প্রণব চক্রবর্তী
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩, ০১:৪৮ পিএম
প্রণব চক্রবর্তী। ফাইল ছবি
চাকরি অব্যাহত থাকাকালে যে কর্মহীন দিবসে বেতন ভাতাদি মেলে তা-ই ছুটি। ছুটি কর্মী ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদনশীলতা সংরক্ষণের বড় নিয়ামক। ছুটি অনুমোদন করিয়ে ভোগ করতে হয়। কিন্তু এই অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি পেটি বসের দপ্তর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় উচ্চ পর্যায় যেখানেই হোক না কেন তা অধিকাংশ সময়ে জটিলতার আবর্তে ডুবে থাকে। ফলে ছুটি ভোগেচ্ছুরা পুরোদমে ছোটাছুটি করতে থাকেন ছুটির অনুমোদনের নাগাল পেতে। সময় বদলেছে। আধুনিক ব্যবস্থাপনায় ছুটিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ নেই। বরং গণস্বার্থে একে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার সংস্কৃতি চালু হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে এন্তার ছুটি রয়েছে মর্মে অনেকের অভিমত। কট্টর সমালোচকদের মতে সরকারি কর্মচারীরা বছরের প্রায় অর্ধেক দিন অর্থাৎ ৬ মাস ছুটিতে কাটান। ছুটি অর্থ ফাঁকি দেওয়া নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিজের লক্ষ্য বা প্রয়োজনীয়তা পূরণে অবকাশ গ্রহণ। মানুষ যেহেতু যন্ত্র নয় তাই তার বিশ্রাম ও বিনোদনের দরকার রয়েছে। এখানেই ছুটির কদর।
এটি ধ্রুব সত্য যে, প্রতিষ্ঠানে সকল কর্মীর জন্যই ছুটি ও অবকাশের প্রয়োজন রয়েছে। এর মাধ্যমে কর্মীর পরিবার ও সামাজিক যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টিরও আবশ্যকতা রয়েছে। কর্মী ব্যবস্থাপনার নিরিখেই এটি প্রয়োজন। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের উৎসাহিত করার জন্য আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা আছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছি। উন্নত দেশের পর্যায়ে যেতে আমাদের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। এজন্য কর্মী প্রণোদনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে এখনই। জটিল জীবনযাত্রায় বাঙালিরা উৎসব আয়োজন ও উপভোগে দলবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। ২০২৩ সালে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ৩ দিনের পরিবর্তে ৪ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা হয়েছিল। সরকারি ছুটি আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অসরকারি সংস্থাগুলোও অনুসরণ করে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ছুটি নির্ধারণ সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অনুরূপ ছুটি সরকারি-অসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য নির্ধারণে সহায়ক। এই বর্ধিত ছুটির উপযোগিতাও সবার নজরে এসেছে। অন্যান্য বারের চেয়ে এ বছর তুলনামূলক নির্ঝঞ্ঝাটে পরিবার-পরিজন নিয়ে যাতায়াত সম্ভব হয়েছে। দুর্ঘটনাও তাই দুটি ছুটিতেই আনুপাতিক হারে কম হয়েছে। কর্মীদের ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
সাপ্তাহিক ছুটি বাড়িয়ে কর্মদক্ষতা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছে আইসল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠান। এতে কর্মীদের সুস্থ থাকার হার ও উন্নত জীবনমানে বড় পরিবর্তন দেখা যায়। কর্মোৎপাদনশীলতা বাড়াতে যুক্তরাজ্যে সপ্তাহে তিন দিন ছুটি চালু করেছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিকভাবে দেশটির ৭০টি প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৩০০ কর্মী আগামী ছয় মাস এ সুবিধা পাবেন। তবে এর জন্য আগের মতোই শতভাগ বেতন পাবেন তারা। ব্যাংক, স্বাস্থ্য, আর্থিক পরিষেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ ও দোকানের কর্মীরাও রয়েছেন এই তালিকায়। কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে অলাভজনক কমিউনিটি ফোর ডে উইক গ্লোবাল ও ফোর ডে উইক ইউকে এই ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে।
১৯৩৬ সালে ফ্রান্স সরকার নিয়ম করে যে, সব ফরাসির প্রতিবছর সবেতন ছুটির সুযোগ দেওয়া হবে। বর্তমানে ফ্রান্সের সবেতন ছুটির সময় প্রতিবছর ৫ সপ্তাহ অর্থাৎ এক মাসেরও বেশি। কিন্তু ফরাসিরা মনে করে মাত্র ৫ সপ্তাহ ছুটি উপভোগের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত নয়। তাই ফ্রান্স সরকার আরও নিয়ম নির্ধারণ করে যে প্রতি সপ্তাহের কর্ম সময় ৪০ ঘণ্টার বেশি হবে না। যদিও সমালোচকদের মতে ফরাসিরা যে সব সময় ছুটি পাওয়াকে তাদের একটি বিশেষ অধিকার হিসেবে দেখে থাকেন সেটা হরতাল সম্পর্কে তাদের অনুরাগ থেকেই বুঝতে পারা যায়। কেননা হরতাল যতটা রাজনৈতিক তার চেয়ে বেশি ছুটি নিশ্চিত করাই উদ্দেশ্য।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) তার সব সদস্য দেশকে প্রতিবছর কর্মীকে অন্তত ৪ সপ্তাহ, মানে এক মাস সবেতনে ছুটি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। স্থায়ী কর্মী অথবা অস্থায়ী কর্মী সবাই এর আওতাভুক্ত হবে। এভাবেই ইউরোপে সবার ছুটির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইইউ আরও নিয়ম করেছে যে, প্রত্যেকে তার কর্মের প্রথম বছর থেকেই সবেতন ছুটির অধিকার পাবে। তবে সামান্য একটি পূর্বশর্ত হলো কর্মের মাত্র ৩ মাসের পর থেকেই এমন অধিকার ভোগ করতে পারবে।
ছুটি কাটানো হল কানাডায় জনগণের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তাদের জীবনে ছুটি উপভোগ করা খাওয়া, ঘুমানো, গাড়ি কেনা, বাড়িঘর কেনা আর কাজ করার মতোই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কানাডার কর্মীদের জন্য সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও আরও ১০ থেকে ১২টি সরকারি ছুটি যা সোমবারে বা শুক্রবারে নির্ধারণ করা আছে। অর্থাৎ কেউ চাইলে সপ্তাহের দুই দিন ছুটির সঙ্গে একত্রে যুক্ত করে একটি লম্বা ছুটি উপভোগ করতে পারেন। অথবা বরাদ্দকৃত সব ছুটি একসঙ্গে নিয়ে একটি লম্বা ছুটি যা ২০ দিনের মতো হবে, এই ছুটি নিয়ে বিশ্বের যে কোনো দেশের সুন্দর জায়গায় ভ্রমণে যেতে পারেন। সুইডেনে যারা স্বেচ্ছায় ১২ মাসের লম্বা ছুটি কাটাতে চায়, তাদের কোনো প্রকার আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত হওয়া বা দণ্ড ভোগ করতে হয় না। উল্টো তারা ৮৫ শতাংশের মতো বেকারত্ব বীমা পেয়ে থাকেন। বিশ্ববাজারের অর্থনীতিতে ভালো অবস্থান তৈরি করতে সাপ্তাহিক ছুটি ও কর্মদিবসে পরিবর্তন এনেছে আরব আমিরাত। নতুন কর্মদিবস শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সোমবারকে যুক্ত করেছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। আগে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল শুক্র ও শনিবার। এখন তা পরিবর্তন করে শনি ও রবিবার করা হয়েছে। খবরে আরও বলা হয়, নতুন কর্মদিবস অনুসারে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়। এরপর জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। সপ্তাহের বাকি তিন দিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়। এ তালিকায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও মরক্কোর মতো দেশও আছে। আরও আগেই এসব দেশে শনিবার ও রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন চালু করা হয়। উদ্দেশ্য কিছুই না আধুনিক বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত থাকা।
আমিরাতের বার্তা সংস্থা জানায়, সাপ্তাহিক ছুটির মূল উদ্দেশ্য কর্মীর উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, কর্মজীবনের ভারসাম্য উন্নত করা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য, অর্থব্যবস্থা ও লেনদেনে নতুন কর্মদিবস তৈরি করা।
জাপানে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সাপ্তাহিক কর্মদিবস পাঁচ দিন থেকে কমিয়ে ৪ দিনে আনার প্রস্তাব দিয়েছে দেশটির সরকার। এটি কার্যকর হলে টানা ৩ দিন সাপ্তাহিক ছুটির সুবিধা পাবেন জাপানের মানুষ। পরিকল্পনায় বলা হয়, কর্মঘণ্টা কমলে একই সঙ্গে স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের বাড়তি সময় দিতে পারেন কর্মীরা। এতে মানসিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকেন তারা। এতে আরও বলা হয়, বাড়তি অবসর সময় পাওয়ায় শিক্ষা ও অন্যান্য দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন তারা।
প্রেম করতে তিরিশের কোঠার অবিবাহিত নারী কর্মীদের ১৫ দিনের ছুটি দিচ্ছে চীনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। উল্লেখ্য, নতুন চান্দ্রবর্ষ উদযাপন করতে এক সপ্তাহ ছুটি পেতে যাচ্ছে চীনের কোটি কোটি চাকরিজীবী। তবে তাদের অনেকেই সাত দিনের নিয়মিত ছুটির সঙ্গে বাড়তি আট দিনের ছুটি পাচ্ছেন। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, চীনের পূর্বাঞ্চলের হাংঝু শহরের দুটি কোম্পানি তাদের কর্মচারীদের এ অতিরিক্ত ছুটি দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে চীনা সরকারও বেশ উদ্বিগ্ন। তাই বেশি শিশু জন্মদানের মাধ্যমে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নারীদের বিয়েতে উদ্বুদ্ধ করছে দেশটির সরকার।
প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের দেড় কোটিরও অধিক জনসংখ্যার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গা পূজা নিয়ে। দুর্গা পূজা আনুষ্ঠানিকভাবে চার দিনের। সপ্তমীতে শুরু হয়ে দশমী পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি। বাঙালি হিন্দুর জন্য এই বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সরকারি ছুটি মাত্র ১ দিন অর্থাৎ দশমীর দিন মাত্র। ফলে এই বড় উৎসবে ছুটি লাভের টানাপড়েনে উৎসবের আমেজ নষ্ট হয়ে যায়। এই উৎসব উপলক্ষে অন্তত ২ দিন ছুটি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে শুধু নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীর জন্য প্রযোজ্য দিনে সাধারণ সরকারি ছুটি ঘোষণারও নজির রয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী কর্মজীবীদের জন্য সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত ‘অসাধারণ সরকারি ছুটি’ ঘোষণার কথাও বিবেচনা করা যেতে পারে। এর ফলে সাধারণ কর্মপ্রবাহ বিঘ্নিত না করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে পালনে সক্ষম হবেন। একইভাবে বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের বড় উৎসবে ঐ ধর্মাবলম্বীদের জন্য অনুরূপ অসাধারণ ছুটি ঘোষণার বিষয়টি বিবেচনাভুক্ত হতে পারে।
ছুটি যদিও অধিকার নয় কিন্তু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির এটি প্রতিষ্ঠিত শর্ত। অতিরিক্ত কোনো ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে যদি ছুটি অনুমোদন করার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব হয় তবে তা থেকে পিছিয়ে আসা যৌক্তিক হতে পারে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক