নাহিদা আশরাফী
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:১৩ পিএম
মুন্নী বেগম।
নবাব সাহামৎ জং (নওয়াজিশ মহম্মদ) তার পোষ্যপুত্র ইকরামুদ্দৌলার (সিরাজউদ্দৌলার ছোট ভাই) বিয়ে উপলক্ষে নৃত্যগীতের জন্য শাজহানাবাদ থেকে ১০ হাজার রুপিতে বিশু বেগ ও তার নর্তকী সম্প্রদায়কে মুর্শিদাবাদে ডেকে আনেন। এই নর্তকীদের মধ্যে একজন ছিল বালিকা মুন্নী। দারিদ্র্যের কঠোর পীড়নে যার মা তাকে মাত্র বিক্রি করে দিয়েছিল সাম্মেন আলি খানের ক্রীতদাসী বিশুর কাছে। এই বিশুর কাছে নাচ শিখেই মুন্নীর নৃত্যপ্রতিভা ও সৌন্দর্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে।
উৎসব শেষে নবাবের অনুরোধে দলের লোকদের সেখানে আরও কিছুদিন অবস্থান করতে হয়। এর পর নবাব তাদের বিদায় দিলে তারা কিছুদিনের জন্য ওই নগরেই অবস্থান করতে থাকে।
গুণমুগ্ধ মীর জাফর মুন্নীর নৃত্যগীতের এতই ভক্ত হয়েছিলেন যে, প্রতিদিনই তিনি তার ঘরে একবার করে যেতেন। ক্রমাগত যাতায়াতে তিনি তার প্রতি এতদূর আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যে, মাসিক ৫০০ রুপি বেতনে আরও কিছুদিন তাকে সেখানে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। মুন্নীও রাজি হলেন। মীর জাফর তাকে নিয়ে গেলেন নিজ হেরেমে। কিছুদিন পর মীর জাফর তাকে ভার্যারূপে গ্রহণ করলেন।
এই সময় থেকেই মুন্নী বিবি মুন্নী বেগম নামে খ্যাত হন ও তাকে বাল্যের সঙ্গিনীদের সঙ্গে সকল সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করতে হয়। স্বাধীনতাপ্রিয় যূথভ্রষ্ট বন্য হরিণীকেও প্রেমের মোহন ফাঁসে আবদ্ধ হতে হয়, নর্তকী মুন্নীকেও পর্দানশীন হয়ে নবাবের অন্তঃপুরে বাস করতে হয়েছিল। মুন্নী বেগমের গর্ভে নিজামুদ্দৌলা ও সৈয়ফুদ্দৌলা এবং বব্বু বেগমের গর্ভে মোবারক উদ্দৌলার জন্ম হয়। উত্তরকালে বুদ্ধিমত্তা ও আন্তরিক প্রণয়ের জন্য মুন্নী বেগমই মীর জাফরের প্রধান বেগম হয়ে ওঠেন। তিনিই মীর জাফরের কাছে সর্বাপেক্ষা আদরের পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। কথিত আছে- মুন্নীর প্রগাঢ় চিন্তা ও প্রভাবিত করার দারুণ দক্ষতার কারণে মীর জাফরের বৈধ পত্নী শাহ খানমও ঢাকা পড়ে যান। সিরাজের হিরাঝিলের প্রাসাদ থেকে মীর জাফর যে সমস্ত রত্নরাজি গোপনে আত্মসাৎ করেছিলেন, মুন্নী বেগমই উত্তরকালে সেসবের অধিকারিণী হন।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মীর জাফরের মৃত্যু হলে ১৫ বছর বয়সী নিজামুদ্দৌলাই মসনদপ্রাপ্ত হন। এই মসনদপ্রাপ্তিতেও মুন্নী বেগমের পরোক্ষ প্রভাব ছিল। মীর জাফরের একমাত্র বৈধ সন্তান মিরনের দাবিও কলকাতা কাউন্সিল নাকচ করে দেয়। এই সময়কালে মীর জাফরের রেখে যাওয়া ৫ লাখ রুপি রবার্ট ক্লাইভের হাতে তুলে দেন মুন্নী বেগম। সমুদয় অর্থ একটি ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীদের ও সাধারণের কল্যাণে ব্যয় করা হতো।
১৭৬৬ সালে বিষম জ্বরে প্রাণত্যাগ করেন নিজামুদ্দৌলা। তার মৃত্যুর পর তার ১৬ বছর বয়সী ভাই সৈয়ফুদ্দৌলা ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বাংলার মসনদে আসীন হন। তার সময়ে মা মুন্নী বেগমের হাতে সমস্ত কর্তৃত্বের ভার অর্পণ করা হয়। সৈয়ফুদ্দৌলা নাবালক বলে মুন্নী বেগম অভিভাবকরূপে রাজকার্য নির্বাহ করতেন। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে মন্বন্তরের বর্ষে বসন্তরোগে সৈয়ফুদ্দৌলার মৃত্যু হয়।
সৈয়ফুদ্দৌলার মৃত্যুর পর মীর জাফরের অন্যতম ভার্যা বব্বু বেগমের ১২ বছর বয়সী পুত্র মোবারক-উদ্দৌলা নবাব হন; কিন্তু রেজা খাঁর অপরিনামদর্শিতার কারণে বিমাতা মুন্নী বেগম নবাবের অভিভাবিকা নিযুক্ত হয়ে রাজকার্য পরিদর্শন করতে লাগলেন। মুন্নী বেগমের কৌশলে কলকাতার কাউন্সিল নন্দকুমারের ২২ বছর বয়সী পুত্র গুরুদাসকে ‘রাজা গৌরপৎ’ উপাধি দিয়ে দেওয়ান ও হিসাবরক্ষকের পদে নিযুক্ত করেছিলেন।
মোবারকের মা বব্বু বেগমের পরিবর্তে বিমাতা মুন্নী বেগম কেন যে অভিভাবিকা নিযুক্ত হয়েছিলেন, তার কোনো সন্তোষজনক কারণ জানা নেই; তবে এটুকু জানতে পারা যায় যে, বব্বু বেগম নিজ পুত্রের অভিভাবিকা নিযুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন; কিন্তু গভর্নর হেস্টিংস তার আবেদন অগ্রাহ্য করে মুন্নী বেগমকে ওই পদের উপযুক্ত স্থির করলেন।
কাজের সুবিধার জন্য মুন্নী বেগম রাজা গুরুদাসের অধীনে ইৎবর আলি খাঁ নামক একজন খোজাকে নিযুক্ত করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে ইৎবর আলিই নায়েব পদে প্রতিষ্ঠিত হলেন। তিনি অতিশয় নির্বোধ ও নীচমনা ছিলেন। পদগর্বে গর্বিত ইৎবর সম্ভ্রান্ত লোকদের নির্যাতিত করে রাজ্যে অশান্তি আনয়ন করেছিলেন। মুন্নী বেগম এই নির্বোধ, শাসনকাজে অনভিজ্ঞ খোজার প্রতি কৃপাপরবশ হওয়ায় অনেকেরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন।
গভর্নর হেস্টিংস মোবারকের ২৪ লাখ রুপি বৃত্তির পরিবর্তে ১৬ লাখ রুপি ধার্য করেছিলেন এবং বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ওই টাকার ব্যয়ভার মুন্নী বেগমের হাতে দিয়েছিলেন। মুন্নী বেগম ওই টাকা নিম্নলিখিত খাতে ব্যয় করতেন।
১. নবাবের বিলাসিতা, সাংসারিক খরচ ও সামরিক ব্যয় নির্বাহ।
২. মীর জাফরের আত্মীয়স্বজন ও তার রক্ষিতাদের বৃত্তি।
৩. আলিবর্দির বংশধরদের বৃত্তি।
৪. পূর্ববর্তী নবাব-নাজিমদের অনুগ্রহভাজন কয়েকজন উপযুক্ত লোকের বৃত্তি।
প্রায় দুই বছরকাল বিচারের পর রেজা খাঁ নিষ্কৃতি পেয়ে তার পূর্বপদে প্রতিষ্ঠিত হলেন। মুন্নী বেগমকে বার্ষিক ১ লাখ রুপি বৃত্তি দিয়ে পদচ্যুত করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে গুরুদাসও অপসৃত হলেন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে মোবারকের মৃত্যু হয়।
মুন্নী বেগমের কার্যকালের হিসাব-নিকাশের সময় তহবিলে অনেক টাকা কম পড়ায় তিনি বলেন- গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস ও তার কর্মচারীদের আমোদে ওই টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুন্নী বেগমকে অতিশয় সম্মানের চোখে দেখত। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মুন্নী বেগমের মৃত্যু হলে তার সম্মানার্থে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে তার বয়স সংখ্যা অনুসারে ৯০টি তোপধ্বনি করার আদেশ দিয়েছিলেন। জাফরগঞ্জ সমাধিভবনে নবাব-নাজিমদের সমাধির উত্তরে একটি প্রাচীরবেষ্টিত স্থানে মুন্নী বেগম সমাহিত হন।
মুন্নী বেগমের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি নিয়ে অনেক গোলযোগ উপস্থিত হয়েছিল। কয়েকটি পত্রে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
এক সময়ে প্রাতঃস্মরণীয়া রানী ভবানী মুন্নী বেগমকে একটা পালকি, ৩০ জন বাহক এবং তাদের ভরণপোষণের জন্য জমি উপঢৌকন দিয়েছিলেন। এই জমি আজ পর্যন্ত নিজামতভুক্ত আছে।
মুন্নী বেগম মাসিক ১২ হাজার রুপি ও বব্বু বেগম ৮ হাজার রুপি বৃত্তি পেতেন। মুর্শিদাবাদ শহরে যে চক মসজিদ আজ পর্যন্ত বিদ্যমান আছে, তা মুন্নী বেগমেরই কীর্তি। তিনি ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মুন্নী বেগম জাঁকজমকপূর্ণ জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। সেকালে পরদুঃখকাতর রানী ভবানী ছাড়া তার মতো দানশীল নারী কেউ ছিলেন না বললে অত্যুক্তি হয় না। এই দানশীলতার জন্য সকলে তাকে ‘মাদার-ই-কোম্পানি’ অর্থাৎ ‘কোম্পানির মাতা’ নামে অভিহিত করত। স্নেহময়ী জননীর আখ্যায় আখ্যায়িত হওয়া যে কম সৌভাগ্যের কথা নয়- এ কথা বলাই বাহুল্য।
নবাব-নাজিমদের প্রধান মহিয়ষীকে ‘গদিনসীন’ বেগম বলে। গদিনসীন বেগমেরা বার্ষিক লক্ষ টাকা বৃত্তি পেতেন। মুন্নী বেগম এই বৃত্তির সমস্ত টাকা দানাদি ও পুণ্যের কাজে ব্যয় করতেন।
একসময় তার একজন সামান্য দাসী কিছু টাকার অভাববশত নিজ মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিলেন না। এ কথা কোনোরূপে তার কানে গেল। তিনি এ কথা শোনামাত্র ওই দাসীকে ৭০-৮০টি মোহর ও অন্য আবশ্যক দ্রব্যাদি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি মুতাক্ষরীণে বিশেষরূপে বর্ণিত আছে। মুতাক্ষরীণ- অনুবাদক গোলাম হোসেন এই সময়ে মুর্শিদাবাদে ছিলেন। তার সমক্ষেই এই ঘটনা ঘটেছিল।
সামান্য বংশে জন্মগ্রহণ করে, স্বীয় স্বাধীন সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে কেমন করে একজন অবলা নারী আপনার চতুর্পার্শ্বে প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারে, মীর জাফর-বণিতা মুন্নী বেগম তার প্রকৃষ্ট ও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। সেলে নবাবের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা গোপনে কলকাতা কাউন্সিলের সদস্য ও অন্য সম্ভ্রান্ত ইংরেজদের সঙ্গে পরামর্শ করে, আপনাপন ক্ষমতা ও প্রাধান্য বৃদ্ধি করার জন্য সতত যত্নপর ছিলেন। বুদ্ধিমতী মুন্নী বেগম তার নিয়োজিত গুপ্তচরের সাহায্যে ও অধিকাংশ স্থলে তার ইংরেজ বন্ধুদের কাছ থেকে পূর্বাহ্নেই সে সমাচার অবগত হয়ে উদ্ধত প্রকৃতির কর্মচারীকে সদয় ব্যবহারে তাদের অভীষ্ট পথে অগ্রসর হতে দিতেন না। তার মধুর প্রকৃতিগুণে সেসব কর্মচারীই তার প্রধান সহায় হয়ে উঠতেন। মুন্নী বেগম প্রভুত্ব ও বিপুল ধনসম্পত্তির অধিকারিণী হয়ে দানাদি ও পুণ্যকাজে মুক্ত হাতে অর্থ ব্যয় করে, আত্মীয়-স্বজন এবং অধীন কর্মচারী ও ভৃত্যদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে সতত দৃষ্টি রেখে অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন।