মনজুরুল হক
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৪৬ এএম
করোনা সংকট এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে মন্দায় সবাইকে মিতব্যয়ী হতে বলা হচ্ছে। অথচ এ দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের বাহুল্য খরচের সামর্থ্য নেই।
একটা গ্রামের কয়েকশ পরিবার সারা মাসে যা খরচ করে, ঢাকায় একজন আমলা একদিনে আপ্যায়ন বাবদ তার চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করে। ঢাকাসহ দেশের সরকারি কর্মকর্তারা তাদের বিলাসবহুল গাড়িতে একদিনে যে পরিমাণ অকটেন পোড়ায় সেটা একটা গোটা জেলার সাধারণ মানুষ সারা বছরও করে না।
সাধারণ মানুষ, ফলাও করে যাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার, যা দৈনিক হিসাবে প্রায় ৭২৭ টাকা দেখানো হয়, তাদের ৭৩ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই! দেশের বাজার দরে একজন মানুষের দৈনিক স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য খরচ পড়ে প্রায় ২৭৬ টাকা, অথচ এই টাকা ৭৩ শতাংশ মানুষের নেই। এটা আমাদের নয়, জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনের তথ্য।
এসবের সমাধানে যা করার কথা ভাবা হচ্ছে তা আরও বিপজ্জনক! ঋণ করে ঋণ শোধ দেওয়ার পলিসি! ঠিক এই কাজটি করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা ডুবেছে। জিডিপির অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.৮ শতাংশ, আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ, ৪২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশই কমছে, যা দিয়ে মাত্র চার-পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
ডলার-সংকটের কারণে গ্যাস খাতের দায় শোধ করতে পারছে না সরকার। শুধু পেট্রোবাংলারই দায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পরিণামে সংকট বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। দায় শোধ করতে না পেরে মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলা অনেকটাই অসহায়ত্ব বোধ করছে। জানা যায়, ডলার-সংকটে পড়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির বিল শোধের পাশাপাশি দেশের নিজস্ব উৎস থেকে উত্তোলন করা গ্যাসের বিল এবং স্পট মার্কেট থেকে আনা এলএনজির বিলও দিতে পারছে না পেট্রোবাংলা।
গত ১৭ এপ্রিল থেকে ১৭ মে পর্যন্ত এক মাসের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা এলএনজির বিল এবং এলএনজি টার্মিনালের বিল বাবদ বকেয়া আছে ২২২ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার (২ হাজার ৩৮৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা)।
চলতি বছরের ২১ মে পর্যন্ত পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস ক্রয় ও উত্তোলন খরচ বাবদ বিদেশি কোম্পানিগুলোর বকেয়া পাওনা ৪১০ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকার বেশি। এই বকেয়া পাওনার মধ্যে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মার্কিন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান শেভরনের বকেয়াই ২ হাজার ৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকার বেশি।
পেট্রোবাংলার কাছে শেভরনের পাওনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পেট্রোবাংলা গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কোনো পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি। ডলার-সংকটের অজুহাত দেখিয়ে এত দিন রাখা গেলেও শেভরন এখন পেট্রোবাংলাকে অনুরোধ করেছে প্রতি মাসে যে বিল জমা দেওয়া হয়, সেটার কমপক্ষে ৩০ শতাংশ পরিশোধ করতে, যাতে তারা পরিচালন ব্যয়সমূহ বহন করতে পারে।
গত মাস কয়েক ধরে চাল, ডাল, তেল, পানি থেকে পান-সুপারি পর্যন্ত বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। অথচ নিত্যপণ্যের এমন দামের প্রতিবাদে রাস্তায় কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ নেই। এর মানে তারা যে সব মেনে নিয়েছেন, আসলে তো তা নয়। কিন্তু মধ্যবিত্তের করারই বা কি আছে?
সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘সারের মূল্যে ভর্তুকি টানতে গিয়ে সরকারের খুব দুর্গতি হচ্ছে।’ অর্থাৎ সামনে সার-বীজসহ কৃষি খাতে কী খড়গ আসতে পারে সেই বার্তা স্পষ্ট তার বক্তব্যে।
পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে যদি সেসব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়, যারা বলছেন, ‘রিজার্ভ সামলাতে বিদেশি ঋণের বিকল্প নেই!’ আর তারা পরিস্থিতি সামলাতে কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফ থেকে। সর্বশেষ রপ্তানি ব্যয় পরিশোধের পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ৩৯.৭৭ বিলিয়ন মর্কিন ডলার। গত সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে ১.৯৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় নিষ্পত্তির পর রিজার্ভের এই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বরে রিজার্ভ ছিল ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলার। গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম রিজার্ভের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেল।
বাংলাদেশ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে ১৪০ বিলিয়ন ডলারে ঋণ নিয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। আর সুদ পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে। শুধু রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পেই ২০২৩ সাল থেকে বছরে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার সুদ দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও রাশিয়ার বন্ধু দেশগুলোর কোনো সমস্যা হয়নি, বরং তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশ পরীক্ষিত বন্ধু হয়েও কেন রাশিয়ার দেওয়া সুযোগ কাজে লাগতে পারল না? ভারত সস্তায় রাশিয়ান তেল কিনে অন্য দেশে বিক্রি করে মুনাফা করলেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির ভয়ে রাশিয়াকে এড়িয়ে পশ্চিমাদের মুখপানে তাকিয়ে ছিল। সেই পশ্চিমও বাংলাদেশকে হতাশ করেছে। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক খবর হলো সোনার ভরি ১ লাখ ছাড়িয়েছে, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি দেদার কাগুজে নোট ছেপে সরকারকে ধার দিচ্ছে!
১৮ জুন তারিখে সিপিডির এক সেমিনারের ভাষ্য, ‘এ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা ছাপানো থেকে বিরত থাকতে হবে। গতবার যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয়, তখন তারা ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। কিন্তু এখন তো আর ডলার বিক্রি করার অবস্থা নেই। ফলে সরকারকে ঋণ দিতে গিয়ে টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে।’
২০ জুলাইয়ের খবর, ‘মূল্যস্ফীতির শঙ্কার মধ্যেই টাকা ছাপিয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’ এর মধ্যে বজ্রপাতের মতো দুঃসংবাদ হলো- চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। তাতে করে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির শঙ্কা বাড়ল। বাসমতী ছাড়া অন্য সব ধরনের চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত। এ জন্য বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় বিষয়টিকে সামনে এনেছে দেশটির সরকার। ভারতের এ সিদ্ধান্তের কারণে নতুন করে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। খবর রয়টার্সের।
আরও একটা বজ্রপাত ঘটতে চলেছে গম আমদানি নিয়ে। শস্যচুক্তি নবায়ন হয়নি, গম আমদানিতে নতুন বিপদে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে গম আমদানির প্রধান উৎস ইউক্রেন। দেশটির সঙ্গে খাদ্যশস্য রপ্তানি চুক্তি থেকে রাশিয়া বেরিয়ে যাওয়ায় সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার আপত্তিতে নতুন করে আর চুক্তিটি নবায়ন হয়নি। তাতে ইউক্রেন থেকে গম আমদানিতে তৃতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ যে নতুন করে বিপদে পড়তে যাচ্ছে, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সুতরাং এই মুহূর্তে দেশে চলমান এনার্জি সংকট, রিজার্ভ সংকট, মজুদ সম্পদের অতিরিক্ত নোট ছাপাজনিত তীব্র মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের মারাত্মক ঊর্ধ্বগতি কোথায় গিয়ে থামবে আমরা অনুমান করতে পারি না। তাই বলে তো আর বিপর্যয় থেমে থাকবে না। আগামী মাসগুলোতে সেই বিপর্যয়ে সাধারণ মানুষের কতটা সর্বনাশ হবে সেটাই আশঙ্কার বিষয়।