ব্রিকসের সম্প্রসারণের সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক ফলাফল

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৩, ০১:১৮ পিএম

ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর পতাকা।

ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর পতাকা।

দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে ‘ব্রিকস’ জোটের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ২ জুন। পশ্চিমা বৈশ্বিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার উদ্দেশ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে প্রতিষ্ঠাতা দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা সংস্থার সম্প্রসারণ নিয়ে কথা বলে। একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে থাকা পাঁচটি রাষ্ট্রের হালকা বন্ধনের ওপর গঠিত সংস্থা বলে মনে করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রচেষ্টায় এর কর্মকা- নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করতে থাকে। আর ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়াও সংস্থাটি শক্তিশালী করতে আগ্রহী হয়। গত বছর ব্রিকসের এক অনলাইন বৈঠকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়া ইয়ি বলেন, চীন ব্রিকসের সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইছে। চীনের এই প্রস্তাবের পর থেকে সদস্য দেশগুলো ব্রিকস সম্প্রসারণের জন্য নিজেদের মনোনীত দেশের তালিকা দিতে শুরু করেছে। 

ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কিউবা, ডি আর কঙ্গো, কমোরুজ, গ্যাবন এবং কাজাখস্তান- এবারের বৈঠকে ‘ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস’ নিয়ে আলোচনার জন্য প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল। এছাড়াও মিশর, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, গিনি বিসাউ ও ইন্দোনেশিয়া এবারের বৈঠকে ভার্চুয়ালি অংশ নেয়। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেন, ব্রিকসের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে যে সংস্থার সদস্যপদ পেতে কেমন নীতি, মানদণ্ড বা শর্ত থাকবে এবং কোন পদ্ধতিতে সম্প্রসারণ হবে। আগস্ট মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকসের শীর্ষ বৈঠকের আগে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলবে। 

ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ থাকলেও আর্থিক বিনিয়োগই প্রধান। ফিনানসিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরব নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) সদস্য হিসেবে যুক্ত হবে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। ‘এনডিবি’ হলো ব্রিকসের আর্থিক সংস্থা এবং এটিকে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রতিষ্ঠাতা দেশ রাশিয়ার অর্থনৈতিক সমস্যা এনডিবির অর্থের উৎসকে চাপে ফেলেছে; কারণ এই ব্যাংকে রাশিয়ার ১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ইতোমধ্যেই ব্রিকসের বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, বাংলাদেশ ও উরুগুয়েকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে এনডিবি এবং ৩৩ বিলিয়ন ডলার এই দেশগুলোতে বিনিয়োগ করেছে। ব্যাংকের ডিরেক্টর জেনারেল আশওয়ানি মুথু এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই মুহূর্তে অর্থের জোগান সংস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণে চীনা মুদ্রা ইউয়ান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা র‍্যান্ডে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। 

ব্রিকসের সম্প্রসারণ একবার ইতোমধ্যেই হয়েছে। ফ্রান্সের ‘লে মুন্ড’ পত্রিকার এক লেখায় বলা হয়েছে, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও গোল্ডমান সাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ওনীল ২০০১ সালে যখন প্রথম ভবিষ্যতের চারটি বড় অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেন, তখন এর মধ্যে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন থাকলেও দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল না। এই চার দেশকে তিনি একত্রে ‘ব্রিক’ বলেছিলেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার দীর্ঘ সময়ের কূটনীতির ফলস্বরূপ দেশটি নতুন এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এর নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় ‘ব্রিকস’। ওনীল বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার এই সংস্থায় যুক্ত হওয়াটা অর্থহীন। তবে যদি দেশটিকে পুরো আফ্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম। ওনীলের এই চিন্তা দক্ষিণ আফ্রিকার চিন্তাবিদেরা কীভাবে দেখছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রিটোরিয়া ইউনিভার্সিটির লায়াল হোয়াইট বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যৎ হলো আফ্রিকার বাজার ধরা; এখানে বাইরের কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়ে আসাটা বিপজ্জনক। 

ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক ইন্দ্রানি বাগচি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় এক লেখায় বলেন, ব্রিকসের সম্প্রসারণ উভয় সংকট তৈরি করতে পারে। যেহেতু ব্রিকসের সদস্য রাষ্ট্রগুলো পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণকে পাশ কাটিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্বব্যবস্থা চাইছে, সেহেতু রাশিয়া ও চীন উভয়কেই সাবধান হতে হবে যে, ব্রিকসের নতুন সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কাউকে যেন যুক্তরাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারে। পুরনো বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন হলেও সেখান থেকে পরিস্থিতি ঘুরিয়ে ফেলতে পারদর্শী যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে সৌদি আরবের কথা উল্লেখ করেন তিনি। 

অনেক প্রশ্ন থাকলেও ব্রিকসকে অনেকেই পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে দেখার চেষ্টা করছে। দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পান্ডর কেপটাউনের বৈঠকে বলেছেন, করোনা মহামারির সময়ে ধনী দেশ ও বৈশ্বিক সংস্থাগুলো যখন উন্নয়নশীল দেশকে উপেক্ষা করেছিল, তখন ব্রিকস তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। উন্নত দেশগুলো কথা দিয়ে কথা রাখেনি এবং তারা সকল দায় উন্নয়নশীল দেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। ডি আর কঙ্গোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফে লুতুনদুলা আপালা বলেছেন, তার দেশ নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থা তৈরি করে পরিবর্তন আনতে ব্রিকসকে উৎসাহ জোগাবে, কারণ সামষ্টিক শান্তি ও উন্নয়নে উন্নত দেশগুলোর কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। 

নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থে অনেক দেশ ব্রিকসের সদস্য হতে চাইলেও পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হয়ে ওঠার মতো অবস্থান ব্রিকস এখনো তৈরি করতে পারেনি। ভারত ও চীনের মতো কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ায় সংস্থার লক্ষ্যের দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংস্থার রাজনৈতিক কর্মকা- এখনো কিছু বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তথাপি অর্থায়নের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীলতা এবং মার্কিন ডলারকেন্দ্রিক পশ্চিমা পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থাকে বাইপাস করতে না পারাও সংস্থার বড় দুর্বলতা। ফিনানসিয়াল টাইমস বলেছে, ব্রিকসের ব্যাংক ‘এনডিবি’ এবং চীনের এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ইতোমধ্যেই পশ্চিমা ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির চাপে অর্থায়নের খরচ কমাতে রাশিয়াতে তাদের বিনিয়োগ কার্যক্রমকে স্থগিত করেছে। ডলারভিত্তিক ঋণ নেওয়া সহজ করতেই এনডিবির নীতিতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এতে প্রমাণ হয় যে, পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে আবির্ভাবের কথা বললেও মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরশীলতাকে এড়াতে পারেনি ব্রিকস।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh