ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন

ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন ঋণ সুবিধা

এমএইচ রশিদ

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩, ০১:১০ পিএম

বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

অনিয়ম, দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণে পর্যুদস্ত দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য আইন সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া হয় বছর দুয়েক আগে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শও নেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনের আগে এসে সেই আইন হয়েছে ঠিকই, তবে অভিযুক্তদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই।

ব্যাংকের পরিচালকরা এখন এক যুগ ধরে পরিচালক থাকতে পারবেন। যদিও তাদের কেউ কেউ যুগ ধরে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। আর ব্যবসায়ীরা খেলাপি হলেও পাবেন নতুন নতুন ঋণ সুবিধা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্কারের নামে ব্যাংক খাতকে আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো। 

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে গত ৮ জুন অর্থমন্ত্রী ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল-২০২৩ তুলেছিলেন। সংশোধনীর মূল প্রস্তাবে পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানো-কমানোর বিষয়ে কোনো প্রস্তাব ছিল না। পরে সেটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কমিটিও পরিচালক পদের মেয়াদ নিয়ে কোনো সংশোধনী আনেনি। তবে সংসদে বিলটি পাসের আগে টাঙ্গাইল-৬ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু পরিচালকদের মেয়াদ বাড়ানো ও খেলাপি ঋণগ্রহীতার ঋণ সুবিধা বিষয়ক সংশোধনী দুটির প্রস্তাব করেন। গত ২১ জুন জাতীয় সংসদে কণ্ঠ ভোটে পাস হয়। 

এই আইনের বিষয়ে জাতীয় পাটির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, পরিচালকরা হচ্ছেন ব্যাংক লুটপাটের মূল হোতা। কোনো পরিচালক সুপারিশ না করলে আমার মতো লোক গেলে ব্যাংকঋণ মিলবে না। চেয়ারম্যান-পরিচালকের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক শেষ। যেখানে ব্যাংক লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে আর বাংলাদেশ ব্যাংক বসে বসে তামাক খায়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান-পরিচালক হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে চলে যান। পরিচালকের মেয়াদ ১২ বছর করার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন আগে একটি গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পেত না। এখন এই বিধিনিষেধ উঠে গেল। যারা ঋণখেলাপি, তাদের এখন যতটা সম্ভব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ তো কমবেই না, বরং ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হবে। ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে পড়বে।

এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, যারা ঋণখেলাপি, তাদের এখন যতটা সম্ভব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ তো কমবেই না, বরং ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হবে। ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে পড়বে। উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত প্রয়োজন। সেই বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত তার অন্তরায়। আমানতকারীদের অর্থের এমন ব্যবহার হবে, খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি লিখিত প্রস্তাবে জানিয়েছিলেন, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান যাতে ঋণসুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। তারা বলেছিলেন, ঋণ ইচ্ছাকৃত খেলাপি না হলে বা যুক্তিসঙ্গত কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে সেই ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য হবে না। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যাংকগুলো যেন ঋণ দেয়। ব্যাংক পরিচালকেরা যখন এই প্রস্তাব জমা দেন, তখন সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় এমন কোনো ধারা ছিল না।

আইনটি তখন অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ছিল। ওই কমিটি সংসদে যে মতামত পেশ করে, তাতেও ব্যাংক পরিচালকদের প্রস্তাবটি স্থান পায়নি। কিন্তু আইনটি পাসের দিন সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম ২৭(কক) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব আনেন। তিনি যেভাবে ওই ধারা সংশোধনের প্রস্তাব আনেন, তা অনেকটা সরকারের উচ্চপর্যায়ে ব্যাংক পরিচালকদের দেওয়া প্রস্তাবের মতো। 

লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়, গত দেড় দশকে ভোগ্যপণ্যের বাজার, জাহাজভাঙা শিল্পের উত্থান-পতনসহ বিভিন্ন কারণে অনেক ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়েন। তাদের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসায়ী। আবার বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করেও অনেক ভালো গ্রুপ প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়ে। অনেক ব্যাংক উদ্যোক্তা এসব প্রতিষ্ঠান কিনে নিচ্ছে। আবার অনেক ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ এতে আটকে পড়েছে।

এ কারণেই কয়েকজন ব্যাংক উদ্যোক্তা ঋণখেলাপিদের আবার ঋণ দেওয়ার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রস্তাব দেন। সংশোধনী আইনের বিষয়ে এক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা শুধু পরিচালকদের মেয়াদ ৯ থেকে ১২ বছর করার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। লিখিত প্রস্তাবে আরও কিছু দিতে হয়, এ জন্য খেলাপিদের ঋণের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাবটি যুক্ত করা হয়েছিল। এটাও পাস হয়ে যাবে, সেটা ভাবিনি। এটা ব্যাংক খাতের জন্য ক্ষতির কারণ হলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, খেলাপিদের ঋণ নেওয়ার আইনি সুযোগ দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তেমন কিছু করণীয় থাকছে না। প্রভাবশালী কাউকে ঋণ নেওয়া থেকে বিরত রাখার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। এখন ঋণখেলাপি বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু করতে পারবে না। তবে এই সুযোগ দেওয়ায় সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণ কমতে পারে। কারণ একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অনেক সময় পুরো গ্রুপের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় উঠেছে। খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক এখন তা কমানোর পথ খুঁজছে এবং নীতি ছাড় দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, ব্যাংক কোম্পানি আইন পাঁচ বছর আগে সংশোধন করে পরিচালকদের তিন মেয়াদে টানা নয় বছর দায়িত্বে থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের দাবির মুখে এবার আইনের ওই ধারাটি আবারও সংশোধন হয়েছে। এখন থেকে পরিচালকরা চার মেয়াদে টানা ১২ বছর ব্যাংকের পর্ষদে থাকতে পারবেন। এমনকি এক মেয়াদ বিরতি দিয়ে আবারও পর্ষদে ফিরতে পারবেন ব্যাংক উদ্যোক্তারা। 

আইনটি ২০১৮ সালে সংশোধনের আগে ব্যাংক পরিচালকরা পরপর দুই মেয়াদে ছয় বছর পর্ষদে থাকার সুযোগ পেতেন। আর এবার সংশোধনের মাধ্যমে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কিছু পরিবার ও ব্যক্তির কাছে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ দেওয়া হয়েছে। 

জাতীয় সংসদে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ব্যাংক মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য আইনটি আনা হয়েছে। তারা জনগণের টাকা অপব্যবহার করেন। সর্দি-কাশি হলেই তারা ব্যাংকের টাকায় সিঙ্গাপুর চলে যান। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh