মনজুরুল হক
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৫৫ এএম | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৫৬ এএম
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি বরাবরই ‘মানিক বাড়ুজ্জে’ লিখে স্বাচ্ছন্দ্য পাই। খুব কাছের মনে হয়। মনে হয় যেন ক্যাটক্যাটা হলুদ চটা-ওঠা কোনো দালানের রোয়াকে বসে কথা বলছি। অথচ কী অদ্ভুত বাস্তবতা- ডিসেম্বরের ৩ তারিখে তার মৃত্যু স্মরণ করতে হয়!
১৯৫০ সালে যখন কমিউনিস্টদের ওপর নেমে এলো চূড়ান্ত সরকারি দমননীতি, তখন বহু পত্রপত্রিকায় মানিকের লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেওয়া হলো। ভয়ংকর সংকট। গোটা পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন সহ্য হতো না কিছু। মানিক ডায়েরিতে লিখছেন, ‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’ দারিদ্র্য কী অপরিসীম হলে মায়ের মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়ে আসে!
সংসারের এমন অবস্থায় আবার ঠিক করলেন চাকরি করতে হবে। ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সাপ্তাহিক বিভাগের জন্য সহকারী সম্পাদক প্রয়োজন। মানিক জানতেন ওই পদের জন্যই আবেদন করবেন আরেক সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী। তাই নিজের আবেদনপত্রের শেষে সম্পাদককে লিখলেন, ‘আমি অবগত আছি শ্রীপরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাঁহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি। মহাশয় যদি ইতিমধ্যে তাহার সম্পর্কে অনুকূল বিবেচনা করিয়া থাকেন, তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার এই আবেদন প্রত্যাহার করা হইল বলিয়া ধরিয়া লইবেন।’
চাকরি অবশ্য তারই হলো। মাস মাহিনা ৮৫ টাকা। সঙ্গে শর্ত ‘অমৃতস্য পুত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। তার জন্য পাবেন আরও ১০ টাকা মাসপ্রতি। কিন্তু সেই চাকরিও ছেড়ে দিলেন কিছু দিন পর। অভাব ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে, তার মধ্যেই লিখে চলেছেন, বামপন্থি ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় বাম রাজনীতিতে হাতেখড়ি মানিকের। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে গল্প ছাপা হওয়ার পরে তো চলছে দিনরাত সাহিত্য চর্চা। কলেজের পড়াশোনা উঠল লাটে। পরপর দু বছর বিএসসিতে করলেন ফেল। তখন তার পড়াশোনার খরচ জোগান বড় ভাই। ভাইয়ের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ও সাহিত্য চর্চা কানে গেছে তার। চিঠিতে ভাইকে লিখলেন তিনি, ‘তোমাকে ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছে। গল্প লিখতে আর রাজনীতি করতে নয়! ফেল করেছ কেন?’
উত্তরে মানিক লিখলেন, ‘গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ ফিরতি চিঠিতে ভয়ংকর রেগে গিয়ে বড় ভাই বললেন, ‘তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি টাকা দিতে পারব না। নিজেরটা নিয়েই দেখো!’
প্রত্যুত্তরে মানিক লিখলেন, ‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’
মানিক কী শক্তিশালী দিব্যদৃষ্টিতে যেন দেখতে পেয়েছিলেন বাংলার মানুষ তাকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের মতো সমমর্যাদার আসনে বসিয়েছে।
তখন বয়স মাত্র ১৭, এর মধ্যে মাকে হারিয়েছেন, বড় ভাইও টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু সাহিত্য তাকে গ্রাস করে নিয়েছে পুরোভাগে। মদ বাড়ছিল আর বাড়ছিল ক্ষয়। মদ ছাড়তে চেষ্টা করেও পেরে উঠছিলেন না। দাদাকে আবার চিঠি লিখলেন, কিছু টাকা ধার চেয়ে।
দাদা চিঠির উত্তরে লিখলেন, ‘আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, আমি কাউকে টাকা ধার দিই না।’ ভাইয়ের সঙ্গে পাবলিশিং হাউজের ব্যবসাও শুরু করলেন একবার, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে সেই ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়ল।
ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি, লিভার নষ্ট হতে থাকা মানিক পুরোপুরি বিপর্যস্ত। তার সঙ্গে চূড়ান্ত অনটন। মনে মনে কতটা ভেঙে পড়েছিলেন মানিক তা জানতে পারা যায় একটি ছোট ঘটনায়।
একদিন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় পুজো সংখ্যার লেখা দিতে যাচ্ছেন, রাস্তায় দেখা হলো অধ্যাপক বন্ধু দেবীপদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। মানিকের ভেঙে যাওয়া শরীর, মলিন জামাকাপড় দেখে খুব খারাপ লাগল দেবীপদর। জোর করে সে দিন নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। ক্লান্ত মানিককে খেতে দিলেন দেবীপদর মা। বড় তৃপ্তি করে ওই খাবারটুকু খেলেন মানিক। তারপর যে মানিক একদিন সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন আমি শুধু সাহিত্যিকই হব, সেই মানিকই অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’
তারপর... ৩০ নভেম্বর, মানিক আবার জ্ঞান হারালেন। ২ ডিসেম্বর, সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় ভর্তি করা হলো নীলরতন হাসপাতালে। এমন অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এলেন কবি, কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আর একটু পরেই অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে মানিককে। আর বাড়ি ফেরানো যাবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’কে? সুভাষ অনুযোগ করলেন লেখকপতœীকে, ‘বৌদি এমন অবস্থা, আগে টেলিফোন করেননি কেন?’ মøান হেসে কমলা উত্তর দিলেন, ‘তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই। সেটুকুও নেই যে ঘরে!’
৩ ডিসেম্বর। ভোর চারটা। পৃথিবীতে একটি নতুন দিন সবে শুরু হচ্ছে তখন, বহু দিন অনন্ত লড়াইয়ের পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল আটচল্লিশ বছরের জীবন। বিকেল চারটের সময় বের হলো বিশাল শোকমিছিল। নিমতলা ঘাটের দিকে এগোতে থাকল শববাহী গাড়ি। শেষ দুই দিনের সবসময়ের সঙ্গী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘পালঙ্কসুদ্ধু ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হয় তখন একটা চোখ খোলা, একটা বন্ধ। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে ফুল। মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীর ফুল আর ফুলে ছেয়ে গেছে। উপচে পড়ছে দুপাশে...। মাথা এবং পায়ের কাছে দেশনেতা এবং সাহিত্যিক! সামনে পিছনে, দুইপাশে বহু মানুষ। সর্বস্তরের মানুষ। মোড়ে মোড়ে ভিড়। সিটি কলেজের সামনে মাথার অরণ্য। কিন্তু কাল কেউ ছিল না, কিছু ছিল না... জীবনে এত ফুলও তিনি পাননি।’
আর বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখলেন, ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে। মালা জমে জমে পাহাড় হয় ফুল জমতে জমতে পাথর। পাথরটা সরিয়ে নাও আমার লাগছে।’ সেই ফুলের ভারে সেদিন সত্যিই দামি পালঙ্কের একটি পায়ায় চিড় ধরে গিয়েছিল।
এটা পুরো মানিকের জীবনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। এই পরিসরে যদিও তার সাহিত্য, রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে মার্কসবাদের চর্চা, কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে নিরলস শ্রম দানের বিষয়গুলো তুলে আনা যাবে না। তার জন্য ব্যাপক স্থানের প্রয়োজন।
মানিকের দেখবার দৃষ্টি ও দৃষ্ট-সত্য ভিন্ন প্রকারের। তিনি অত্যাচারিত শ্রেণির মধ্যে শক্তির উন্মেষ লক্ষ করেছেন এবং সেই উন্মেষকে সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন। এ শক্তির একমাত্র উৎস হচ্ছে উৎপীড়িত শ্রেণির চেতনা এবং একতা। আর রয়েছে এই সত্যটি, জাগতিক পরিস্থিতিই মানুষের চালক এবং শক্তিদায়ক। অথচ এই মানিকই মার্কসবাদের সাহচর্য পাবার আগে সিগমন্ড ফ্রয়েড দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার ‘প্রাগৈতিহাসিক’ সেই সাক্ষ্য দেয়। মানিক ভাববাদ এবং বস্তুবাদের সংঘাতে মাঝে মাঝে বিব্রত হয়েছেন, বিচলিত হয়েছেন। আবার পরক্ষণেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, অর্থনীতি মানুষের জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী নিয়ামক।
মানিক বিশ্বাস করতেন এ সমাজ গড়ে উঠবে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির সহায়তায় নয়, বরং শ্রমজীবী শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং শ্রেণিচ্যুত মানুষের সাহায্যে। শ্রেণিচ্যুত মানুষরা যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবে সে ঐক্যের কোনো তুলনা নেই। তিনি বিশ্বাস করতেন বলেই তার ‘জীয়ন্ত’ উপন্যাসের সংগ্রামী কিশোর পাঁচুর উপলব্ধি এরকম,
‘সাধারণ বন্ধুত্ব সুযোগ-সুবিধার ব্যাপার। বিপ্লব বন্ধুত্ব গড়ে অন্যরকম। নতুবা জগতে বিপ্লবী হতো কে?’
এই মানিককে নিয়ে তার মৃত্যুদিনের স্মৃতিচারণা এখানে শেষ করলে বড়ই খণ্ডিত দেখাবে। তারপরও থামতে হবে। এক একবার মনে হয় মানিক থাকলে হয়তো আরও তেজস্বী কিছু একটা হতো। হয়তো উল্টো করেই বলতেন, ‘দেখো বাপু সর্বহারা সাহিত্য হলো সর্বহারার মারণাস্ত্র, ওর সঙ্গে দুমুঠো ভাতের কনফ্লিক্ট নেই।’ অথবা কিছুই বলতেন না।
লেখক: সাংবাদিক