আল-জাজিরা বিশ্লেষণ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:২৯ পিএম | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:২৯ পিএম
ছবি: রয়টার্স
সম্প্রতি আইফোন ১৫ বাজারে এসেছে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনাও পরলিওক্ষিত হচ্ছে। আর সবাই মুখিয়ে আছে কবে কখন বিশ্বের অন্যতম এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত এই ফোনটি কিনে আত্মার তৃপ্তি ঘটাবেন। অথচ ঠিক এমন সময়েই অর্থনীতিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ চীনের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আইফোন১৫ ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। আর এ নিয়েই আল-জাজিরা তাদের একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে। চলুন দেখে আসা যাক আল-জাজিরার বিশ্লেষণে চীন সরকারের এমন সিদ্ধান্তের নেপথ্যে আসলে কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে!
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আইফোন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।
গত বৃহস্পতিবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের অ্যাপলের ডিভাইস ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নির্দেশনা জারি করেছে শি জিনপিং সরকার। ঠিক এরপরদিন শুক্রবার ব্লুমবার্গ তাদের প্রতিবেদনে দাবি করে, এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে সরকার-সমর্থিত সংস্থাসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সকল সংস্থা। ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত সকল সংস্থার জন্যই পর্যায়ক্রমে এমন নিষেধাজ্ঞা আসছে।
আর চীনের এমন পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের চলমান বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত যুদ্ধের সর্বশেষ ‘তোপধ্বনি’ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
এরই মধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যাপলের নতুন পণ্য আইফোন ১৫সহ অন্যান্য পণ্যের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান আয়োজন করে মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাপল।
কেন এই সময়েই নিষিদ্ধ হলো আইফোন
অ্যাপলের জন্য নিতান্তই খবরটা বেশ মন্দ। আর পশ্চিমা প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটি অশুভ লক্ষণ। তবে এমন নিষেধাজ্ঞার খবরটি চীনের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখা পর্যবেক্ষকদের মোটেও অবাক করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশ একে অপরের কাছ হতে অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কেননা উভয় পক্ষই বিনিয়োগ ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে তথাকথিত জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশকেই দিন দিন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
বেইজিং বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা হ্রাসের পাশাপাশি সেনজেন-ভিত্তিক হুয়াওয়েসহ দেশীয় সংস্থাগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বেশ জোর দিচ্ছে। হুয়াওয়ের নতুন ১ হাজার ২০০ ডলারের ‘মেট ৬০ প্রো’কে প্রযুক্তি-বিশ্লেষকেরা অনেকটাই এগিয়ে রেখেছেন। আর আইফোনের সঙ্গে নতুন এই গেজেটের দৌড়কে অবশ্য অগ্রাহ্যের উপায় নেই।
তবে মেট ৬০ প্রো-এর বাজারে আসার সময় আইফোনকে নিষিদ্ধের সময় কাকতালিয়ভাবে মিলে যাওয়ায় এটিকে ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ বলে মন্তব্য করেছে ব্যাংক অব আমেরিকা।
এদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের দেশের প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সুরক্ষার বিষয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথাও জানিয়ে আসছে। তাদের আশঙ্কা, স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল ডেটা হাতিয়ে নেওয়াসহ সরকারি অবকাঠামোতে হস্তক্ষেপের ঘটনার আভাস রয়েছে।
এর আগে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম অঙ্গরাজ্য হিসেবে মন্টানায় চীনের মালিকানাধীন টিকটক নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় আস্থাহীনতা থেকেই তারা এমন পদক্ষেপ নেয়। প্রে আরও কয়েকটি অঙ্গরাজ্য একই পথে হাঁটে।
হুয়াওয়েসহ চীনা অনেক প্রযুক্তি সংস্থার সঙ্গে মার্কিন সংস্থাগুলোর ব্যবসার দ্বারও বন্ধ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন। একই সঙ্গে মার্কিন চিপ নির্মাতা কোম্পানিগুলোকে চীনের কাছে উন্নতর প্রযুক্তি বিক্রিতেও করেছে বেশ কড়াকড়ি।
আর তাই কিরিন ৯০০০এস প্রসেসর চালিত মেট ৬০ প্রোর বাজারে আনার বিষয়টি এসব রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা নিয়ে তুলেছে প্রশ্ন ।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেন, আইন লঙ্ঘন হয়েছে কী না সেটি নির্ধারণে স্মার্টফোনটির ‘বৈশিষ্ট্য ও গঠন’ সম্পর্কে আরও তথ্য খতিয়ে দেখছে বাইডেন প্রশাসন।
অ্যাপল ও অন্যান্য পশ্চিমা প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের জন্য এমন নিষিদ্ধ কী বার্তা দিচ্ছে?
জানা গেছে, অ্যাপলের স্টক মূল্য গত বুধবার থেকে শুক্রবারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে বিশ্বের অন্যতম জায়ান্ট টেক প্রতিষ্ঠানটির খোয়া গেছে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার।
তবে এটি একটি চীনে পরিচালিত পশ্চিমা সংস্থাগুলোকে হয়ত একটি ‘শীতল বার্তা’ দিল।
এর আগে কিছু চীনা কর্মকর্তা বলেছিলেন যে কোভিড-১৯ মহামারির পর ব্যবসার জন্য আবারও চীন উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু মিন্টজ গ্রুপসহ বিদেশি সংস্থাগুলোতে পুলিশের অভিযান ও সম্প্রতি গুপ্তচরবৃত্তিবিরোধী আইন প্রণয়নের পর থেকে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়াসহ তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই প্রতিবন্ধকতা তোইরি হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনামিশ্রিত নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি বর্তমানে বিদেশি সংস্থাগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও মহামারির কারণে লোকসান, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি, দেশীয় প্রতিযোগীদের প্রতি সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণসহ নানাবিধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো তো রয়েছেই।
অথচ যেখানে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপলের সঙ্গে এত দিন পর্যন্ত বেইজিংয়ের সম্পর্ক তুলনামূলক ভালোই ছিল, এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির ওপর আরোপ করা সর্বশেষ বিধিনিষেধ চীনে ব্যবসার বিষয়ে সংশয়ের মাত্রা বাড়িয়ে তুলল।
উল্লেখ্য, অ্যাপল বিশ্বব্যাপী যত পণ্য বিক্রি করে, তার প্রায় ২০ শতাংশই চীনে উৎপন্ন হয়ে থাকে। বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণের (যেমন ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক-ভিপিএন সরিয়ে ফেলা) দাবি মেনে নিয়েও তারা এত দিন ফুরফুরে মেজাজেই ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। গত মার্চে অ্যাপলের সিইও টিম কুক বেইজিংয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দেখাও করেন।
জনপ্রিয় নিউজলেটার সিনোসিজমের লেখক বিল বিশপ গত শুক্রবার বলেন, ‘অনেকেরই বিশ্বাস ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনাকে অ্যাপল একধরনের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।’
চীনে আইফোন নিষেধাজ্ঞার অর্থ কী?
এমন নিষেধাজ্ঞা চীনা নাগরিকদের জন্য সদ্য বাজারে আসা আইফোন ১৫সহ অ্যাপলের অন্যান্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এর মধ্যেই অ্যাপল চীন থেকে উৎপাদন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াসহ বিনিয়োগ তুলে নেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়েছে। আর সর্বশেষ এই নিষেধাজ্ঞা ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী এ প্রবণতাকে আরও বেগবান করতে পারে।
মার্কিন বাণিজ্যসচিব জিনা রাইমন্ডো গত মাসে বলেন, ক্রমবর্ধমান প্রতিকূল ব্যবসায়িক পরিবেশগত কারণে চীনকে ‘বিনিয়োগ অযোগ্য’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে বিদেশি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো।
এমনিতেই কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি, রপ্তানি খাতে ধীরগতি, আবাসন ব্যবসায় সংকটসহ তরুণদের মধ্যে উচ্চমাত্রায় বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় বেশ সঙ্কটে রয়েছে চীন। আর এরই মধ্যে এমন ‘তিক্ত অবস্থা’র ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জগুলো আরও কঠিন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।