কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সংবাদ মাধ্যম

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৬:০২ পিএম

গাজী তানজিয়া। ফাইল ছবি

গাজী তানজিয়া। ফাইল ছবি

গত কয়েক বছর ধরেই প্রযুক্তি দুনিয়ায় দাপট দেখিয়ে চলেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আগামীতে কৃত্রিম মেধা ব্যবহার করে কোন কোন ক্ষেত্রে বিপ্লব আসতে চলেছে, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। 

সম্প্রতি আমাদের দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এআই নিউজ প্রেজেন্টার সংবাদ পরিবেশন করলে এই বিষয়টি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি শিল্প ও ব্যবসায়িক খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই টুলসের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুব সহজেই সব কাজ সম্পাদন করে থাকে। তথ্য প্রক্রিয়াজাত থেকে শুরু করে ওয়েবসাইট তৈরি, বিভিন্ন গবেষণা, এমনকি কোডিং পর্যন্ত এআই দিয়ে করানো হচ্ছে। আর অদূর ভবিষ্যতে এটি আমাদের কাজকে আরও সহজ করে তুলবে সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে এআই প্রযুক্তি লেখার মাধ্যম হিসেবে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যক্তিও আর্টিকেল লেখার ক্ষেত্রে চ্যাট-জিটিপির সাহায্য নিতে শুরু করেছেন। 

স্প্যানিশ রসায়ন পণ্ডিত লুক বলেন, ‘আগে কোনো আর্টিকেল লিখতে যেখানে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগত, এখন সে কাজ এক দিনেই করা সম্ভব।’ লুকের মতে এর মাধ্যমে তিনি তার ইংরেজিকে আরও বেশি অর্থবহ করে তুলতে পারেন।

তবে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিগুলোর পর এআই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে সংবাদ মাধ্যমের ওপর। বিশ্বজুড়ে মিডিয়া শিল্প ইতোমধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব দেখাতে শুরু করেছে। প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম সিনেট এআই টুল দিয়ে আর্টিকেল লেখাচ্ছে। চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সঙ্গে বাজফিড চুক্তি করেছে যাতে সংবাদ মাধ্যমটির বিভিন্ন রকমের কনটেন্ট তৈরিতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানো যায়। সম্প্রতি গুগল পরীক্ষামূলকভাবে জেনেসিস নামে একটি পণ্য নিয়ে এসেছে যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে খবর লিখতে পারে। গুগল এই টুল দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো সংবাদ সংস্থার কাছে বিক্রির চেষ্টা করছে। এই টুলটি যে কোনো বিষয়ে তথ্য নিয়ে যেমন (কোনো চলতি ঘটনার বিস্তারিত তথ্য, সংবাদ কনটেন্ট তৈরি) অর্থাৎ সংবাদ নিবন্ধ লিখতে পারে।

গুগল মনে করে, জেনেসিস সাংবাদিকদের জন্য এক ধরনের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করতে পারবে। এর সুবাদে কিছু কাজ অটোমেশনের আওতায় আনা যাবে। এতে অনেকের সময় বাঁচবে। গুগলের প্রচারণা দেখা কয়েকজন নির্বাহী একে বিচলিত করে তোলার মতো ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেছেন। গুগলের মুখপাত্র জেন ক্রিডার এক বিবৃতিতে বলেছেন, সংবাদ প্রকাশক, বিশেষ করে ছোট প্রকাশকদের সঙ্গে সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে তাদের সংবাদকর্মে সহায়তা করার জন্য এআই চালিত টুল দেবে গুগল। 

তিনি আরও বলেন, রিপোর্টিংয়ে সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জায়গা নেওয়া এসব টুলের উদ্দেশ্য নয়, এবং সেটা করাও অসম্ভব। এসব টুল সংবাদ নিবন্ধ তৈরি বা ফ্যাক্ট-চেকিংও করবে না। এই টুলগুলো নানা ধরনের শিরোনাম সাজিয়ে দেবে, একটি লেখাকে নানা স্টাইলে পুনর্লিখন করে দেবে। 

অপরদিকে সাংবাদিকতার অধ্যাপক জেফ জার্ভিস বলেন, গুগলের নতুন এই টুলের সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। 

জার্ভিসের মতে, ‘এই প্রযুক্তি যদি সঠিক তথ্য নির্ভরযোগ্যভাবে দিতে পারে, তাহলে সাংবাদিকদের এই টুল ব্যবহার করা উচিত।’ 

তবে সূক্ষ্ম দ্যোতনা ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন, এমন সব বিষয় নিয়ে লেখার জন্য যদি সাংবাদিক ও সংবাদ সংস্থাগুলো এই টুলের অপব্যবহার করে, তাহলে তা এ টুলের তো বটেই, সংশ্লিষ্ট সংবাদ সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলবে। বার্তাকক্ষে এআই টুল ব্যবহার করবে কি না, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে সংবাদ সংস্থাগুলো যখন টানাপড়েনে ভুগছে। এর মাঝেই গুগলের এই নতুন টুল উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেবে নিশ্চিতভাবে। দশকের পর দশক ধরে যেসব সাংবাদিক নিজেদের লেখা নিজেরাই লিখেছেন, তাদের মধ্যেও উদ্বেগ ছড়াবে এ টুল। এছাড়া বিজ্ঞাপন, কনটেন্ট তৈরি, টেকনিক্যাল রাইটিং, সাংবাদিকতার মতো চাকরিগুলো চ্যাটজিপিটির মতো প্রযুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এর কারণ হিসেবে, মাডগাভকার মনে করেন, এআই টুলগুলো টেক্সট ভিত্তিক ডেটা ভালোভাবে লিখতে, পড়তে এবং বুঝতে সক্ষম। 

তার মতে, বিশাল পরিমাণ তথ্য বোঝা ও বিশ্লেষণ করার কাজটি ভবিষ্যতে এআই খুব দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান নিউইয়র্ক টাইমসে তার কলামে লিখেছেন, রিপোর্টিং এবং রাইটিংয়ের মতো কাজগুলো ভবিষ্যতে মানুষের চেয়ে দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবে এআই। কিন্তু মাডগাভকার মনে করেন, কনটেন্ট নির্মাতাদের অধিকাংশ কাজই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব না। কারণ এসব কাজের প্রতিটিতেই প্রচুর বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যা শুধু মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব।

ঠিক একইভাবে সংবাদ মাধ্যমে এআইয়ের ব্যবহার যেমন কর্মীদের কাজকে অনেক সহজ করে দিচ্ছে, আবার এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদ পরিবেশন সংবাদ মাধ্যমগুলোকে ঝুঁকির মুখেও ফেলতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট সংবাদ মাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর কাজেও এআই প্রেজেন্টারকে ব্যবহার করতে পারে। সেখানে প্রেজেন্টারের জবাবদিহিতার কিছু থাকবে না। আর তাই সারা বিশ্বেই এআই প্রযুক্তি এখন স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আল জাজিরার সাংবাদিক খালেদ দিয়াবের মতে, ‘কর্ম ও চাকরির নিরাপত্তার ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলার পাশাপাশি, গণমাধ্যমে এআইয়ের আধিপত্য বিস্তারের সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবও রয়েছে। চ্যাটবট যে শুধু প্রচুর শক্তির অপচয় ঘটায় তা-ই নয়, এটা বিভ্রান্তিকরও বটে। চ্যাটবট কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানলে সেটা স্বীকার করার বদলে নিজে থেকে বানিয়ে বানিয়ে উত্তর দিয়ে দেয়।’ 

সংবাদ মাধ্যমগুলো যদি মিডিয়া এবং অন্যান্য ডোমেইনে এআই থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে চায়, তাহলে নৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রতিটি দিক শুরুতেই বিবেচনা করতে হবে। আর সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিচার করলে, ভবিষ্যতে সমাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ভূমিকা কী হবে- সেই সিদ্ধান্ত কিন্তু আমাদের সবার মিলেই নেওয়া উচিত, কারণ এআইয়ের প্রভাব আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই পড়বে।

এ ক্ষেত্রে অনেক দেশ তো বুঝতেই পারছে না এই পরিস্থিতির সঙ্গে তারা কীভাবে নিজেদের মানিয়ে নেবে। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আগামীতে পৃথিবীকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা নির্ভর করবে কোম্পানিগুলো এই প্রযুক্তি তৈরিতে কতটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়, তার ওপর। তারা বলছেন এ ধরনের প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং অপব্যবহার বন্ধে কর্তৃপক্ষকে আইনগত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি।


লেখক: কথাসাহিত্যিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh