‘গরিবের প্রোটিন’ ডিমেও কালো থাবা

আহমেদ সেলিম

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:১৭ এএম

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

গরিবের প্রোটিন হিসেবে খ্যাত ডিম। কিন্তু আকাশচুম্বী দামের কারণে নিম্ন আর মধ্যবিত্তের পাতে বেশ কিছুদিন থেকেই বাদ পড়েছে সেই ডিম। কয়েক দফা দাম বাড়িয়ে বাজারে প্রতি হালি ডিমের দাম এখন ৫৩-৫৬ টাকা। এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে মানুষ যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই ডিম নিয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ দিলেন গবেষকরা। তারা বলছেন, খামারে উৎপাদিত যেসব ডিম ঢাকা শহরে পাওয়া যায়, তাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার (ম্যাক্সিমাম পার্মিসিবল লিমিট বা এমপিএল) চেয়ে বেশি পরিমাণে দস্তা, তামা, সিসা ও লোহা পাওয়া গেছে ডিমে। মাত্রাতিরিক্ত এসব ভারী ধাতুর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এসব ভারী ধাতু ক্যানসার, হৃদরোগ, শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা, রক্তশূন্যতা, মস্তিষ্ক-কিডনি-স্নায়ুর ক্ষতিসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার জন্য দায়ী। আর এসব ধাতুর উপস্থিতি প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশু ও বয়স্কদের জন্য বেশি ঝুঁকি তৈরি করে বলেও উঠে এসেছে গবেষণায়।

ডিম নিয়ে এই দুঃসংবাদে আরও উদ্বেগ বিরাজ করছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। অনেকেই জানান, আকাশছোঁয়া দামের কারণে এমনিতেই ডিমে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর যদি ডিমে এত খারাপ উপাদান থাকে তাহলে আমরা কী খেয়ে বাঁচব? সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্যানারির বর্জ্যে ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি থাকে। মুরগির খাদ্যে কখনো কখনো ট্যানারির বর্জ্য মেশানো হয়। কারণ তাতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে, যা মুরগিকে তাড়াতাড়ি বড় হতে সহযোগিতা করে। গবেষকরাও ধারণা করছেন, খাবারের মাধ্যমে মুরগির শরীরে বিষাক্ত ভারী ধাতু প্রবেশ করছে। সেখান থেকে ডিমে। আর ডিম থেকে মানুষের শরীরে। তাই খামারে পালন করা মুরগির খাবার আরও নিরাপদ হওয়া উচিত। মুরগির খাদ্য নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা।

ডিম নিয়ে গবেষণায় যে দুঃসংবাদ 
ঢাকা শহরের মানুষ যে ডিম খায় তাতে ভারী পদার্থের উপস্থিতি আছে কি না জানতে যৌথভাবে গবেষণায় নামেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন গবেষক। ‘ডিমের মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ গ্রহণ এবং ঢাকা নগরীর মানুষের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি পরিমাপ’ নামের সেই গবেষণা নেদারল্যান্ডসভিত্তিক চিকিৎসা ও বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল সায়েন্স ডিরেক্টের ওয়েবসাইটে গত ২৮ জুন প্রকাশ হয়েছে। সায়েন্স ডিরেক্ট অন্তর্ভুক্ত সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারাবিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রির চলতি বছরের অক্টোবর (ভলিউম ১৬, ইস্যু ১০) সংখ্যাতেও গবেষণাটি প্রকাশ হয়েছে।

গবেষণাটি করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহজাহান, অধ্যাপক আবদুস সামাদ ও মো. মাহমুদুল হাসান; একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক দোলন রায়; বিসিএসআইআরের কেমিক্যাল গবেষণা বিভাগের খন্দকার শাহীন আহমেদ এবং হাজী দানেশের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক স্মিতা সরকার।

গবেষণায় ডিমে ১০টি ভারী ধাতুর উপস্থিতি খোঁজা হয়। তাতে ডিমে সব কটি ধাতুরই উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়টি ধাতুর উপস্থিতি সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার (এমপিএল) মধ্যে রয়েছে। বাকি চারটি (দস্তা, তামা, সিসা ও লৌহ) ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে এমপিএলের চেয়েও বেশি। ডিমে তামার এমপিএল ১০, সেখানে পাওয়া গেছে ২৪.৯ পর্যন্ত; সিসার এমপিএল ০.১, সেখানে পাওয়া গেছে ১.৯ পর্যন্ত; লোহার এমপিএল ১৭.৬, সেখানে পাওয়া গেছে ৬৪.৫৯ পর্যন্ত এবং দস্তার এমপিএল ২০, সেখানে পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৩৯.২৬।

গবেষকরা জানান, গবেষণার জন্য কিছু পাইকারি বাজার নির্বাচন করা যায়, যেখান থেকে ডিম পুরো ঢাকা শহরে ছড়িয়ে যায়। এমন ছয়টি বাজার থেকে গবেষকরা ১২টি করে মোট ৭২টি ডিম সংগ্রহ করেন। ২০২০ সালের ১২ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত মহাখালী, মোহাম্মদপুর, সাভার, মিরপুর-১, যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজার থেকে ডিমগুলো সংগ্রহ করা হয়। 

কেন এই ভারী ধাতুর উপস্থিতি
পোলট্রি সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্যানারির বর্জ্যে ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি থাকে। মুরগির খাদ্যে কখনো কখনো ট্যানারির বর্জ্য মেশানো হয়। কারণ তাতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে, যা মুরগি তাড়াতাড়ি বড় হতে সহযোগিতা করে।

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক দোলন রায় বলেন, ধারণা করছি, খাবারের মাধ্যমে মুরগির শরীরে বিষাক্ত ভারী ধাতু প্রবেশ করছে। সেখান থেকে ডিমে। আর ডিম থেকে মানুষের শরীরে। তাই খামারে পালন করা মুরগির খাবার আরও নিরাপদ হওয়া উচিত।

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সারা দেশে লাখ লাখ টন খাবার তৈরি হয়। সব খাবারের তথ্য আমাদের কাছে নেই। ডিমের পাশাপাশি খাদ্য নিয়েও গবেষণা হোক। তখন বোঝা যাবে কোন খাদ্যটা খারাপ।

প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি বলেন, খাদ্য উৎপাদনকারীরা নিরাপদ পোলট্রি খাদ্য না দিলে প্রান্তিক খামারিরা নিরাপদ মুরগির মাংস ও ডিম দিতে পারবেন না।

অস্থির ডিমের বাজার
সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম, বিদেশ থেকে আমদানির অনুমতি, বিভিন্ন বাজারে ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান, দাম বেশি রাখার জন্য জরিমানা- তারপরও অস্থিরতা কমছে না ডিমের বাজারে। বাজারভেদে এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোক দেখানো হাতেগোনা কয়েকটি অভিযান চালালে হবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সঠিক নজরদারি। 

গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর না হওয়ায় ১৮ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথম দফায় ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়। এরপর দুই দফায় আরও ১১ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডিমের বাজার। 

গত দুই-তিন দিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে, সরকারের বেঁধে দেওয়া ৪৮ টাকা হালিতে ডিম কেনার অভিজ্ঞতা হয়েছে এমন ক্রেতা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন ডিমের দাম এমন লাগামহীন- এর ব্যাখ্যাও মিলছে না। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেখালেও কর্তৃপক্ষ চুপ। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম হালিতে দশ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

ডিমের দাম নিয়ে পল্টনে কথা হয় রিকশা চালক তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, রিকশা চালানো খুবই কঠিন কাজ। প্রচুর শক্তি ব্যয় করতে হয়। আগে যখন সকালে রিকশা নিয়ে বের হতাম তখন নাশতার সঙ্গে একটি ডিম খেতাম। সন্ধ্যায় আবার ফুটপাত থেকে সিদ্ধ একটি বা দুটি ডিম খেতাম। কিন্তু এখন ডিমের যে দাম হাত দেওয়ারও সাহস করতে পারি না।

পান্থপথের এক বাসায় মেস করে থাকেন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রকিবুল হাসান। বলেন, মেসে বুয়া (গৃহকর্মী) আসে নাই মানেই ডিম ভাজি করে ভাগাভাগি করে খেতে বসে যাওয়া। আবার সহজে নানাভাবে রান্না করা যায় এজন্য ঢাকায় মেস করে খাওয়া লাখ লাখ মানুষের একমাত্র অবলম্বন ছিল ডিম আর ডাল। এখন একদিকে ডিমের আকাশচুম্বী দাম অন্যদিকে আবার ক্ষতিকর উপাদানের খবর আমাদের মধ্যে আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত বলে মনে করি। 

ডিম সংগ্রহকারীরা (ব্যবসায়ীরা যাদের বলে থাকেন মিডিয়া) স্থানীয়ভাবে বেশি দামে ডিম কেনার কারণেই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিপিএ’র সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার। বলেন, মিডিয়ার লোক বেশি দামে ডিম কেনে, যার খেসারত দিতে হয় ভোক্তাদের। থানা বা জেলা যেখান থেকেই ডিম কেনা হোক- ঢাকায় আসতে আসতে তা দুবার হাতবদল হয়। আর এতেই দাম বেড়ে যায়। তাই মিডিয়ার লোকদের সরকারের নির্ধারণ করা দামে ডিম কিনতে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 

চাহিদা অনুযায়ী ডিম না খেলে কী ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুল আরেফিন বলেন, প্রোটিনজাতীয় খাবারের ঘাটতি মেটাতে আমরা সাধারণত ডিম খেতাম। দাম কম হওয়ায় সহজেই সবাই ডিম থেকে সেই প্রোটিন পেত। কিন্তু বর্তমানে দাম বৃদ্ধির কারণে সেই ঘাটতি পূরণে সমস্যা তৈরি হবে। বিশেষ করে শিশুদের দেহের বৃদ্ধিসাধন ব্যাহত হবে। আর প্রোটিন ঘাটতির কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কমে যাবে। তাতে করে শিশুদের ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh