ফাহিম ফয়সাল
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০২:২৩ পিএম
ঢাকিদল। ছবি: সংগৃহীত
সারা বছর মাটির ব্যাংকে টাকা জমাতাম দুর্গাপূজার মেলার জন্য। একটি বছর বহু যত্নে আগলে রাখা প্রিয় লাল টুকটুকে রঙের মাটির ব্যাংকটি ঘরের মেঝেতে আছড়ে ভেঙে ফেলতাম বাড়ির নিকটবর্তী পূজামণ্ডপে ঢাক বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই। হ্যাঁ, ঢাকের প্রথম শব্দেই জেনে যেতাম দুর্গাপূজা শুরু হয়ে গেছে!
মন উতলা করা ঢাকের শব্দে প্রিয় মাটির ব্যাংকটির ভেঙে চুরমার হওয়ার শব্দ ও কষ্ট ঢাকা পড়ে যেত। এই ভাঙনের শব্দ ঢাকের শব্দ হয়ে উঠত আনন্দ-ভৈরবী। ভেতরে কী এক অস্থিরতা টগবগ করে উঠত-কখন যাব মেলায়? কখন? আমার ও আমার বন্ধুদের কাছে দুর্গাপূজার মূল দুটি আকর্ষণই ছিল মেলা এবং মেলায় যাওয়ার পথে এলাকার একমাত্র জমজমাট পূজামণ্ডপে বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত ঢাকিদলের হৃদয়ছোঁয়া বাজনা।
পূজামণ্ডপের আঙিনায় চারিদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ঢাকিদের বাজনা মুগ্ধ হয়ে শুনত ছেলে, বুড়ো, মহিলা, শিশুসহ সকলেই ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে। ঢাকিরাও মনের আনন্দে বাজাত! দেখে মনে হতো কী এক আনন্দ মেলা বসেছে এই মণ্ডপস্থলে। মন্দিরের বিলানো প্রসাদ ছাড়াও ঢাকিদের এই আনন্দপ্রসাদ বিলানোর দৃশ্যটা সারা বছর চোখে আর মনে লেগে থাকত। পরের বছর আবার সেই আনন্দপ্রসাদের অপেক্ষায়! দুর্গাপূজার সেই কয়েকটা দিন এলাকা উৎসবমুখর থাকত, যেন কোথাও কোনো বেদনা নেই, বিষাদ-কলহ নেই। যেন পুরো এলাকা এক আনন্দধাম!
ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলাম। আমার দেখার চোখ তৈরি হতে থাকল। ঢাকিরা প্রতিবছর কোথা থেকে আসে? আবার কোথায় ফিরে যায় পূজা শেষে? এমন প্রশ্ন উঁকি দিল মনে। বন্ধুদের কেউ উত্তর দিতে পারে না। শুধু বলে অনেক দূরের গ্রাম থেকে আসে ওরা। আমার মনে হতো ঢাকিরা দূরের গ্রাম থেকে আসা ‘অদ্ভুত মানুষ’! আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নয়। কল্পনার চোখে দেখতে পাই, অনেক দূরে শালবাগানের পাশে ঢাকিদের গ্রাম। গ্রাম জুড়ে আনন্দের স্রোতধারা বয়ে চলেছে। সেখানে ছোট-বড়, পুরুষ-নারী সকলেই মনের আনন্দে ঢাক-ঢোল, মাদল বাজায়; আনন্দ করে। সেখানে জাগতিক কোনো কষ্ট নেই। পূজায় তারা আসে আমাদের একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য। আমার চলে যেতে ইচ্ছে করে তাদের গ্রামে। মনে মনে পরিকল্পনা করি আরেকটু বড় হলেই কোনো এক দুর্গাপূজার শেষে ঢাকিদের সঙ্গে চলে যাব তাদের আনন্দগ্রামে।
দুর্ভাগ্যবশত আর সব স্বপ্নের মতো ঢাকিদের আনন্দগ্রামে যাওয়ার সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হয়নি কখনোই! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ‘আবৃত্তি শিল্পের’ সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সুবাদে ছন্দ, তাল, লয় প্রভৃতি সম্পর্কে একটু-আধটু ধারণা নিতে হয়েছিল। যিনি আবৃত্তি শেখাতেন তিনি রিদম বোঝাতে গিয়ে বললেন ‘পূজার সময় ঢাকিদের বাজনা শুনবেন বসে বসে, তাহলে দেখবেন আপনার ভেতরেও রিদম তৈরি হবে।’ আমি তারপর থেকে প্রতি পূজায় ঢাকিদের বাজনায় রিদম খুঁজে পেতে শুরু করলাম। অনুভব করলাম দুর্গাপূজার অনুষঙ্গ এই ঢাক সংগীত ও শিল্পের প্রাথমিক জ্ঞান কি নিভৃতে গ্রথিত করে চলেছে আমাদের আনন্দ-পিয়াসী হৃদয়ে!
বছর খানেক আগে ইউটিউবে একটা ভিডিও ডকুমেন্টারি দেখছিলাম যেখানে বলা হচ্ছিল, ‘কান পাতলে প্রত্যেক বস্তুতেই সংগীতের আনন্দ পাওয়া যায় এবং সেসব সংগীতের মধ্যে জীবনযুদ্ধের জন্য জাগরণস্পৃহা বা চলনশক্তি বিপুলভাবে বিদ্যমান। এই সংগীত বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়।’ এই ভিডিওতে ভারতের কোনো এক পূজামণ্ডপে বাজনারত ঢাকিদের বাজনার একটা অংশ ছিল। সত্যিই সেই বাজনার ভেতরে যেন জীবনের ধ্বনি শুনতে পেলাম! মিলে গেল যেন সেই কথা, ‘ঢাকের বাদ্যে রয়েছে জীবনঘড়ির প্রবহমানতা (রিদম) আর সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে হাসিমুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি।’ জীবনের ছন্দ আর সুর বুঝে ফেললে দুঃখ-কষ্টকে জয় করা যায় এমন এক জীবনদর্শন ঢাকিদের বাজনায় খুঁজে পেলাম এতদিন পর। অথচ ছোটবেলায় ঢাকের আনন্দ-শব্দে মাটির ব্যাংকের ভাঙনের বেদনা চাপা পড়ে হারিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েও সেই একই শিক্ষা আমি পেয়ে গিয়েছিলাম; কিন্তু তখন তা উপলব্ধি করতে পারিনি!
এই যে যুগ যুগ ধরে ঢাকিদের আনন্দপ্রসাদ আমরা ভোগ করে চলেছি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই। এই যে তারা ঢাক ও ঢোলের ছন্দে, তালে এবং সুরে আমাদের হৃদয়ে জমে থাকা বেদনার অন্ধকার দূর করে চলেছেন। এই যে দুর্গাপূজাসহ বিভিন্ন উৎসব পার্বণে আমরা ঢাকিদের আমন্ত্রণ করে আনছি নিজেদের পরিবার পরিজনের আনন্দ বিনোদনের নিমিত্তে; পূজা শেষে তারা কোথায় ফিরে যায়? তাদের সারাটি বছর কীভাবে কাটে? তাদের পরিবার-পরিজন কীভাবে বাঁচে? ঢোলের শব্দে কি উদরপূর্তি হয় তাদের? এদের গ্রাম কি সত্যিই আমার শৈশবের অনুমিত আনন্দগ্রাম? বাজনারত অবস্থায় কখনো কি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি আমরা? সেখানে কি দারিদ্র্যের বিষাদ-রেখা? নাকি আনন্দপ্রসাদ বিলোবার অসীম তৃপ্তি? বাপ-দাদার পেশাকে সম্মান জানিয়ে আপনার স্ত্রী-সন্তানের আনন্দদানের এই গুরুভার বহন করতে গিয়ে নিজগ্রামে ফেলে আসা নিজ স্ত্রী-সন্তানকে তিনি বঞ্চিত করছেন না তো? ঢোল আর ঢাকগুলোকে নতুন পোশাক পরিয়েছেন তারা ঠিকই; কিন্তু তাদের পরিবারের সদস্যরা নতুন পোশাক পরতে পেরেছেন কি এবারের পূজায়? তিনি সুকান্তের কবিতার সেই ‘অদ্ভুত বাতিওয়ালা’ নয় তো, যিনি পুরো শহরে আলো জ্বালিয়ে ফেরেন, অথচ তার ঘরেই থাকে জমাট অন্ধকার?
শিল্পীর তকমা কি দিয়েছি আমরা তাদের কখনো? নিদেনপক্ষে পূজার দিনগুলোতে মণ্ডপের মাইকে কিংবা আরতি প্রতিযোগিতা শুরুর পূর্বে পরিচিত করিয়ে দিয়েছি কি তাদেরকে আগত দর্শনার্থীদের সামনে? বহুযত্নে প্রকাশিত চাররঙা রুচিশীল নান্দনিক পূজাসংখ্যার মণ্ডপণ্ডপত্রিকায় এই ঢাকিদের নাম উল্লেখ করলে কি ম্লান হয়ে যাবে তার সাহিত্যমান কিংবা সৌন্দর্য? তাদেরকে অযত্নে, অবহেলায়, উপেক্ষায় ফেলে পারব কি আমরা দুর্গাপূজাকে প্রকৃত অর্থেই ‘সর্বজনীন উৎসবে’ পরিণত করতে? নামমাত্র সম্মানী আর পোশাক দিয়ে এই মানুষগুলোকে পারব কি আমরা ধরে রাখতে এই মহৎ পেশায়? ভাবুন তো একবার-দুর্গাপূজা হচ্ছে মণ্ডপে মণ্ডপে, সেখানে ঢাকের বদলে বাজছে ড্রাম আর ইলেকট্রিক গিটার! শুনতে পাচ্ছেন ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া ঢাকের শব্দ! শুনুন, উঁহু, কান পেতে নয়, হৃদয় পেতে শুনুন...!