যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার ত্রিপাক্ষিকতা কি স্থায়ী হবে

অনিন্দ্য আরিফ

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩১ এএম

জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা। ছবি: সংগৃহীত

জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্প ডেভিডে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে বিদ্যমান সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছেন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়ল ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাকে নিয়ে এ শীর্ষ বৈঠকের আয়োজন করে বাইডেন প্রশাসন। চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির মুখে ঐক্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। 

এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে একটি ত্রিপাক্ষিক প্রাতিষ্ঠানিকতা জোরদার হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে চীনের সঙ্গে ক্রমাগত বর্ধমান দ্বন্দ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাইডেন প্রশাসন তার সমমনা মিত্র এবং অংশীদারদের সঙ্গে নতুন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক যৌথতা গড়ে তুলছে। প্রথমত অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানকে নিয়ে কোয়াড্রল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ গড়ে তোলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাবমেরিন শক্তিবৃদ্ধি এবং সামরিক প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার জন্য অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র মিলে অইইউকেইউস নামক জোটও গঠিত হয়েছে। এবার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একই ধরনের সমান্তরাল নিরাপত্তা বলয় তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলো।

এই শীর্ষ সম্মেলনের দেওয়া বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এই তিন দেশ সংকটের সময় পরস্পরের সঙ্গে দ্রুত পরামর্শ করতে এবং পরস্পরের স্বার্থের ক্ষতি করে এমন আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ, উসকানি ও হুমকির ক্ষেত্রে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া দেখানোর বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। তারা প্রতিবছর সামরিক প্রশিক্ষণের মহড়ার আয়োজন এবং ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের প্রকৃত সময় সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি করতে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে দেশগুলো।

তারা প্রতিবছর সামরিক প্রশিক্ষণের মহড়ার আয়োজন এবং ২০২৩-এর শেষ নাগাদ উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের প্রকৃত সময় সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগি করতে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি দেশগুলো ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার দীর্ঘদিন ধরে চলা ঐতিহাসিক বৈরিতা কাটানোর জন্য অবশ্য বাইডেন প্রশাসনকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তর কোরিয়ার উত্তেজক ভূমিকার জন্য এই দুটি দেশের উদ্বেগই বৈরিতা সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন আঞ্চলিক মেরুকরণের রাস্তা তৈরি করেছে। এমনিতে ২০২২ সালের মার্চের নির্বাচনে বিজয় লাভ করে রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী হান ডাক সু জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন। সেই উদ্দেশ্যে একই বছরের নভেম্বরে কম্বোডিয়ার পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং প্রধানমন্ত্রী কিশিদা যৌথ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার বিবৃতি দেন। এই সুযোগে প্রেসিডেন্ট ইয়ুন জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত দক্ষিণ কোরীয়দের জন্য একটি আর্থিক ক্ষতিপূরণের পরিকল্পনা পেশ করেন। এই উদ্যোগের ফলে এই দুই দেশের সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হতে থাকে। 

এখানে বিবেচনার বিষয় রয়েছে যে, ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন দশক কোরিয়ায় কঠোর ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ চালিয়েছিল জাপান। দূর প্রাচ্যের দেশ দুটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। ফলে সেই তিক্ত ইতিহাস এখনো প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে ‘সম্পর্ক উন্নয়নে’ প্রধান বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। তাই প্রশ্ন রয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় যদি প্রগতিশীল প্রশাসন পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে তাহলে এই ত্রিপাক্ষিকতা টিকে থাকবে কি না? আবার আগামী বছরের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদি ডেমোক্র্যাটদের পরাজয় ঘটে, তখন এই ত্রিপাক্ষিকতা টিকে থাকবে কি না সেটা নিয়েও সন্দিহান রয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

এই তিন দেশের ত্রিপাক্ষিকতার অবস্থানকে অবশ্য ভালো চোখে দেখছে না চীন। দেশটির গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা এই ত্রিপাক্ষিক নিরাপত্তা যৌথতাকে ‘ক্ষুদ্র ন্যাটো’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আবার চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিনহুয়া জানাচ্ছে, ‘মার্কিন নির্দেশনায় সংগঠিত হয়ে এই তিন দেশ একটি আবদ্ধ ও একচেটিয়া ভূ-রাজনৈতিক গোষ্ঠী গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই ধরনের কৌশল অনিবার্যভাবেই শত্রুতার শিখাকে বিস্তৃত করার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের কৌশলগত নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ন করবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও বিপদগ্রস্ত করবে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ওয়াশিংটনের তথাকথিত নিরাপত্তা সহযোগিতা দেশ দুটিকে নিরাপদ রাখতে সক্ষম হবে না, বরং তাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে।’

এই সম্মেলনের এক দিন আগে পূর্ব চীন সাগর ও জাপান সাগরে রাশিয়া ও চীনের নৌবাহিনী যৌথ মহড়া চালায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য জানাচ্ছে, ডেস্ট্রয়ারসহ চীনের ছয়টি জাহাজ, একাধিক ডেস্ট্রয়ারসহ রাশিয়ার পাঁচটি জাহাজ জাপানের ওয়াকিনাওয়া ও মিয়াকো দ্বীপের ভেতর দিয়ে গত ১৭ আগস্ট পূর্ব চীন সাগরের দিকে অগ্রসর হয়। এই প্রথম রাশিয়া ও চীনের যুদ্ধজাহাজ একসঙ্গে বিশেষ এই জলসীমা দিয়ে চলাচল করল। অবশ্য এসব জাহাজ জাপানের আঞ্চলিক জলসীমায় প্রবেশ করেনি। জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, জাপানের সবচেয়ে দক্ষিণের দ্বীপ ওকিনোতরির ২৮০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে স্থানীয় সময় গত ১৫ আগস্ট সকালে প্রথম ওই ১১টি জাহাজ নজরে আসে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন এবং উত্তর কোরিয়ার শাসন কাঠামোতে পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় এই দুই দেশের ভূমিকা এবং মিত্রতা একই রকম থাকবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার শাসন কাঠামোতে পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নির্বাচনের এই ত্রিপাক্ষিকতার বিরুদ্ধ পক্ষের জয়লাভের সম্ভাবনা আছে। তখন কি এই যৌথতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে? সেটা সময়ই বলে দিতে পারে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh