখন শক্তিশালী বাংকারের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে; যা রকেটের পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তবে স্টর্ম শ্যাডোর ওয়ারহেড এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা শক্তিশালী বাংকার ধ্বংস করতে পারে। রাশিয়া তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাও যথেষ্ট উন্নত করেছে; যার ফলে ইউক্রেন আক্রমণে গেলেই রুশ আর্টিলারি তাদের চাপে ফেলছে। রাশিয়া তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করেছে। তবে স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র আকাশ প্রতিরক্ষা রাডারের পক্ষে খুঁজে বের করা বা ধ্বংস করা কষ্টকর। ওয়াটলিং বলেছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের হাতে যাওয়ার কারণে রাশিয়া তার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে বাধ্য হবে। আর ক্রিমিয়া উপদ্বীপের রুশ বিমান ঘাঁটিগুলোতে এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণে কিছু সময়ের জন্য তারা বাধা দিতে পারবে না।

ব্রিটেনের এক্সপ্রেস পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে রুসির ডিরেক্টর নীল মেলভিন বলেন, স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের সক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রকে তারা যথেষ্টই প্রভাবিত করতে পারবে। তবে কোনো একটা অস্ত্র পুরো যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন করতে পারে না। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে হিমারস আর্টিলারি রকেট দেওয়ার পর থেকে রাশিয়া সেই অনুযায়ী নিজেদের কর্মকাণ্ডকে পরিবর্তন করেছে; যা যুদ্ধক্ষেত্রে হিমারসের প্রভাব অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। কাজেই যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হলে ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া সাঁজোয়া যান, ক্ষেপণাস্ত্র, মাইন অপসারণ প্রযুক্তি, যুদ্ধবিমান, সেতু তৈরির সরঞ্জাম, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পদাতিক বাহিনীর ট্রেনিং, ইন্টেলিজেন্স ও লজিস্টিকসের সমন্বয় ঘটাতে হবে। ইউক্রেনের হাতে এই ক্ষেপণাস্ত্রের অর্থ হলো, রাশিয়া কমান্ড সেন্টার, রসদের মজুত বা জ্বালানির ডিপোর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার বাইরে সরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। এতে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার সমন্বয় কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে। 

জ্যাক ওয়াটলিং বলেছেন, যুদ্ধের মাঝে বিশেষ কিছু অস্ত্র নিয়ে এত বেশি আলোচনা হচ্ছে যে, যুদ্ধকৌশলের গুরুত্ব সবাই ভুলে যাচ্ছেন; যা যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের একেকটার দাম প্রায় ১০ লাখ ডলার। আর যুদ্ধের মোড় ঘুরানোর মতো যথেষ্ট সংখ্যক স্টর্ম শ্যাডো ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে পারবে না ব্রিটেন। কিন্তু যদি ইউক্রেন এগুলো চতুরতার সঙ্গে ব্যবহার করে, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু ফাঁকা ক্ষেত্র তারা তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে; যা তাদেরকে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো সুযোগ করে দিতে পারে। 

কর্নেল লেইটন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না তাদের দেওয়া অস্ত্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হোক। কারণ ওয়াশিংটন মনে করছে যে, এতে রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই তারা ইউক্রেনের উপর চাপ অব্যাহত রাখবে যাতে কিয়েভ মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র রুশ ভূখণ্ডে ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। জ্যাক ওয়াটলিং ব্রিটিশ সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়ে বলেন, স্টর্ম শ্যাডোর মাধ্যমে যুদ্ধের পরিধি বেড়ে গেছে চিন্তা না করে বরং বুঝতে হবে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের কিছু সক্ষমতার ঘাটতি পূরণে কিয়েভকে এগুলো দিচ্ছে ব্রিটেন। 

বিশ্লেষকদের মতামতগুলো দেখিয়ে দেয় যে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্রিটিশ ও মার্কিন চিন্তার পার্থক্য দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্র চিন্তিত যে, স্টর্ম শ্যাডোর কারণে রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাবে কিনা। ইউক্রেন যাতে ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যবহার না করে, সেটার গ্যারান্টি কিন্তু ওয়াশিংটনকে লন্ডনের কাছ থেকেই নিতে হবে। অর্থাৎ ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ করলেও যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের রজ্জু ব্রিটেন তাদের হাতে রাখতে চাইছে।

এর আগে ইউক্রেনকে ট্যাংক দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটেন অগ্রগামী ভূমিকা নিয়েছিল। ইউক্রেনকে পশ্চিমা যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার বিষয়েও ব্রিটেন বেশি কথা বলছে। আবার রাশিয়াও গত বছরের অক্টোবরে অভিযোগ করে যে, ব্রিটেন বাল্টিক সাগরের ‘নর্ড স্ট্রিম’ পাইপলাইনে হামলায় জড়িত ছিল; এবং তারা সেভাস্তোপোল বন্দরে রুশ নৌবাহিনীর উপর হামলায় ইউক্রেনকে সহায়তা দিয়েছে। মোট কথা, রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের উত্তেজনা কতটা বৃদ্ধি পাবে, সেটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে লন্ডন ও ওয়াশিংটনের মধ্যে রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা; যা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করার ব্রিটিশ প্রচেষ্টারই অংশ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh