তৃণমূলে অসাম্প্রদায়িক শক্তি জাগরণের আভাস

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ১০:০৪ এএম

দুর্গাপুজার মণ্ডপ। ছবি: সংগৃহীত

দুর্গাপুজার মণ্ডপ। ছবি: সংগৃহীত

এবারের দুর্গাপুজোর পাঁচ দিন ঢাকাসহ গ্রামগঞ্জের মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরলাম। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে বিরামহীনভাবে ঘোরাটা ছিল পরিকল্পিত। এমনটা মাঝে মাঝেই লিখি যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা জাতীয় চারনীতির শিকড় আমাদের জাতীয় সত্তার বহু গভীরে প্রোথিত, সেই চেতনাকে বাস্তবায়িত করার পথে চড়াই-উতরাই থাকতে পারে, কিন্তু ছিন্ন করে জাতিকে সাম্প্রদায়িক চেতনার ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, তৃণমূলে না গেলে ওই ধরনের তত্ত্বকথা পরখ করা বেশ কষ্টকর। তাই ভাবলাম, অবহেলিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শক্তি কতটুকু গণমানুষের মধ্যে সঞ্চিত রয়েছে, তা প্রত্যক্ষ করার জন্য পুজোর সময়ে গ্রাম-গঞ্জে ঘোরাটা একান্ত প্রয়োজন। 

অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ বলতে যাওয়ার আগে কিছু কথা বলতেই হয়। আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে যখন জাতির সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতার মধ্যে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছে, তখন ২০২১ সালের দুর্গাপুজোর সময়ের অনভিপ্রেত ঘটনা স্মরণে এনে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনায় খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে দুর্গাপুজোর পাঁচ দিন শান্তিপূর্ণভাবে দেবীর আরাধনা ও আনন্দ-উৎসবের ভেতর দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের জাতির জন্মলগ্নের মর্মবাণী ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’-এর অঙ্গীকারের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় এটা নিঃসন্দেহে স্বস্তি ও তৃপ্তিদায়ক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এমনটাই একান্ত কাম্য। 

প্রসঙ্গত দ্বিজাতিভিত্তিক পাকিস্তানি আমলে গণতন্ত্র ও বাঙালির জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের দিনগুলোতে, সত্তরের নির্বাচনে, মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং স্বাধীন স্বদেশে জাতীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে সংবিধানিক শাসন চালু হওয়ার পর এমন ধারণা করা হয়েছিল যে, বাংলার মাটিতে দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার কবর হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর আমলেও দেখা গেছে, সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির মূলোৎপাটন করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। 

পরবর্তী সময় পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন তথা হত্যা-ক্যু-পাল্টা ক্যু ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনামলের দিনগুলোতে রাষ্ট্রক্ষমতায় সাম্প্রদায়িকতার পাকিস্তানি ভূত জাতির ঘাড়ে আবারও চেপে বসে। পুজোর তিন দিন কখনোবা আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথে যেতে যেতে, কখনো পদ্মা-কালনা সেতু দেখতে দেখতে, গ্রামের পথে চলতে চলতে ওই দিনগুলোর কথাই ভাবছিলাম। অষ্টমী পুজোর দিন মনিরামপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম কমলপুর ও নবমীর দিন নড়াইল শহর এবং দশমীর দিন ঢাকার কালিগঞ্জের গ্রাম বক্তারপুরে যাওয়ার সময় রাস্তায় আর পুজোমণ্ডপে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পথচলায় একদিকে গৌরব ও গর্ব আর অন্যদিকে কলংক ও হতাশার কথাগুলো নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে যাত্রার সব কষ্ট যেন ভুলে গেলাম। 

বাস্তবে গৌরব না কলংক কোনটা ভারী- এই প্রশ্নটি নড়াচড়া করতে গিয়ে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। কেননা তখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম এই ভেবে যে, নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণভাবে পুজো শেষ হবে তো! মন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকলে অতীতের খারাপটাই বেশি মনে পড়ে। তাই উৎসব আনন্দের দিনগুলোতেও কলংক ও হতাশার দিকটা অনেক সময়েই বড় হয়ে উঠল। কলংকিত পনেরোই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিদ্রোহী মেজরদের নিয়ে খুনি মোশতাক ক্ষমতায় বসলে আমরা ভাবলাম, দেশ হবে ঠিক ১৯৬৬ সালের ইন্দোনেশিয়ার ডান-প্রতিক্রিয়াশীল সেই রক্তাক্ত ক্যুয়ের মতো, যাতে ১০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।

তাই আমরা পিছু হটলাম, সময় হলে আঘাত করার জন্য। মোশতাক অস্ত্রের জোরে আওয়ামী লীগকে দিয়েই বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু আম গাছ তো আর ভেরেণ্ডা গাছ হয় না। বিফল হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। পর্যবেক্ষণে যতটুকু ধারণা করা যায়, দেশি-বিদেশি মাস্টারমাইন্ডদেরও নীলনকশায় মোশতাক সরকারকে স্থায়ী করার বিষয়টা ছিল না। ওটা ছিল স্টপ গ্যাপ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আন্দোলনকারী শক্তি মোশতাক সরকারকে আঘাত করতেই দেশ পড়ল ক্যু আর পাল্টা ক্যুয়ের মধ্যে। বিয়োগান্তক নাটকের ধারাবাহিকতায় সামরিক কর্তা জিয়ার শাসন শেষ হয়ে এলো বিচারপতি সাত্তারের শাসন। 

নির্বাচন হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জাতীয় মূলধারার আন্দোলনকারী শক্তি পিছু হটে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার সদস্য ও পরবর্তী সময় খুনি মোশতাকের উপদেষ্টা এমএজি ওসমানীকে নিয়ে নির্বাচনে নামল। এই অবস্থায় ১৯ জুলাই ১৯৮১, শত্রু ( অর্পিত) সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আমিনুল হকসহ নেতৃবৃন্দ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। 

নেতৃবৃন্দ বলেন, এই আইন ‘জাতীয় মর্যাদা ও মানবিক রীতিনীতির পরিপন্থী’। এই আইনের বলে ‘স্বার্থান্বেষী আমলা ও তহসিলদারদের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের ফলে’ ৮ লাখ ৫০ হাজার একর ভূমি ও প্রায় ২২ হাজার ঘরবাড়ি শত্রু সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়েছে। এই সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি। নেতৃবৃন্দ বলেন যে, আন্তর্জাতিক বিধান, মানবিক রীতিনীতিবিরুদ্ধ এই আইন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে ১৯৭৭ সালের মে মাসে জারিকৃত ‘সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনামা’। তারা বলেন, ‘এতদিন আমরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুখ চেয়েছিলাম, এখন সরাসরি আমরাই আন্দোলনে নেমেছি।’ যা ছিল দুই ধর্মের মানুষের আন্দোলন, তা-ই এক সময় এসে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কেন আন্দোলন এমন রূপ নিল, তা নিয়ে কি মুক্তিযুদ্ধে গর্বিত বাঙালি জাতি কখনো আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হবে না?

ওই আন্দোলনেরই পাল্টা হিসেবে ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে বিএনপির সাত্তার সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে আদিবাসী কল্যাণ ফেডারেশনের উদ্যোগে দেশে প্রথমবারের মতো ৩০টি সম্প্রদায়ের প্রায় আড়াই হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আদিবাসী উপজাতিদের সম্মেলনের আয়োজন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতারা দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে অভিযোগের সুরে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় একদিকে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ গ্রহণ না করে নিপীড়ন ও সামরিক সমাধানের পথ গ্রহণ করে, আর অন্যদিকে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় জোরপূর্বক বসতি স্থাপন করে পরিস্থিতিকে নাজুক ও অশান্ত করে তুলেছে। ময়মনসিংহ, জামালপুর ও সিলেট জেলার উত্তরাংশে বসবাসকারী গারো, হাজং কোচ, বকানাই, ডালু প্রভৃতি উপজাতির নেতারা বলেন, ১৯৬৪ সাল থেকে তাদের নিজস্ব জমি অন্যায়ভাবে বেদখল হয়ে আছে। মধুপুরের ১৫/২০ হাজার আদিবাসী উপজাতিরা উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হচ্ছে।

উক্ত সম্মেলনের প্রধান অতিথির ভাষণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার বলেন, ‘এ দেশে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। ... জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আপনারাও অগ্রগতির মূল স্রোতধারায় মিশে যান। এভাবেই সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।’ দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে ‘সংখ্যালঘু বলে কেউ নেই’ কথাটা নিয়ে ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের বিরূপ তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। জাতীয় মূলধারা তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তীব্র প্রতিবাদ করে।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি সাত্তারের উল্লেখিত কথাটা এখন প্রায়শই শোনা যাচ্ছে। এই সুযোগে দুর্গাপুজো মণ্ডপে গিয়ে বিচারপতি সাত্তারের মতোই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘বিএনপি সংখ্যালঘু ধারণায় বিশ্বাস করে না।’ নড়াইল ও যশোরের গ্রামাঞ্চলে পুজোমমণ্ডপে ঘুরতে ঘুরতে ভাবলাম, ২০০১ সালে নির্বাচনের পর ভোট দেওয়ার কারণে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন কি ওই ধরনের বিশ্বাস থাকার কারণেই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি করতে গিয়েছিল!  

তারপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-কর্ণফুলী দিয়ে বহু পানি গড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। পঁচাত্তরের পর থেকে সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠান্ডা যুদ্ধ যুগে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম বেগবান থাকা অবস্থায়ই রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশ ক্রমে দক্ষিণে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে চলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধ্বংসের মধ্যেই এক সময় সমাজতন্ত্র বিশ্বব্যবস্থার পতন হয়। ওই সময় থেকে প্রথমে অমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বে এবং বর্তমানে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বে দেশে দেশে জাতীয় ও ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব, জাত্যাভিমান, হিংসা-দ্বেষ, লোভ-লালসা প্রভৃতি প্রবলতর হয়ে উঠছে। কোভিড দুর্যোগের পর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বর্তমানে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ এরই পরিণাম। উপমহাদেশের দেশগুলোর দিকে তাকালেও এমনটাই প্রত্যক্ষ করা যাবে।

এর মধ্যেও যে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সরকার টিকে আছে, তা মূলত ওই চেতনার জাতিসত্তার শিকড় গভীরে প্রোথিত হওয়ার কারণেই। স্বাভাবিকভাবেই সরকারকে বিশ্ব ও দেশের অধোগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর হতে হচ্ছে। কিন্তু এমন প্রশ্ন কি রেখে যাচ্ছে না যে, তাল মেলাতে গিয়ে সরকার অধোগতির দিকে হেলে যাচ্ছে? মনিরামপুরে কথা হচ্ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগ কর্মীর সঙ্গে। 

তিনি বললেন, বিগত নির্বাচনে ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ওয়াদা করেছিল, অর্পিত সম্পত্তি প্রকৃত স্বত্বাধিকারীকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন করা হবে ইত্যাদি। এর কোনটা কতটুকু হয়েছে, বলতে পারেন? ন্যায্যতার ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদায়ন এবং অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সমস্যার কথা বলে তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম, নির্বাচনী অঙ্গীকারে থাকে আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি- এই তিন ধরনের কর্মসূচি। নির্বাচন সামনে, দল ক্ষমতায় থাকলে এসব অঙ্গীকারও পূরণ হবে।

মনিরামপুরের কমলপুর গ্রামে হানুয়ার পশ্চিমপাড়া মন্দিরের পুজোম-পে অষ্টমীর রাতে বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’ নিয়ে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের সুযোগ হলো। মনে হলো এ যেন বক্তা-শ্রোতা হিন্দু-মুসলিমদের মিলনমেলা। মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই একসঙ্গে সন্ধিপুজো দেখছে। গ্রামীণ মেলায় ঘুরছে। একসঙ্গে খেলামও। নড়াইল শহরে নবমী পুজোর দিন সকালের দিকটায় ঘুরলাম। বোরকা-হিজাব পরা মহিলা ও টুপি পরা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরছে। মেলার দোকানিদের বড় অংশ সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের। বরেণ্য চিত্রশিল্পী নড়াইল তথা বাংলার গর্ব সুলতানের শিশুস্বর্গের চিত্রশালায় গেলাম। সেখানে হিন্দু-মুসলামের পবিত্র মিলনের চিত্র প্রত্যক্ষ করলাম। 

সবশেষে ঢাকার দশমীর দিনে কালীগঞ্জের বক্তারপুর বাবুর বাড়ির পুজোমণ্ডপে নিমন্ত্রিত হয়ে দলবল নিয়ে গেলাম। সেখানেও দেখলাম সম্প্রীতির চিত্র। সবচেয়ে মজা পেলাম, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দুই মহিলা আনসার বাংলাদেশের পতাকার দুই রঙ- লাল পাড়ের সবুজ শাড়ি পরে পাহারা দিচ্ছে। মন্দির লাগোয়া স্থানে তারা বসেছিলেন। ছুতমার্গ, ভেদাভেদ কিছুই নজরে এলো না। পুজোর আনন্দে তারাও অংশীদার। তাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুললাম , কথাও বললাম। আমার মনে হলো এই তো ধর্মনির্বিশেষে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ, যা নির্বিঘেœ হিন্দু সম্প্রদায়ের পুজো এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতির অন্যতম বড় শারদীয় উৎসব সমাপনের ভেতর দিয়ে উঠে এলো।

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মনে হলো, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এই দেশই পারে, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই নীতি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করতে। বিশ্ব ও দেশের বর্তমান বাস্তবতায় গণমনস্তত্ত্বের ভারসাম্য রক্ষার নামে কিংবা কখনো আরও উগ্রতার আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী সরকার কৌশল নিয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের যতটুকু আমল দিচ্ছে, ততটুকু না দিলেও পারে। এজন্য প্রয়োজন অসাম্প্রায়িক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও উৎসাহিত করা।

মনিরামপুরের সেই রাজনৈতিক সাথিটি সঠিকভাবেই বলেছিলেন, এই চেতনাকে অগ্রসর করার জন্য কোনো মোটিভেশনের ব্যবস্থা দলের তৃণমূলে নেই। কেন্দ্রে আছে কি? নিরুত্তর ছিলাম। বাস্তবে পবিত্র ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহারকে মোকাবিলা করে অতীতে যেমন আওয়ামী লীগ দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পথরেখা রচনা করেছে, এখনো অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সেভাবেই অগ্রসর হতে হবে। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার শিকড় থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা কখনোই সম্ভব নয়। জয় বাংলা। সবাইকে শারদীয় ও বিজয়ার শুভেচ্ছা।

-কলাম লেখক, রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh