আহসান হাবীব সুমন
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১৪ পিএম
ব্রাজিল ফুটবল। ছবি: সংগৃহীত
ব্রিটেন ফুটবলের জনক হলেও এর পূর্ণ সৌন্দর্যে বিকশিত হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকায়। বিশেষত ব্রাজিলের ‘জোগো বোনিতো’ ফুটবলের মোহে আচ্ছন্ন হয়নি, এমন ফুটবল দর্শক খুঁজে পাওয়া আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব। ছোট ছোট পাস, ছন্দময় গতি, সাগরতরঙ্গের মতো আক্রমণ, শিল্পীর ছোঁয়ায় গড়া আক্রমণের মাদকতায় প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করাই ব্রাজিলের জোগো বোনিতো ফুটবলের মূলনীতি। যেখানে থাকে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত দক্ষতার অনুপম প্রদর্শনী। কিন্তু গত দুই দশকে ব্রাজিলের ফুটবল ক্রমশ ছন্নছাড়া। না আছে খেলায় কোনো নান্দনিকতা, না আছে বিশ্বসেরা স্তরের কোনো ব্যক্তিগত প্রতিভা।অন্ধের যষ্টি নেইমার জুনিয়রকে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের বিচারে ‘জোগো বোনিতো’র শেষ প্রতিনিধি হিসেবে ধরা যায়।
ব্রাজিল সর্বাধিক পাঁচবারের ফিফা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। ২০০২ সালে শেষবার উঁচিয়ে ধরেছিল বিশ্বকাপ ট্রফি। পরে ২০১৪ সালে নিজেদের মাটিতে সর্বোচ্চ সাফল্য পেয়ে সেমিফাইনালে ওঠে। ২০০৬, ২০১০ , ২০১৮ আর ২০২২ সালে ব্রাজিল বিদায় নিয়েছে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। প্রতিটা আসরেই ব্রাজিল বিদায় নিয়েছে ইউরোপের কোনো না কোনো দলের কাছে হেরে। ব্রাজিলের মরণফাঁদ যেন ইউরোপ। কাতার বিশ্বকাপের পর ব্রাজিলের কোচ তিতে পদত্যাগ করেন। সেই থেকে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের (সিবিএফ) বদ্ধমূল ধারণা, সেলেকাওদের বিশ্ব ফুটবলে আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন ইউরোপের ট্যাক্টিক্যাল ফুটবল। তাই সিবিএফ ধরনা দেয় হোসে মারিনিও, জিনেদিন জিদান আর লুইস এনরিকের দরবারে। যদিও তাদের পাওয়া যায়নি। শোনা যাচ্ছে, আগামী বছরের জুনে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে চুক্তি শেষে ব্রাজিলের দায়িত্ব নেবেন ইতালির কার্লো আনচেলত্তি।
আনচেলত্তির কোচ হওয়া নিশ্চিত না। তাই বছরের শুরুতেই যুব কোপা আমেরিকা শিরোপাজয়ী র্যামন মেঞ্জেসের কাঁধে তুলে দেওয়া হয় ব্রাজিলের দায়িত্ব। মেঞ্জেসের অধীনে দুর্বল গিনির সঙ্গে জিতলেও মরক্কো আর সেনেগালের কাছে পরাজয়ে ব্রাজিলের ফুটবলের কংকাল দৃশ্যমান হয়ে পড়ে। মরক্কোর বিপক্ষে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন কিছু ফুটবলার, যাদের ব্রাজিলের জার্সির ভার বইবার ক্ষমতা নেই। মেঞ্জেসকে দিয়ে ব্রাজিলের ফুটবল এগোবে না বুঝে যায় সিবিএফ। জুলাইয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের কোচ ফার্নান্দো দিনিজকে। দায়িত্বটা এক বছরের অন্তর্বর্তী। একই সঙ্গে ক্লাব ও জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করবেন দিনিজ। তার অভিষেক হয় সেপ্টেম্বরে মাঠে গড়ানো বিশ্বকাপ বাছাইয়ে। প্রথম ম্যাচেই বলভিয়াকে ৫-১ গোলে হারায় সেলেকাওরা। দ্বিতীয় ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে কষ্টার্জিত ১-০ গোলের জয় পায় ব্রাজিল।
কিন্তু পাশার দান উল্টে যায় অক্টোবরে। শুরুতে ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে নিজেদের মাঠে ড্র। পরবর্তী ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ০-২ গোলের পরাজয়। ম্যাচের ৪৪ মিনিটে ভয়াবহ ইনজুরিতে ছিটকে যান নেইমার। তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হবে ৮/৯ মাস। এ যেন মরতে বসা ব্রাজিলের ফুটবলে খাঁড়ার ঘা। ১৭ নভেম্বর ব্রাজিলের বিশ্বকাপ বাছাই পরীক্ষা কলম্বিয়ার বিপক্ষে। ২১ নভেম্বর চিরশত্রু আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মোকাবিলা। ব্রাজিল স্কোয়াডে নেই পরীক্ষিত ক্যাসিমিরো। তিনিও ইনজুরিতে। তাতে ব্রাজিল স্কোয়াড গড়তে হিমশিম খেতে হচ্ছে কোচ দিনিজকে। বাধ্য হয়ে দিনিজ দলে নিয়েছেন পাঁচজন নতুন ফুটবলার, যারা কখনো ব্রাজিলের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলেননি।
কিন্তু ব্রাজিলের এমন করুণ পরিণতি কেন? ব্রাজিলের ভিনি, রদ্রিগো, মার্তিনেল্লিরা তো ইউরোপে বেশ ভালো করছেন। তাহলে? আসলে ব্রাজিল দলে নেইমারের পর ভিনি ছাড়া বিশ্বসেরা হওয়ার মতো প্রতিভা নেই। সবাই মাঝারি মানের, যাদের নিয়ে বড় কোনো টুর্নামেন্টে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সেমি পর্যন্ত আশা করা যায়। তাছাড়া শিরোপা জিততে হলে একজন নেতার দরকার। ব্রাজিলের সেটা নেই। এক কথায়, ব্রাজিলের প্রতিটা পজিশনে বিশ্বমানের তারকার হাহাকার। তাই নিকট ভবিষ্যতে ব্রাজিলের ফুটবল সংকট কাটিয়ে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করবে, এমন আলামত দেখা যাচ্ছে না। বরং ব্রাজিলের ফুটবল ক্রমশ ধাবিত অন্ধকারের দিকে।