আজ বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস

কমেছে মৃত্যুহার, বিনামূল্যে টিকা পেয়েছে সাড়ে চার লাখের বেশি

তাসকিনা ইয়াসমিন

প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:২৭ পিএম

মানুষের পাশাপাশি ব্যাপকহারে কুকুরের টিকাদানের জলাতঙ্ক রোগের প্রবণতার হ্রাসের চিত্র। তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মানুষের পাশাপাশি ব্যাপকহারে কুকুরের টিকাদানের জলাতঙ্ক রোগের প্রবণতার হ্রাসের চিত্র। তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

গত বছর প্রাণির কামড়-আঁচড়ে আক্রান্ত প্রায় সাড়ে চার লাখেরও বেশি রোগীকে সরকার বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা প্রদান করেছে। এতে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে ২০১০ সালের পূর্বে জলাতঙ্ক রোগে ২০০০ এর অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করতো যা ২০২৩ সালের জুন মাসে কমে মৃত্যুর সংখ্যা দাড়িয়েছে মাত্র ২৭।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘রাবিস অল ফর ওয়ান, ওয়ান হেল্থ ফর অল’ যার বাংলা ভাবানুবাদ ‘জলাতঙ্কের অবসান, সকলে মিলে সমাধান’।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস ২০২৩ উপলক্ষে তার বাণীতে বলেছেন, ‘জলাতঙ্ক বিষয়ক  তে ২০৩০ সালের মধ্যে জলাতঙ্ক মুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।’

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে বলেছেন, বাংলাদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জলাতঙ্কের হার পূর্বের তুলনায় হ্রাস পেলেও ভৌগোলিক অবস্থান, অসচেতনতা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠির অনিয়ন্ত্রিত আচরণ ও ভ্রান্ত ধারণার জন্য এদেশে জলাতঙ্কের ঝুঁকি এখনও বিদ্যমান।

বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর ১৮৮৫ সালে সর্বপ্রথম জলাতঙ্কের প্রতিরোধের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। তার এ অসামান্য অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে গ্লোবাল এলায়েন্স ফর র‍্যাবিস কন্ট্রোল নামক আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক তার মৃত্যু দিবস ২৮ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস হিসেবে পালন করে। এ রোগের ভয়াবহতা উপলব্ধি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধ ও নির্মূলের লক্ষ্যে ২০০৭ সাল থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশ বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপন করে আসছে।

এবারের প্রতিপাদ্যে- জলাতঙ্ক নির্মূলে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা, সমতার গুরুত্ব এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাকে ওয়ান হেল্থের মাধ্যমে সম্পন্ন করার বিষয়গুলোতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক রোগ নিয়ন্ত্রণ লাইন ডাইরেক্টর সিডিসি অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, জলাতঙ্ক একটি মরণব্যাধি, যা কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে সংক্রমিত হয়। এছাড়াও বিড়াল, শিয়াল, বেছি, বানর, বাদুড় এর মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে মৃত্যু অনিবার্য। তবে সময়মত সঠিক ব্যবস্থা তথা টিকা গ্রহণ করলে এ রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজী ও শিয়ালের কামড় বা আঁচড় দিলে সাথে সাথে ক্ষারযুক্ত সাবান পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধৌত করতে হবে। এরপর যথাসময়ে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা নিলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হিসাবে গ্রহণ করে। স্বাস্থ্য বিভাগ, প্রাণিসম্পদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের যৌথ উদ্যোগে ২০১১-১২ সাল থেকে জলাতঙ্ক রোগ নির্মূল কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কৌশল পত্র প্রস্তুত করে দেশকে জলাতঙ্ক মুক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে এবং তা বাস্তবায়নে রোডম্যাপ তৈরী করা হয়। আর এসব বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করছে জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারাদেশে সকল জেলা সদর হাসপাতাল ও ৩৩৮টির অধিক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমের দেশের সকল উপজেলায় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। রাজধানী ঢাকাস্থ মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও ঢাকাস্থ ৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে জলাতঙ্কের আধুনিক চিকিৎসা কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। কুকুর বা অন্যান্য প্রাণির কামড়ের ঘটনায় এসব কেন্দ্রসমূহে আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্নভাবে বিনামূল্যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা ইন্জ, এন্টি-র্রাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) ও কামড়ের ধরন অনুযায়ী ইন্জ. রাবিস ইমুনোগ্লোবুলিন (আরআইজি) প্রদান করা হচ্ছে।

জাতীয় গাইডলাইন অনুসারে বর্তমানে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের পূর্ণ ডোজ তিনটি (০, ৩ ও ৭) দিনে নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে এক সপ্তাহের মধ্যে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় রোগীদের অর্থ ও সময়, দুই-ই সাশ্রয় হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সকল সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। যা দক্ষিণ এশিয়ায় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ল্যাবে প্রাণিদেহে জলাতঙ্কের জীবাণু নিশ্চিতকরণের কাজ করছে। এতে নির্দিষ্ট স্থানে এ রোগের উপস্থিতি ও প্রাদুর্ভাব নির্ণয় করে মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

বর্তমানে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে পরিবেশে জলাতঙ্কের প্রধান উৎস কুকুরের মধ্যে ব্যাপকহারে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান করা হচ্ছে। ব্যাপকহারে কুকুরের টিকাদান (এমডিভি) কার্যক্রমের মাধ্যমে ইতিমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় ১ম রাউন্ড, ৩৭টি জেলায় ২য় রাউন্ড এবং ৮টি জেলায় ৩য় রাউন্ড ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে কুকুরকে প্রায় ২৭ লক্ষ ৭০ হাজার ডোজ জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা প্রদান করা হয়েছে, যা মানুষ ও প্রাণিদেহে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম সামাজিক জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, ফেস্টুন, স্কুল প্রোগ্রাম, ভিডিও প্রতিবেদন, জনবার্তাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিরলসভাবে কাজ করছে। বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস ২০২৩-কে সামনে রেখে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা, র‌্যালী ও সেমিনারসহ নানাবিধ কার্যক্রম আয়োজন করা হয়েছে।

২০৩০ সালে জলাতঙ্ক মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশজুড়ে সরকারের গৃহীত সকল যুগোপযোগী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh