নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ধারণের চেয়েও যা জরুরি

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:০৬ এএম

আমীন আল রশীদ। ফাইল ছবি

আমীন আল রশীদ। ফাইল ছবি

নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি নতুন কিছু নয়। এমনকি নদ ও নদী নিয়ে তর্কও বেশ পুরনো। যদিও বাস্তবিক অর্থে নদ বলে কিছু নেই। পুরুষবাচক নাম হলেই সেটি নদ আর স্ত্রীবাচক নাম হলে সেটি নদী, এটি একটি বিভ্রান্তিকর ধারণা। কেননা বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় এভাবে নদীর লিঙ্গান্তর করা হয় না। তাছাড়া এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। তারপরও বাংলা ভাষায় নদ ও নদী-দুটিই প্রচলিত। 

প্রশ্ন হলো নদীর সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা কী? সংজ্ঞার কী প্রয়োজন? বাংলাদেশকে যে বলা হয় হাজার নদীর দেশ- তারই বা ভিত্তি কী? নদীমাতৃক বাংলাদেশের জনপরিসরে নদী নিয়ে এমন প্রশ্ন বছরের পর বছর ধরে রয়েছে। সেই প্রশ্নের সুরাহা করার চেষ্টা করছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার পালিত হয় বিশ্ব নদী দিবস। এদিন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে একটি সেমিনারে আনুষ্ঠানিকভাবে নদীর সংজ্ঞা এবং বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা উল্লেখ করে একটি সংকলনের মোড়ক উন্মোচন করেছে। 

প্রায় তিন বছর ধরে সমন্বয়, গবেষণা ও অনুসন্ধান করে কমিশন দেশের নদীর যে তালিকা তৈরি করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে নদীর সংখ্যা এক হাজার ৮। যদিও এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা ছিল এর প্রায় অর্ধেক। পাউবোর ওই তালিকার বাইরেও নদী রক্ষা কমিশন সারা দেশের স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ছোট-বড় সব নদীর তালিকা সংগ্রহ করেছে। তাতে প্রথম দফায় কমিশনের খসড়া তালিকায় নদীর সংখ্যা হয়েছিল ৯০৭টি। তালিকাটি সংশোধনের পর এখন নদীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০০৮-এ। তবে কমিশন বলছে, এটিও চূড়ান্ত নয়। 

নদীর সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। দক্ষিণাঞ্চলে যা খাল, উত্তরবঙ্গে সেই আকারের অনেক জলধারা নদী। আবার কোনো কোনো খালের দৈর্ঘ্য প্রস্থ অনেক নদীর চেয়েও বেশি। ফলে এসব বিভ্রান্তি এড়াতে নদী রক্ষা কমিশন নদীর একটি সংজ্ঞা তৈরি করেছে, যেটি এরকম, ‘পাহাড়, পর্বত, হিমবাহ, হ্রদ, ঝরনা, ছড়া, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলধারা হতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়ে যে জলধারা সারা বছর বা বছরের কোনো কোনো সময় দুই তীরের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্র, মহাসমুদ্র, হ্রদ, অন্য কোনো জলাশয় বা অন্য কোনো জলধারায় পতিত হয়, তা-ই নদ বা নদী। তবে শর্ত থাকে যে, ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে (সিএস), রিভিশনাল সার্ভে (আরএস) এবং বাংলাদেশ রিভিশনাল সার্ভে (বিএস) রেকর্ডে নদ বা নদী হিসেবে যা উল্লিখিত, সেগুলো নদ বা নদী হিসেবে গণ্য হবে।’ নদী রক্ষা কমিশনের এই সংকলনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নদীপথের দৈর্ঘ্য ২২ হাজার কিলোমিটার। দীর্ঘতম নদী পদ্মা, দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার। এককভাবে জেলা হিসেবে সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সবচেয়ে বেশি নদী। এই জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর সংখ্যা ৯৭।

এই সংজ্ঞা ও সংখ্যা কি খুব জরুরি? হ্যাঁ, জরুরি। কারণ নদীকে নদী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা না গেলে তার আইনি অধিকার আদায় করা যায় না। ২০১৯ সালে দেশের সব নদীতে জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি) হিসেবে ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। তার মানে মানুষের মতো নদীরও অধিকার আছে। সেই অধিকার লঙ্ঘিত হলে নদীর পক্ষে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে। উচ্চ আদালত বলেছেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন হচ্ছে নদীর অভিভাবক। দেশের কোথাও কোনো নদীর অধিকার লঙ্ঘিত হলে সেই অভিভাবক তার প্রতিকার করতে পারবে। নিজে প্রতিকার করতে না পারলে সরকারের সহযোগিতা নেবে। সেখানেও ব্যর্থ হলে আদালতে যাবে। 

কিন্তু বাস্তবতা কী

উচ্চ আদালতের আদেশে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও এটি এখন পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারেনি। এই প্রতিষ্ঠানের বাজেট খুবই কম। কমিশনের যে আইনি ক্ষমতা, তা কেবলই সুপারিশমূলক। অ্যাকশন নিতে পারবে না। অ্যাকশন নিতে হলে তাকে নির্ভর করতে হয় স্থানীয় প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, নৌ-পুলিশসহ সরকারের নানা দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের ওপর। এছাড়া কমিশনের অনেক দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাকে হুটহাট বদলি করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। নদী রক্ষায় কমিশনকে সহযোগিতা করার ‘অপরাধে’ স্থানীয় প্রশাসনের অনেককে বদলি করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার বা রাষ্ট্র নিজেই চায় না যে নদী রক্ষা কমিশন সত্যিই একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠুক। এ কথা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যানও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখেই বলেছেন। এমনকি ২৪ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানেও তিনি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে বলেন, তিনি নিজেই নদী দখলদারদের প্রশ্রয় দেন। এই যদি অবস্থা হয়; সরকার নিজেই যদি না চায় যে নদী কমিশন নদী রক্ষায় শক্তিশালী ভূমিকা রাখুক বা নদী রক্ষায় সরকারের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে একা নদী রক্ষা কমিশন কী করবে? নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা প্রকাশ করাই কি তার কাজ? 

এটা ঠিক যে, নদী রক্ষায় বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা বিগত সরকারগুলোর চেয়ে দৃশ্যত বেশি। রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীর থেকে সংসদ সদস্যসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তুরাগ নদীর পূর্ব তীরে বিশাল এলাকাজুড়ে দৃষ্টিনন্দন বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বাঁধের ভেতরে, নদীর গা ঘেঁষে ঢাকা উদ্যান নামে এলাকায় যে শত শত বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে; এই ভবনগুলোর সকল বর্জ্যরে গন্তব্য যদি হয় তুরাগ- তাহলে সেটি আরেকটি বিপর্যয়ের কারণ হবে। 

বস্তুত রাজধানীর আশপাশের নদীতে অবৈধ দখল উচ্ছেদে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যতটা আগ্রহ, অন্যান্য এলাকায় সেই আগ্রহ দেখা যায় না। সম্ভবত ঢাকার অভিযানগুলোর ‘মিডিয়া কাভারেজ’ ভালো পাওয়া যায় বলে। আবার অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযানে সরকার যতটা আগ্রহী বা সক্রিয়, নদীর দূষণ বন্ধে ততটাই নীরব বা নিষ্ক্রিয়। দূষিত হতে হতে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ এখন প্রায় মাছশূন্য। নদী তীরের অবৈধ দখল উচ্ছেদে সরকার যতটা সরব, দূষণে ততটা কেন নয়? উচ্ছেদ করলে সেটি দৃশ্যমান করা সহজ বলে? নদীর তীরে কিংবা নদীর জায়গা দখল করে যারা কল-কারখানা গড়ে তুলেছেন, তাদেরকে বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনে বাধ্য করা যায় না কেন? পরিবেশ অধিদপ্তর কী করে? প্রতিটি জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস আছে। তাদের ছাড়পত্র নিয়ে এসব কারখানা চালাতে হয়। নদীর পানি দূষিত করেও কল-কারখানাগুলো কীভাবে চলে? উন্নয়নের দোহাই দিয়ে? নদী দখল করে, নদীর পানি ব্যবহার-অযোগ্য করে যেসব কল-কারখানা গড়ে উঠল, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান কত আর তার বিনিময়ে যেসব নদী খুন হলো, তার অর্থনৈতিক মূল্য কত- সেই হিসাব করারও সময় এসেছে।

নদী কমিশন বলছে, দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ২২ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু শুকনো মৌসুমে এটি কত কিলোমিটারে এসে দাঁড়ায় এবং কত কিলোমিটারে নৌযান চলে? যতটুকু পথ নৌ চলাচলের উপযোগী রয়েছে, তারই বা কত শতাংশ ব্যবহৃত হয়? নদীমাতৃক দেশের প্রধান গণপরিবহন ব্যবস্থাটি নদীনির্ভর না হয়ে যে সড়কনির্ভর হলো এবং তার ফলে হাজার হাজার অপরিকল্পিত সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের মধ্য দিয়ে যে শত নদী মেরে ফেলা হলো; তার ফলে শুধু নৌ যোগাযোগই নয়, দেশের কৃষি অর্থনীতি এবং মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থায় কী পরিমাণ ক্ষতি হলো- সেই হিসাবটিও করা জরুরি। 

অতএব শুধু নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ধারণই নয়, বরং নদীমাতৃক দেশে নদীই কেন সবচেয়ে বিপন্ন- নদী কমিশনের উচিত সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh