মনের ময়নাতদন্ত

পেনাল্টি নেওয়ার সময় খেলোয়াড়ের মাথায় কী ঘটে

জাহাঙ্গীর সুর

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪৩ পিএম

পেনাল্টি নেওয়ার সময় এক ধরনের চাপের পরিবেশ তৈরি হতে দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত

পেনাল্টি নেওয়ার সময় এক ধরনের চাপের পরিবেশ তৈরি হতে দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত

কোনো ম্যাচে প্রিয় দল যখন পেনাল্টি পায়, খুশি হয় ভক্তরা। পেনাল্টি নেওয়ার সময় এক ধরনের চাপের পরিবেশ তৈরি হতে দেখা যায় খেলোয়াড়দের চেহারায় ও দর্শকের মনে।

বিশেষ করে, ওই পেনাল্টি যদি জয়নির্ধারণী বা জয়সূচক হয়, তাহলে চাপ যেন মনে হয় পাহাড়সম। এমনকি অতিআবেগী ভক্ত চাপে মুখ ফিরিয়ে রাখে পেনাল্টি শুটআউটের দিক থেকে, রেফারির বাঁশি বাজলে ফিরে চায় মাঠের দিকে-উচ্ছ্বাসে কিংবা হতাশবদনে। গোল দিতে/রুখতে পারলে খেলোয়াড়রা উল্লাসে মেতে ওঠেন; ব্যর্থ হলে মুষড়ে পড়তে দেখা যায় পেনাল্টি শুটার কিংবা গোলরক্ষককে। 

এমন দৃশ্য প্রায় নিয়মিতই মঞ্চস্থ হতে দেখা যায় বিশেষত হাই-ভোল্টেজ আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে পেনাল্টি শুটআউট সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ও উচ্চ চাপযুক্ত এক ক্রীড়া পরিস্থিতি। কিন্তু পেনাল্টির সময় এত চাপের আবহাওয়া তৈরি হয় কেন? বিশেষত যিনি পেনাল্টি নেন বা যে গোলরক্ষক তা ঠেকাতে চেষ্টা করেন, তাদের কতটা মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে হয়? এ চাপ সামলানোর কি কোনো মনোবৈজ্ঞানিক উপায় আছে? পেনাল্টি মিস হয়ে গেলে শুটারের মস্তিষ্কে আসলে কী ঘটে? মনোবৈজ্ঞানিক ও মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণার আলোকে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এ লেখায়। 

ফুটবলের নাটকীয় মুহূর্ত 

ডেভিড বেকহাম ও মাইকেল ওয়েনের কথা স্মরণ করা যায়। দুজনই সাবেক ইংরেজ ফুটবলার। প্রথমজন ফ্রি-কিকের জন্য প্রখ্যাত, যিনি কিনা ‘চীনের প্রাচীর’ও ভাঙতে সমর্থ ছিলেন। দ্বিতীয়জন ১৯৯৮ সালে তার বিশ্বকাপের অভিষেক আসরে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জাদুকরী গোল করে, বিশেষত আর্জেন্টিনাবিরোধী ফুটবল দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন; কিন্তু ওই ‘বিস্ময়বালক’-এর খেলোয়াড়ি জীবনের অবসান ঘটে মাত্র ২৫ বছর বয়সেই, সেজন্য তাকে ‘ইংরেজ ফুটবলের আফসোস’ও বলে থাকেন কেউ কেউ। এই দুজন স্ট্রাইকারই নিজের জীবনের কথা আপন বয়ানে চিত্রিত করেছেন ‘ডেভিড বেকহাম : মাই সাইড’ ও ‘মাইকেল ওয়েন : অফ দ্য রেকর্ড’ গ্রন্থে। আত্মজীবনীতে তারা সহজ ভাষায় স্বীকার করে নিয়েছেন, হাই-ভোল্টেজ আন্তর্জাতিক ম্যাচে পেনাল্টি নেওয়ার আগ মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা বা সঠিকভাবে দম পর্যন্ত নিতে পারতেন না তারা।

এজন্য পেনাল্টি শুটআউটকে আন্তর্জাতিক ফুটবলের ‘সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনাবলির অন্যতম’ বলে অভিহিত করেছেন ফুটবল গবেষকরা।

সাফল্যের সূচকসমূহ

পেনাল্টি কিংবা কিক নেওয়া সফল হবে কি না তা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি সূচকের উপর। যেমন-মনস্তত্ত্ব, দক্ষতা, শারীরতত্ত্ব ও সুযোগের উপর। এখানে শুটারের মনস্তত্ত্ব বলতে তিনি কতটা চাপ সামলাতে পারেন; দক্ষতা বলতে তার কিক মারার কৌশল; শারীরতত্ত্ব বলতে ১২০ মিনিট পর্যন্ত খেলার ক্লান্তি কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা; আর সুযোগ বলতে গোলরক্ষক কোনদিকে ঝাঁপ দিতে পারেন-শুটারের সেই আন্দাজ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনাকে বোঝানো হচ্ছে।

পেনাল্টি ও কিক নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। এরকমই একটি গবেষণা করেছেন নেদারল্যান্ডসের একদল গবেষক। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন গাইর জরডেট। ২০০৭ সালে যখন গবেষণাটি প্রকাশ হয়, তখন তিনি গ্রনিঞ্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হিউম্যান মুভমেন্ট সায়েন্সেসের গবেষক। একই প্রতিষ্ঠানের এস্তার হার্টম্যান, ক্রিস ভিশার ও কোয়েন লেমিংক ছিলেন তার সতীর্থ গবেষক। তাদের এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোয় পেনাল্টি কিক কতটা সফল হবে, তার আপেক্ষিক গুরুত্ব অনুমান করা। এর জন্য তারা ইন্টারনেটভিত্তিক গেমের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেছিলেন। 

১৯৭৬ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে বিশ্বকাপ, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং কোপা আমেরিকায় নেওয়া ৪১টি পেনাল্টি শুটআউট ও ৪০৯টি কিক নিয়ে তারা গবেষণা করেছিলেন। ফুটবলের পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করে এমন ইন্টারনেট সাইটগুলো থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছিল। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় কিকগুলোর গুরুত্ব (যা চাপের নির্দেশক) সফলতা বা নৈপুণ্যের সঙ্গে নেতিবাচকভাবে সম্পর্কিত ছিল এবং দক্ষতা ও ক্লান্তি কম সম্পর্কিত ছিল বা কোনো সম্পর্কই ছিল না। গবেষণাটি থেকে এই উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে, মানসিক ব্যাপারগুলো পেনাল্টি কিকের সাফল্য বা ব্যর্থতায় সবচেয়ে প্রভাবশালী। 

সেরাদের সেরাও কেন ব্যর্থ হন

গোলরেখা থেকে মাত্র ১২ গজ দূর হতে কিক নিতে হয়। সামনে কেবলই একজন থাকেন, গোলরক্ষক। কিন্তু এই সহজ কাজটিই মানে জালে বল পাঠাতে গিয়ে বিশেষত বড় ম্যাচগুলোয় গুলিয়ে ফেলেন দক্ষ ফুটবলাররাও। লিওনেল মেসি, যাকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় বলা হচ্ছে, অনেক পেনাল্টি মিস করেছেন; তিনি ২০১৬ সালের ২৬ জুন কোপা আমেরিকার ফাইনালে শুটআউটে পেনাল্টি মিস করেন। তার আর্জেন্টিনা দল সার্বিকভাবে চিলির কাছে ৪-২ গোলে হেরে গিয়েছিল। 

কেন দক্ষ ও সেরা ফুটবলাররা পেনাল্টি মিস করেন এ নিয়ে গবেষণা করেছেন রিসেপ গরগুলু, অ্যান্ড্রু কুক ও টিম উডম্যান। তারা তিনজনই ওয়েলসের ব্যাঙ্গর ইউনিভার্সিটির ক্রীড়া ও নৈপুণ্য মনোবিজ্ঞানের গবেষক। এ সংক্রান্ত তাদের একটি গবেষণা ২০১৯ সালে প্রকাশ হয় জার্নাল অব স্পোর্ট অ্যান্ড এক্সারসাইজ সাইকোলজিতে। কী জানা গেছে তাদের গবেষণা থেকে? 

গুরুত্বপূর্ণ খেলায় পেনাল্টি নেওয়ার সময় শুটাররা যে জিনিসটা এড়িয়ে চলতে চান, তাদের গবেষণা বলছে, খেলোয়াড়রা বরং ধারাবাহিকভাবে ওই ভুলটাই করে বসেন। দেখা যায়, একজন খেলোয়াড় ইউরো ২০১৬-এর মতো টুর্নামেন্টে পেনাল্টি স্পটে শুটাররা যখন বল রাখেন, তখন তারা বেশিরভাগ সময়ই নিজেকে বলেন, ‘কিক নেব বাঁ দিকে, কিন্তু খেয়াল রাখব যেন বাঁ পোস্টে লেগে বল ফিরে না আসে।’ 

কিন্তু ম্যাচ যখন বড় হয়, স্টেডিয়ামে উপচে পড়া দর্শক, আবার টেলিভিশন সেটে অপলক তাকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ চোখ, সবাই তাকিয়ে দেখছে-কী হয় কী হয়! গোল হবে তো, পক্ষের দর্শকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। যেন গোলরক্ষক আগেই আটকে দিতে পারে বলকে, মনে মনে প্রার্থনায় বসে পড়ে প্রতিপক্ষের দর্শকরা। 

তো, বাঁ দিকে মারব, তবে বাঁ পোস্ট ছোঁয়াব না-এই লক্ষ্যে কিক নেন যে শুটাররা, তাদের মধ্যে যারা অসফল হন, তাদের বেলায় দেখা গেছে, তারা বাঁ পোস্ট এড়াতে গিয়ে আসলে খুব প্রশস্ত কিক নেন না। মানে, এমন একটা কিক নেন, যা গোলরক্ষক সহজেই হাতের নাগালে পেয়ে যান। এটাকে গবেষকরা ‘পরিহাসমূলক ত্রুটি’ (আইরোনিক এরর) বলে অভিহিত করেছেন।

পরিহাসমূলক ত্রুটি ও খেলোয়াড়ের মস্তিষ্ক 

সেরা সেরা খেলোয়াড় কেন এই ত্রুটির শিকার হন? মস্তিষ্ক যখন শরীরকে একটি বিশেষ পছন্দসই উপায়ে কার্য সম্পাদন করাতে চায়, তখন এটি দুটি প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে-কার্যনির্বাহী প্রক্রিয়া ও পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া।

আমাদের পছন্দসই ফল তথা লক্ষ্য অর্জন করতে যা যা পদক্ষেপ দরকার তা শনাক্ত করা কার্যনির্বাহী প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে। ধরুন, একজন শুটার পেনাল্টি নেবেন। তখন তিনি পেনাল্টি স্পট থেকে কয় কদম পিছিয়ে দাঁড়াবেন, কীভাবে দৌড়াবেন, বলের পাশে নন-স্ট্রাইকিং পা কীভাবে লাগাবেন এবং কোন দিক দিয়ে কীভাবে গোল করবেন-এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যনির্বাহী প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়বে। 

একই সময়ে, পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়াও অবচেতনভাবে সক্রিয় থাকে। এই ক্ষেত্রে, পেনাল্টি নেওয়ার সময় কী কী ভুল হতে পারে, যেমন পোস্টে লেগে বল ফিরে আসতে পারে-এমন চিন্তাভাবনা শুরু হয়। যখন কোনো ঝুঁকি চিহ্নিত হয়ে যায়, মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে দেয় কার্যনির্বাহী প্রক্রিয়াকে, এমন তথ্য বা পথ খুঁজে বের করার জন্য আরও কঠোর চেষ্টা করার সংকেত দেয় যেন সবকিছু পরিকল্পনা মতো ঘটে। মানে, এই ক্ষেত্রে যেন পেনাল্টি সফল হয়। উভয় প্রক্রিয়া একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে কাজ করে এবং প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থার অংশ হিসেবে একসঙ্গে কাজ করে। 

মস্তিষ্কের এই কার্যপ্রণালি সাধারণত প্রকৃত অর্থেই কাজ করে। আমরা যা করতে চাই তা করার জন্য আমাদের কার্যকর মানসিক নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে থাকে এই ব্যবস্থা। এর অর্থ হলো-প্রশিক্ষণের সময় পেনাল্টির জন্য সারি হয়ে দাঁড়ানো খেলোয়াড়রা বাঁ পোস্টের ধার ঘিরে জালের কোণে বল জড়ানোর লক্ষ্য ঠিক করবেন, দৌড়াবেন, বলে স্ট্রাইক করবেন এবং বাঁ কোণ গলে জালে জড়িয়ে যাবে বল। আর এমন নির্ভুলতায় ওই শুটার বিস্মিত হবেন। 

কিন্তু ইউরো ২০১৬-এর মতো একটি প্রতিযোগিতায়, যখন একজন খেলোয়াড় চিরন্তন গৌরব কিংবা চূর্ণ পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন কার্যনির্বাহী প্রক্রিয়া সম্পাদন করার জন্য তাদের মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় স্থান গ্রাস হয়ে যায় চাপের কারণে সৃষ্ট মানসিক ভার দ্বারা। যখন এমন ঘটে, তখন কার্যনির্বাহী প্রক্রিয়া (আমি জানি আমার কী করতে হবে) এবং উদ্বেগ (আমি উদ্বিগ্ন) একই সীমিত মানসিক স্থানের জন্য একধরনের প্রতিযোগিতা করে। তখন কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার জন্য দরকারি বিষয়ে খেলোয়াড়কে সচেতন করতে কার্যনির্বাহী প্রক্রিয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কম কার্যক্ষম হয়।

অন্যদিকে পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া চাপের মধ্যে অনেকাংশেই প্রভাবিত হয় না। কারণ এটি অবচেতন স্তরে কাজ করে; এটি কোনো জ্ঞানীয় স্থান (কগনিটিভ স্পেস) গ্রাস করে না। এর মানে হলো, চাপের মধ্যে থাকার কারণে পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কী ভুল হতে পারে, সে সম্পর্কে যখন এটি তথ্য পেতে চায়, তখন উল্টো এটি ব্যক্তির চেতনায় কী ভুল হতে পারে তা-ই গেঁথে দিয়ে থাকে। আর এটাই হলো পরিহাসমূলক ত্রুটি। 

অন্য কথায়, বাঁ পোস্টে আঘাত না করতে খেলোয়াড়কে যেখানে সাহায্য করার কথা, এই মানসিক প্রক্রিয়া বরং এমনভাবে কাজ করে যে, উল্টো ওই বাঁ পোস্টে বল আঘাত করার আশঙ্কা বেড়ে যায়। খেলোয়াড় যত ত্রুটি এড়াতে চেষ্টা করেন, মন যেন ঘুরেফিরে ওই ভুলের দিকে আরও টেনে নিয়ে যায়। 

আর কেউ যদি ক্ষ্যাপাটে খেলোয়াড় হন, তাহলে তো কথাই নেই। বারবার এমন পরিহাসমূলক ত্রুটির শিকার হওয়ার আশঙ্কা তার ক্ষেত্রে অনেক বেশি। এবং আরও বড় কথা হলো, যেসব খেলোয়াড় সংবেদনশীল, যারা নাকি চাপের সময় উদ্বেগ গোপন করতে চান, দেখাতে চান যে তিনি চাপ নিয়ে চিন্তিত নন বা শান্ত আছেন, তারা এই পরিহাসমূলক ত্রুটির বেশি শিকার হন। কারণ তাদের মস্তিষ্ক ভরে যায় এমন কিছু বিবৃতি দ্বারা যা তাদের আচরণকে সীমিত করে ফেলে। যেমন তারা সারাক্ষণ ভাবতেই থাকেন, ‘শান্ত হও’, ‘উদ্বেগ দেখানোর কিছু নেই’ ইত্যাদি। 

‘দমবন্ধ’ পরিস্থিতিতে পেনাল্টির পরিণতি

তাদের আত্মজীবনীতে বেকহাম ও ওয়েন পেনাল্টি নেওয়ার আগ মুহূর্তে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা বা সঠিকভাবে দম নিতে না পারার যে কথা বলেছেন, ওই সব চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি সাধারণত মানসিক ও শারীরবৃত্তীয় উদ্বেগকে প্রতিনিধিত্ব করে। দুর্ভাবনা বা কী হয় না হয়-এমন দুশ্চিন্তা হলো মানসিক উদ্বেগ। আর ঘনঘন ও ছোট ছোট শ্বাস, উচ্চ হৃদস্পন্দন ও পেশির টান হলো শারীরবৃত্তীয় উদ্বেগের উদাহরণ। এই উপসর্গগুলো খেলোয়াড়ি নৈপুণ্যকে কতটা প্রভাবিত করবে, তা নির্ভর করে একজন খেলোয়াড় কীভাবে পরিস্থিতি উপলব্ধি করেন তথা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নাকি হুমকি হিসেবে দেখছেন, এর উপর। 

জরডেট ও তার সতীর্থ গবেষকরা দেখিয়েছেন, পেনাল্টি শুটআউটে যখন উচ্চ চাপের সম্মুখীন হন, ফুটবলাররা প্রায়শই উপানুকূলভাবে (সাব-অপ্টিমালি) ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। পেনাল্টি কিকের সাফল্যের জন্য দক্ষতা ও ক্লান্তির চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ‘চাপে শ্বাসরুদ্ধ’ হয়ে পড়া খেলোয়াড়দের জীবনে বিরল কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু কেনই বা এমন হয়? ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দুটো প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড় সম্ভাব্য হুমকির প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়েন ও বিভ্রান্ত হন। এ কারণে, আইশেংক ও ক্যালভোর ১৯৯২ সালের গবেষণা অনুসারে, তার পুরো মনোযোগ চলে যায় মনের ভেতরকার তথা অভ্যন্তরীণ অনুভূতির দিকে। যেমনযদি পেনাল্টি মিস করি-এ ধরনের যে অনুভূতি তৈরি হয়, মন ওই দুশ্চিন্তায় আটকা পড়ে। শুটার যদি সম্ভাব্য হুমকির প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়েন, তা হলে ফার্লি, নোয়েল ও মেমার্টের ২০১৭ সালের গবেষণা অনুসারে, তার মন বাহ্যিক সূচকগুলোতেও আটকা পড়ে। যেমন-তিনি গোলরক্ষকের উপর অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে পারেন। 

বিপরীতে আত্মবিশ্লেষণী মডেল অনুসারে বুমিস্টার (১৯৮৪) দেখিয়েছেন, খেলোয়াড়রা উচ্চ চাপের খেলাগুলোয় সচেতনভাবে দক্ষতার প্রক্রিয়া বা কৌশলের উপর নির্ভর করেন। যারা আন্তর্জাতিক আসরে খেলাধুলা করেন, তারা ‘দমবন্ধ’ বা উপানুকূল পরিস্থিতিতে ক্রীড়া নৈপুণ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারেন। এরকম একজন সাবেক খেলোয়াড় লুই এলি। তিনি আন্তর্জাতিক ম্যাচে হকি গোলরক্ষক হিসেবে খেলেছেন। ২০২১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব হাডার্সফিল্ডের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ছিলেন। পেনাল্টি নেওয়ার সময় একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের নৈপুণ্যের উপর চাপের প্রভাব সম্পর্কে তার একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয় ওই বছর। তিনি ও মার্কিন সতীর্থ গবেষক পল ওয়ার্ড বুঝতে চেয়েছিলেন, পেনাল্টির সফলতা ও বিফলতা কীরূপে প্রভাবিত করে খেলোয়াড়দের। 

এলি ও ওয়ার্ড গবেষণাটি করেন অনূর্ধ্ব-১৮ পেশাদার একাডেমি ফুটবলারদের নিয়ে। গবেষণার জন্য তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বেশ কিছু শর্ত নকল বা অনুকরণ করা (সিমুলেট) যা মানসিক চাপকে উদ্দীপিত করতে পারে। উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যায়ের ম্যাচগুলোয় শুটআউটে পেনাল্টি কিক নেওয়ার সময় পেশাদার খেলোয়াড়দের যে আবেগ-অনুভূতির অভিজ্ঞতা হয়, গবেষণার জন্য নমুনা খেলোয়াড়দের মধ্যে তারা সেই আবহ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এসব আবেগের মধ্যে আছে পেনাল্টি স্পটে বল রাখা ও কিক নেওয়ার আগে শুটারের হাঁটার নির্জনতা, দর্শকসারিতে ভিড়ের আওয়াজ এবং গোলরক্ষকের নৈপুণ্য নিয়ে উদ্বেগ। 

এ গবেষণায় খেলোয়াড়দের কম ও উচ্চ চাপের পরিস্থিতিতে চারটি ছোট লক্ষ্যে (নিচে, উপরে, ডানে ও বাঁয়ে) পেনাল্টি কিক নিতে বলা হয়েছিল। কম চাপের পরিস্থিতিতে, খেলোয়াড়দের তাদের পছন্দসই লক্ষ্যে পেনাল্টি নিতে ও পেনাল্টি স্পট থেকে এই প্রক্রিয়াটি পুনরাবৃত্তি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু উচ্চ চাপের পরিস্থিতি তৈরি করতে খেলোয়াড়দের বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল। তারা পেনাল্টি স্পট থেকে যত পেছনে দাঁড়াতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, এর অর্ধেক দূরত্বে দাঁড়াতে বলা হলো। প্রতিটি পেনাল্টি শটের পরে ওই অর্ধেক দূরেই ফিরে আসতে বলা হলো। তাদের লক্ষ্য স্থির করে দেওয়া হলো। মানে, ঠিক নিচে, উপরে, বাঁয়ে ও ডানের মধ্যে যে কোনো একটি লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হলো। চাপ আরও বাড়ানোর জন্য আরেকটা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা প্রত্যেকে শেষ দুটি পেনাল্টি শট নেওয়ার সময় গোলরক্ষক জানতেন তারা ঠিক কোন দিকে শট নিতে যাচ্ছেন। আর টেলিভিশনে প্রচারিত আগের কোনো ম্যাচের পেনাল্টি শুটআউট থেকে দর্শকদের ভিড়ের আওয়াজ শোনানো হলো। আবার তারা এমনভাবে পেনাল্টি নিলেন যেন তারা সত্যিকার অর্থেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলছেন। খেলা শেষে কোচ ভিডিও দেখে তাদের নৈপুণ্যের মূল্যায়ন করবেন, এই কথাও তাদের মাথায় দেওয়া হলো।

সৃষ্ট উচ্চ চাপের পরিস্থিতিতে খেলোয়াড়দের উদ্বেগের মাত্রা, অনুভূত চাপ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের হার অনেক বেশি ছিল। স্কোর করার ক্ষেত্রে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে গিয়েছিল এবং প্রকৃতপক্ষে তাদের শটের নির্ভুলতা অনেক বেশি কমে যায়।

এ গবেষণায় এলি ও ওয়ার্ড দেখেছেন, কম চাপে খেলোয়াড়রা লক্ষ্যের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে। কিন্তু উচ্চ চাপে তারা লক্ষ্য থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং অতিরিক্ত চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ গোল না করতে পারা ও দলের সবচেয়ে খারাপ খেলোয়াড় হতে না চাওয়ার মতো উদ্বেগজনক দুশ্চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়েছিল। এছাড়া তারা বাড়তি কিছু উত্তেজনার কথাও জানিয়েছেন। যেমন ঘাম, পেটে মোচড়, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি ও ঘনঘন শ্বাস ইত্যাদি। 

উপরন্তু, যখন গোলরক্ষক আগে থেকেই জানেন কোথায় শট নেওয়া হবে, তখন কিছু খেলোয়াড় লক্ষ্যে তাদের মনোযোগ আরও নিবিষ্ট করার পরিবর্তে বরং মনোযোগ বিনষ্ট করেন। উল্টো তারা বেশি ভাবতে শুরু করেন তাদের কিক নেওয়ার কৌশল নিয়ে বা ওই কৌশল ব্যবহার করার সময় বলের উপর কত জোর প্রয়োগ করবেন তা নিয়ে। 

সত্যিকারের খেলা আর গবেষণার জন্য খেলার আবহ তৈরি করা এক কথা নয় মোটেও। গবেষকরাও এটা মানেন। কিন্তু এলি ও ওয়ার্ডের দাবি, এই গবেষণায় মানসিক চাপের সঙ্গে পেনাল্টির সফলতার যে সম্পর্ক দেখা গেছে, তা অমূলক নয়। তারা দেখেছেন, পেনাল্টি শুটাররা অর্ধেক পথে (হাফওয়ে লাইন) হাঁটার সময় ও বলে আঘাত করার আগে বিভিন্ন চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি এবং শারীরিক প্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। 

মানসিক চাপ উতরানোর উপায় 

পরিহাসমূলক ত্রুটির শিকার হওয়ার হাত থেকে খেলোয়াড়রা কী করে রেহাই পেতে পারেন? রিসেপ গরগুলু, অ্যান্ড্রু কুক ও টিম উডম্যান বলছেন, সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ভারমুক্ত থাকার কৌশল নেওয়া, প্রচণ্ড চাপে উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল শেখা। একজন খেলোয়াড় শ্বাস নিয়ন্ত্রণের কৌশল ব্যবহার করতে পারেন। কিংবা পেশি শিথিলকরণ কৌশল রপ্ত করতে পারেন-পেশিকে যতটা সম্ভব শক্ত করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তা ধরে রাখতে হবে এবং কিছু সময় পরে পেশিগুলো ধীরে ধীরে তাদের আগের অবস্থায় শিথিল হয়, ফলস্বরূপ খেলোয়াড় কম উদ্বেগ অনুভব করবেন। 

আরেকটি উপায় হলো, নেতিবাচক নির্দেশাবলিকে ইতিবাচক হিসেবে রূপান্তর করা। যেমন-বারবার মনে মনে ‘বাঁ পোস্টে যেন না আঘাত লাগে’ বলার পরিবর্তে জালের ঠিক নির্দিষ্ট কোনো বিন্দু বাছাই করে সেখানেই বল পাঠাব-শুটারের মনে বরং এই কথা প্রতিধ্বনিত হওয়া উচিত। 

পরিস্থিতির চাপ মোকাবিলা করতে খেলোয়াড়দের সাহায্য করতে চাইলে, ওরকম সময় একজন খেলোয়াড় কী ভাবেন, কী অনুভব করেন-সেসবের একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছেন এলি ও ওয়ার্ড। পেনাল্টি থেকে গোল করার সুযোগ বাড়ানোর জন্য, খেলোয়াড়দের উচ্চ চাপের আসরের মতো শারীরিক ও মানসিক অবস্থার মধ্যে অনুশীলন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিযোগিতার বড় আসরে পেনাল্টি নেওয়ার ভয়কে উপশম করার যে কোনো কৌশলই খেলোয়াড়দের জন্য এবং বৃহত্তর অর্থে ফুটবলের জন্যই উপকারী হতে পারে। 

লেখক: বিজ্ঞান ও সমাজ গবেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh