শীতল যুদ্ধের ভূত কীভাবে তাড়ানো যাবে

অনিন্দ্য আরিফ

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৩৩ এএম

গত সপ্তাহে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে বৈঠক হয়।  ছবি: বিবিসি

গত সপ্তাহে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে বৈঠক হয়। ছবি: বিবিসি

১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতাকে নতুন শীতল যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করার এক ধরনের জোর প্রচারণা রয়েছে। নিঃসন্দেহে ২০১০ সালের পর থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেটাকে কেন্দ্র করে চীন ও রাশিয়ার পারস্পরিক সম্পর্কে বহু ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭২ সালে চীনের চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বৈঠকের পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে সেটা আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই, এটাও সত্যি। কিন্তু এখন এই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যদি শীতল যুদ্ধে পরিণত হয়, তাহলে তাদের এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মেরুকরণে বিশ্ব রাজনীতির বাস্তবতা দুই দিকে মোড় নিতে পারে। 

এই সম্পর্ককে যদি যথাযথভাবে পরিচালনা করা যায়, তাহলে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ফল আনতে পারে। আর যদি সে ক্ষেত্রে অনমনীয়তা আর আগ্রাসী মনোভাবের সঙ্গে এই সম্পর্ককে পরিচালনা করা হয়, তাহলে তার ফল আগের শীতল যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। 

এখনকার পরিস্থিতি অনেকভাবেই শীতল যুদ্ধের মতোই দৃশ্যমান হচ্ছে। গত বিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষ ৫০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন দুই মেরুর পরাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করছিল, এখন সেরকম পরাশক্তি হিসেবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা নিতে পারে। আগের শীতল যুদ্ধে যেমন এই দ্বিপাক্ষিক প্রতিযোগিতায় একটি মতাদর্শিক ভিন্নতা ছিল, এখনো চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একচ্ছত্র শাসন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ এবং সাম্যবাদ অভিমুখ যাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের বিপরীত অবস্থানেই রয়েছে। এখনকার বেইজিং ও ওয়াশিংটন যেমন ‘বৈশ্বিক দক্ষিণ’ বলয়ে নিজেদের প্রভাব ও সমর্থনের কেন্দ্রস্থল তৈরি করতে চাইছে, আগেকার শীতল যুদ্ধেও একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র ‘তৃতীয় বিশ্ব’-এর বলয় তৈরি করেছিল।  

কিন্তু এই মিলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতাও রয়েছে। বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও চীন সেভিয়েত ইউনিয়নের মতো একই ধরনের মার্কসবাদী পথে হাঁটছে না। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদের নেতৃত্বদায়ী লেনিনবাদী তত্ত্বকে ভিন্নতার সঙ্গে প্রয়োগ করছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতাপূর্ণ প্রতিযোগিতা চললেও তা মস্কো-ওয়াশিংটনের বৈশ্বিক মতাদর্শিক লড়াইয়ের মতো তীব্র নয়। এখনকার বৈশ্বিক পরিস্থিতির জটিলতা অনুধাবন করে চীন সচেতনভাবেই সোভিয়েত মডেল এড়িয়ে ভিন্নভাবে চলছে।

আগের শীতল যুদ্ধ যেমন একটি বিশ্বায়িত দুনিয়াকে মাথায় রেখে চলছিল, এখনকার চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতা একটি অবিশ্বায়িত এবং বিভক্ত দুনিয়ার রাজনীতির মধ্যে এগিয়ে চলছে। ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল সংকটের পর থেকে মস্কো এবং ওয়াশিংটন এরকম সংকট পরিহারের যেসব নীতি এবং কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সেরকম সমন্বয় অনুপস্থিত।

গত সপ্তাহে সান ফ্রানসিসকোতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে যে বৈঠক হলো, তাতে বর্তমান দুই পরাশক্তির শীর্ষ ব্যক্তিরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি স্থিতিশীল গতিপথ নির্ধারণ এবং বিপর্যয়কর সংঘাত এড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন। এর আগেও বহুবার এই দুই নেতা আবার একটি শীতল যুদ্ধের পরিস্থিতি এড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। বাস্তবিক অর্থেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থেই এ ধরনের নতুন শীতল যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করার বিপক্ষে। 

এরকম একটি প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন একটি শীতল যুদ্ধ এড়ানোর বিষয়ে বেশ কিছু অভিমত দিয়েছেন। বিশেষ করে নিম্নোক্ত পাঁচটি উপায়ে এই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও স্থিতিশীল করা যায় এবং সংঘাত এড়িয়ে চলা যায়।

প্রথমত এখনো দুই দেশের অর্থনীতি নিজেদের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখন দুই দেশের বিভিন্ন বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে অযৌক্তিক ও উৎপাদনবিরোধী নীতি প্রতিহত করে যৌথতার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে।

দ্বিতীয়ত তাইওয়ান নিয়ে বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যকার উত্তেজনা সৃষ্টিকারী নীতিসমূহকে এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বেইজিং সবসময় শান্তিপূর্ণ একত্রীকরণের ওপর জোর দিয়ে আসছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র এবং তাইওয়ানের ক্ষমতাসীনদের এমন কোনো আচরণ বা কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত নয়, যাতে চীন এই শান্তিপূর্ণ উপায় থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়।  

তৃতীয়ত নতুন শীতল যুদ্ধের ভূত তাড়ানোর জন্য বেইজিং এবং ওয়াশিংটন এখন শীতল যুদ্ধের সময়ে ওয়াশিংটন ও মস্কোর সামরিক নেতৃত্বের মধ্যকার সংকটকালীন বিভিন্ন সমঝোতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সদর দপ্তরের মধ্যে একটি গভীর উষ্ণতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা যায়। এখানে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ঝুঁকি নিরসনে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

চতুর্থত এই দুই দেশ স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন এবং নিজেদের নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য নানামুখী যৌথ উদ্যোগ নিতে পারে। গত সপ্তাহে শেষ হওয়া শি এবং বাইডেনের মধ্যকার বৈঠকে ক্ষতিকর ফেনটানিল মাদকের ভয়াবহ বিস্তার হ্রাসের একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই চুক্তি এ বিষয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে। এভাবে বৈশি^ক স্বাস্থ্য খাতের আরও অনেক বিষয় আছে, যেখানে এই দুই দেশের যৌথতা সারা বিশ্বের মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচতে ভূমিকা রাখতে পারে।

পঞ্চমত বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব রোধে দুই দেশের যৌথতা বড় ধরনের সুফল বয়ে আনতে পারে। এই নভেম্বরের প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জলবায়ু উপদেষ্টা জন কেরি এবং চীনের জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক প্রতিনিধি দলের প্রধান শিয়ে ঝেনউয়ানের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনে যৌথ উদ্যোগের একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এভাবে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প উৎসগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি এবং কার্বন নিঃসরণের কার্যকর পদক্ষেপ ও নীতি যৌথভাবে গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে পারলে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব রোধে তা ভালো ফল আনতে পারে। 

নতুন শীতল যুদ্ধ এড়ানোর জন্য গত সপ্তাহে শি-বাইডেন বৈঠক একটি আশার আলো তৈরি করেছে। তবে এ রকম কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না, যদি নিজেদের বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারের স্বার্থে তারা লাগাম না টানতে পারে। তবে বৈশ্বিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য এই দুই পরাশক্তি যদি নতুন শীতল যুদ্ধের পথ থেকে সরে আসে, তবে সেটাই হবে শুভবুদ্ধির পরিচায়ক।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh