স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:১৭ এএম
প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে মণিপুর ছবি: সংগৃহীত
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে জাতিগত সংঘাতের সহিংস দাবানল শুরু হয় সাড়ে ছয় মাস আগে। এ সময়ে পরিস্থিতির খুব সামান্য পরিবর্তনই হয়েছে। মেইতি ও কুকি জাতিসত্তার লোকজনের পক্ষ থেকে এখনো নতুন করে সহিংস ঘটনা বা নানা উত্তেজক পদক্ষেপ চলছে। অথচ এ অবস্থা বদলাতে এবং সহিংসতাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কিছুই করা হয়নি।
মণিপুরে গত ৩ মে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিগত বিভক্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এতে নিহত হয়েছেন শত শত মানুষ এবং আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এ ছাড়া বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। এরপর থেকে কুকি বিধায়ক এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা তাদের জন্য একটি পৃথক অঞ্চলের দাবিতে মোদি সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছিল। তারা একাধিকবার বলেছিলেন, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এন বীরেন সিংয়ের অধীনে মেইতি-সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার তাদের আস্থা হারিয়েছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে এবার রাজ্যটির তিনটি জেলায় স্বায়ত্তশাসনের ঘোষণা দিয়েছেন মণিপুরের কুকি সংগঠন ইন্ডিজেনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরামের (আইটিএলএফ) নেতারা। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মুয়ান টম্বিং জানিয়েছেন, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় তারা একটি ‘স্ব-শাসিত পৃথক প্রশাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত। কেন্দ্র এর স্বীকৃতি না দিলেও তারা আলাদা প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করবেন।
আদিবাসীদের জন্য আলাদা প্রশাসন করার দাবি করা হয়েছিল। চলতি বছরের মে মাসে শুরু হয় মণিপুরে জাতিগত হিংসা। তারপরই সেখানে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেই সময়েও সেখানে আদিবাসীদের জন্য পৃথক প্রশাসন গঠন করার দাবি তুলেছিলেন আদিবাসী সংগঠনের নেতারা। কিন্তু তা যে সম্ভব নয় তা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মণিপুর রাজ্যকে যে ভাগ করা হবে না তাও পরিষ্কার করেই জানিয়ে দেন তিনি। কিন্তু এবার কোনো কথা শুনতে রাজি নয় আদিবাসীদের সংগঠন। ‘কুকি-জো আদিবাসীদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার’ তদন্তের দাবিতে চুড়াচাঁদপুরে ১৫ নভেম্বর একটি গণসমাবেশ হয়। সেখানে মুয়ান টম্বিং বলেন, ‘আদিবাসীদের জন্য আমরা আলাদা প্রশাসনের দাবি জানিয়েছিলাম। ছয় মাসেরও বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু মণিপুর সরকারের তরফে একটি পৃথক প্রশাসনের জন্য আমাদের দাবির বিষয়ে কিছুই করা হয়নি। যদি দুই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের দাবি মানা না হয় তাহলে আমরা নিজেদের সরকার এবং প্রশাসন গঠন করব। টেংনুপাল, কাংপোকপি এবং চুড়াচাঁদপুর জেলার কুকি জনগণ স্ব-শাসনের আওতায় আসবে। আর কেন্দ্র স্বীকার করুক বা না করুক, আমরা এই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাব।’
তারা যে স্ব-শাসিত প্রশাসন গঠন করবে, সেটা আলাদা রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হতে পারে বলেও জানিয়েছেন আদিবাসী সংগঠনের নেতারা। সেখানে কুকি আদিবাসীদের বিষয়টি দেখা হবে। এর আগেও শাসক দল বিজেপির ১০ জন আদিবাসী বিধায়ক আলাদা প্রশাসনের দাবি করেছিলেন। এদিকে রাজ্যের তিনটি জেলায় স্বায়ত্তশাসনের ঘোষণা দেওয়ায় গত ১৬ নভেম্বর মুয়ান টম্বিংয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে রাজ্য সরকার। চুড়াচাঁদপুর থানায় এই মামলা দায়ের করা হয়। গত ১৮ নভেম্বর মণিপুর সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্ব-শাসন’ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য কুকি সম্প্রদায়ের সংগঠনের একজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
চুড়াচাঁদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এন থাংজামুয়ান এই মামলা দায়ের করেন। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র বা যুদ্ধ করার চেষ্টা করা বা যুদ্ধে মদদ দেওয়া, রাষ্ট্রদ্রোহ, দাঙ্গা এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ঘটাতে ইচ্ছাকৃতভাবে উসকানি দেওয়াসহ ফৌজদারি আইনের ১২১এ, ১২৪এ, ১৫৩ এবং ১২০বি ধারায় মামলা করা হয়।
এসব ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে, কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরে প্লট হারাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থতার পরও সরকার বিজেপির নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন না করে একটি ক্ষীণ শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। নেতৃত্বের পরিবর্তন অন্যদের পাশাপাশি কুকি জাতিসত্তার প্রতিনিধিদের একটি মূল দাবি। কেন্দ্রীয় সরকার এখনো ইম্ফল উপত্যকা ও পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চলে সহিংসতা দমন করতে আধাসামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করেছে। তারা রাজ্যে ৩৫৫ ধারার বিধানের আশ্রয় নিয়েছে। এই পদক্ষেপটি কার্যত মেইতিদের সমর্থন ধরে রাখার জন্য করা হয়েছে, যারা রাজ্য সরকারে নেতৃত্বের কোনো পরিবর্তনের অনুমতি দিতে এবং রাজ্য পুলিশের প্রতি কুকি জনগণের অবিশ্বাসের সমাধান করতে অস্বীকার করেছে। এই বাস্তবতা উভয় পক্ষের বিভাজনকে তীক্ষè করে তুলেছে। জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে একটি স্থায়ী শান্তি ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ প্রক্রিয়ার সূচনা করা যেত, যা মানুষের প্রত্যাবর্তনকে সহজতর করবে; কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এমনকি বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে, শান্তি প্রক্রিয়াকে দেশান্তরী করেছে।
এদিকে মণিপুরে কমিটি অন ট্রাইবাল ইউনিটির পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, ১৫ নভেম্বর মাঝরাত থেকেই জাতীয় সড়কে এই অর্থনৈতিক অবরোধ শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। আদিবাসী নারীরা মণিপুরে খুব তাড়াতাড়ি শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন। আদিবাসী সংগঠনের নেতাদের দাবি না মানলে আরও বড় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কমিটি অন ট্রাইবাল ইউনিটি জানিয়েছে, মণিপুরে ২ নম্বর এবং ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়কে ‘অনির্দিষ্টকালীন অর্থনৈতিক অবরোধ’ চলবে।
মণিপুরের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে কুকি জাতিসত্তার দুজনকে। মেইতি সম্প্রদায়ের দুজন নিখোঁজ থাকার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ওই দুজনকে। আগেই তাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে কাংপোকপি এলাকায় ৪৮ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছিল আদিবাসীদের ওই সংগঠন। কিন্তু তাদের ছাড়া হয়নি। এর প্রতিবাদে গত ১৪ নভেম্বর কাংপোকপির গামগিফাই এলাকায় অবস্থান বিক্ষোভ করে কুকি জাতিসত্তার নারীরা। সেখানেই এই অর্থনৈতিক অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আদিবাসী সংগঠনের নেতাদের দাবি, সেখানে কুকি অধ্যুষিত এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন। কমিটি অন ট্রাইবাল ইউনিটি বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি অর্থপূর্ণ সমাধানের জন্য আন্দোলন করছে। কিন্তু তাদের দাবিগুলো ধারাবাহিকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই অন্য কোনো উপায় না পেয়ে তারা আবার জাতীয় সড়কে এই অবরোধ শুরু করেছে। এর জেরে কোনো সমস্যা হলে তার জন্য মণিপুরের সরকার দায়ী থাকবে বলেও জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে লক্ষ্য করে মণিপুর নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন কেরলার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। তিনি বলেন, ‘উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই কেন্দ্রীয় সরকারের। মণিপুর সহিংসতার ৮০ দিন পর প্রধানমন্ত্রী মোদি শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। যখন প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো মণিপুরের আসল খবর এড়িয়ে যাচ্ছিল, তখন সাংবাদিক কালিভায়ালিলে সেখানকার মানবিকতার বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া তথ্যগুলো নথিভুক্ত করে বইয়ের আকারে প্রকাশ করেছেন। বিগত ৬ মাস ধরে মণিপুর বিপর্যস্ত। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় এটাই যে, বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম মণিপুরে যাওয়ার সময় পায়নি; কিন্তু তারা ইসরাইলের যুদ্ধের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে খবর কভার করতে চলে গেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, মিডিয়াগুলো কাদের স্বার্থে সারিবদ্ধভাবে কাজ করছে। বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মণিপুরে গেলেও প্রধানমন্ত্রী, কেবিনেট মন্ত্রীরা যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।’