জন সিম্পসন, ভাষান্তর: জাফর খান
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০১:১৪ পিএম | আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:৪৩ পিএম
আলোচিত হোয়াইট টর্চার বইয়ের লেখক নার্গিস মোহাম্মাদি। ছবি: সংগৃহীত
আমার ঠিক মনে নেই বা ভাবনার মানসপটেও আসছে না যে শেষ কবে এমন একটি বইয়ের পাতা খুলেছিলাম যেখানে এমন বিরক্তিকর কিছু শব্দ লিখা ছিল: "আমার জন্য বরাদ্দকৃত ছুটির শেষ সময় এসে এই ভূমিকাটি রচনা করছি। খুব শীঘ্রই আমাকে আমার কারাগারে ফিরে যেতে হবে... এবারে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল কারণ আপনার হাতে যে বইটি দেখছেন- ‘হোয়াইট টর্চার ’, এটির জন্য। মার্চের শেষ দিকের ঘটনা, নার্গিস মোহাম্মাদি- ইরানের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ যিনি কিনা দেশটির প্রচলিত রাজনৈতিক প্রথার সাথে সহমত নয় বরং ভিন্নমত ধারণ করে থাকেন, তিনি কারাগার থেকে অল্পকদিনের জন্য হৃদরোগের জন্য মুক্তি পেয়েছিলেন। তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। পরে কার্ডিয়াক সার্জারির মধ্যদিয়ে সেটির প্রতিকার করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বর্তমানে ফের বন্দী অবস্থায় রয়েছেন। আশি বেত্রাঘাত এবং ৩০ বছরেরও বেশি সময় কারাগারের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। আর তার সাজার কিছু অংশ নির্জন কারাবাসেও কাটবে। তার এক লেখায় তিনি লিখেছেন- "আমি আরও একবার ঘোষণা করছি যে এটি একটি নিষ্ঠুর এবং অমানবিক শাস্তি। এটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আমি বিশ্রাম নেব না।"
মোহাম্মাদী তার নিজ জীবনের নির্জন কারাবাসের দঃসহ সময়গুলো নিয়েই তার প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। তার মতই অবশ্য আরও ১২ জন ইরানী নারীর সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাদেরও নির্জন কারাবাসের বিষাদময় চিত্রের কথা ওঠে এসেছে। যদিও তারা বিভিন্ন পটভূমি থেকে এসেছেন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রের আইনমতে তাদের কর্মকাণ্ড অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে বলেই তাদেরকে জেলে যেতে হয়েছিল। এসব অপরাধের মধ্যে ছিল-বাহাই ধর্মীয় সম্প্রদায় বা সুফির সদস্যলাভ, খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া, পিপলস মুজাহেদিনকে সমর্থন কিংবা তাদের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা।
হেঙ্গামেহ শাহিদি– বিচার বিভাগীয় দুর্নীতির বিষয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ করার জন্য প্রায় ১৩ বছরের কারালাভ করেছিলেন। গত বছর মুক্তি পেলেও নির্জন কারাবাসের জন্য এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং ধারণা করা হচ্ছে তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সক্ষম হবেন না। জাতিসংঘের একজন বিশেষ র্যাপোর্টার কয়েক বছর আগে সংস্থাটিকে জানিয়েছিল, “নির্জন কারাবাস আসলে নির্যাতনের আরেকটি রূপ।‘’
মোহাম্মাদির সাক্ষাৎকারের আরেকজন, মারজিয়েহ আমিরি– যিনি পেশায় ইরানের একজন সাংবাদিক। বিক্ষোভের সময় প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছিল তা খুঁজে বের করার চেষ্টার জন্য তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। "আমাকে নির্জন কারাগারে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ... সেই মুহূর্তে আমি নিজেকে পাগল হিসাবে দেখেছিলাম এবং আমি এমন একটি ভয় অনুভব করেছি যা জিজ্ঞাসাবাদকারী এবং কারাগারে থাকার ভয়ের উর্ধ্বে ছিল। আমি নিজেকেই ভয় পেতে শুরু করেছিলাম…. নির্জন কারা সেল আপনার কাছ হতে সামাজিক জীবনের নীতিসহ সব ক্রমশ কেড়ে নিতে সক্ষম।"
বর্তমানে ইরানে নারী বন্দীদের সঙ্গে বর্বর আচরণ করা হয়ে থাকে। শাসকদের অবস্থাও যেন অনেকটা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মত হয়ে গেছে। দেশটিতে উপ-বিপ্লবী অভ্যুত্থানের একটি পর্যায় চলে এসেছে বলে অনুভব করছে ইরান জনগণ। অতীতে নির্লজ্জভাবে চুরির মধ্যদিয়ে ২০০৯ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ২০১৯ সালে জ্বালানির অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য মূল্য বৃদ্ধি এ ব্যবস্থাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
বর্তমান সময়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী মানুষ যেন তাদের জীবনযাপন করতে বাধ্য হন সেদিকেই নজর প্রশাসনের। আর এমন এক দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে। হিজাব না পরার দায়ে পুলিশ হেফাজতে ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনীর মৃত্যু তেমন ইঙ্গিত। আর এ সময় গড়ে ওঠা বিক্ষোভে সরকারের কুটিলতা বা অর্থনৈতিক অক্ষমতার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। কেননা শাসকমহল এমনভাবে বিষয়টিকে প্রকাশ্যে এনেছে যেখানে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়।
প্রায় নিত্যদিনই জনতা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। কখনও কখনও তারা সরকারী ভবনে হামলা চালায়। আবার কখনো পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বেশিরভাগ বিক্ষোভকারিরা নাচ-গান দিয়ে তাদের প্রতিবাদের ভাষার প্রকাশ করেছিলেন। আর মহিলারা তাদের মাথার স্কার্ফ খুলে চুল ঝাঁকিয়ে সরকারকে জানাতে চাইছিলেন যে তারা আর রাষ্ট্রের নিয়মে আবদ্ধ নন। কিন্তু তাদের এমন প্রতিবাদের জন্য ভারী মূল্য চুকাতে হয়েছিল। অসলো-ভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটস বলছে যে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং বাসিজ মিলিশিয়া যৌথ অভিযানে অন্তত ৩২৬ জনকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে ২৫ নারী এবং ৪৩ শিশু রয়েছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে যারা আইনের শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
বিক্ষোভকারীরা কি জিতবে? আমি মনে করি বিজয় আসবে, তবে কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে, হয়ত শীঘ্রই তা হবে না। এ মুহুর্তে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিচক্ষণ নেতৃত্ব নেই। যদি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি, রাষ্ট্রপতি রাইসি এবং তাদের অযোগ্য শাসনের বাকি অংশগুলোকে বিদায় জানানো হয় তবে কিন্তু ইরান চরম আকারে একটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। পরিস্থিতি খারাপ হতে ভয়াবহের দিকে যেতে পারে। যেমনটা হয়েছিল শাহকে উৎখাতের সময় আর পরবর্তীতে জের হিসেবে নতুন রাষ্ট্র এবং বিরোধীদের মধ্যে সৃষ্ট গণ্ডগোলে গৃহযুদ্ধে নিপতিত হয়েছিল দেশটি।
বর্তমান বিক্ষোভগুলো একটি প্রবীণ, অতি-কঠোর রাজনৈতিক-ধর্মীয় অনুশাসনের অধীনে সব মেনে নেয়ার সময়সীমা হয়ত আরও আগেই অতিক্রম করেছে এমন এক ইঙ্গিত বহন করছে। বর্তমানে ইরানের জনসংখ্যা ৮৫ মিলিয়ন, যাদের অর্ধেক শিক্ষিত। বাহ্যিক চেহারা এবং আচরণে এটাই দেখাচ্ছেন তারা যে, তাদের সরকার কতটা অদ্ভুত এবং পুরানো ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। আর বিক্ষোভেই ফুটে ওঠছে তাদের অভিব্যক্তি।
১৯৭৮ সালের নভেম্বরে তেহরানে, এক মিলিয়ন লোক রাস্তায় নেমে -"মার্গ বার শাহ!"(শাহের মৃত্যু), "জাভিদ খোমেনি!(খোমেনি দীর্ঘজীবী হোক)," বলে স্লোগানে প্রকম্পিত করেছিল রাজপথ। আমি একজন ইরানী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সঙ্গে একটি শপিং আর্কেডে সেদিন টিয়ারগ্যাস ও বুলেট থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, আমাদের নেতা যদিও এখনও নির্বাসিত যিনি সেপ্টুয়াজ্যানারিয়ান ধর্মগুরু, তিনি আসছেন। তার অধীনে নতুন ইরান হবে উন্নত, শালীন এবং বিশ্ব সমাদৃত একটি দেশ।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "আর কোনো অত্যাচার হবে না?" জবাবে তিনি বলেছিলেন- "অবশ্যই না।" মোহাম্মেদ আজকাল আমাকে লেখেন না কারণ তার ভয় যে কর্তৃপক্ষ যদি তার ইমেল পড়তে পারে; কিন্তু তিনি অনেক আগে থেকেই ইসলামি বিপ্লব কীভাবে ঘটবে সে সম্পর্কে বলতেন। খুব শিশুসুলভ ও স্থূলভাবে তিনি এ বিষয়ে অতিরিক্ত আশাবাদী ছিলেন। বর্তমানে রাজপথে থাকা মানুষদেরকেও এমন আশাবাদী দেখাচ্ছে। যখন আয়াতুল্লাহদের শাসনের অবসান ঘটবে, তখন হোয়াইট টর্চারসহ অন্যান্য সকল প্রকার নির্যাতন বিলুপ্ত হয়ে যাবে দেশটি থেকে? আমার প্রত্যাশা, যদি বাস্তবে এমনটা হতো!
জন সিম্পসন বিবিসির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। তার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান- আনস্পান ওয়ার্ল্ড বিবিসি টু, বিবিসি ওয়ার্ল্ড, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ও আই প্লেয়ারে প্রচারিত হয়। হোয়াইট টর্চার গ্রন্থের লেখক ইরানী নারীবন্দীর এ সাক্ষাৎকারটি ‘ ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ এ প্রকাশিত হয়েছিল।