মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ

বাংলাদেশের জন্যও বিপদসংকেত

মঞ্জুরুল হক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:২০ পিএম

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পতাকা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পতাকা। ছবি: সংগৃহীত

২০১৭ সালের দিকে নতুন করে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সময় থেকে রোহিঙ্গাদের এ দেশে উপস্থিতিকে বড় সংকট বলা হচ্ছে, অথচ চার দশক আগে থেকেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিরতা চলছে এবং সেই সময় থেকেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।

১৯৭২-১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে কয়েক দফার সংঘর্ষ-সংঘাতে দেশ ছাড়া হয়েছে মিয়ানমারের এই জনগোষ্ঠী। কখনো ধর্ম আবার কখনো নাগরিকত্ব নিয়ে বিরোধে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত নাগরিকেরা। এই নাগরিকদের জবানিতে জানা যায় তারা জাতিগত নিপীড়নের শিকার। ওদিকে মিয়ানমারের সকল সরকারই বলে আসছে ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়’। বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় অং সাং সু চি ক্ষমতায় থাকাকালে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। তিনিও রোহিঙ্গা প্রশ্নে এখনকার জান্তা সরকারের মতোই মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মাটিতে প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর) বসবাস করছে।

টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং। ১৯৯১-১৯৯২ সালের অনুপ্রবেশের পর এই দুটি জায়গায় দুটি নিবন্ধিত ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় শরণার্থীরা। আর এর পাশেই গড়ে উঠেছিল অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প (স্থানীয়ভাবে যাকে টাল বলা হয়)। সেই টালগুলোতে বাড়তে থাকে রোহিঙ্গা বসতি। সেখান থেকে আশপাশের গ্রাম, শহর হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে অনেকে।

এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফিরে না যাওয়া নিয়ে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। সাময়িক আশ্রয়ের বিষয় হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। গলার কাঁটার মতো বিঁধে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি সমবেদনাও উবে গেছে।

অন্যদিকে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ আর পাশের উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়িতে মানুষদের দমবন্ধ অবস্থা। রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, স্থানান্তরসহ নানা ইস্যুতে সবকিছুই চাপা পড়ে গেছে। 


বিস্তীর্ণ সেই অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস, বনাঞ্চল উজাড়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম নষ্ট হওয়াসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় চাপা পড়ে যায় বড় বড় ইস্যুর ভিড়ে। 

গহিন বনে ডাকাত চক্রের উত্থান, খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ছিনতাইসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ততা বাড়ে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার। অন্যদিকে মানব পাচার, অবৈধ অস্ত্রের কারবার, ইয়াবা পাচার আর স্বর্ণ চোরাচালানের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের চক্র ডালপালা মেলতে থাকে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা বসতিগুলোকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর অপরাধ বিশাল আকার ধারণ করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে সংকট।

এই সংকটের মূলে আছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের এথেনিং ক্লিনজিং, যেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে পোড়ামাটি নীতিতে। অর্থাৎ নো মার্সি। এর প্রমাণ মেলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোর ‘জঙ্গি কার্যক্রম’ দমনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার দেখে। কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্যের সংবাদ মাধ্যম বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহীদের যে কোনো মূল্যে দমন করা হবে।’ ২০২১ সালে ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বিভিন্ন বিদ্রোহী দলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে আছে। এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হাজারো মানুষ মারা গেছেন এবং ১০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। জেনারেল মিন অং হ্লাইং জনসম্মুখে খুব একটা না এলেও রাজধানী নেপিডোতে সশস্ত্র বাহিনীর বার্ষিক প্যারেডে তিনি এই বক্তব্য দেন। 

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দেশের জনগণের বিরুদ্ধে বাড়তি সামরিক শক্তি ব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ক্রমশ মিয়ানমারকে একঘরে করে ফেলছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটি বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে তাদের সামরিক সক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে। অন্যান্য দেশের সমর্থন হারালেও দেশটির প্রতি চীন ও রাশিয়ার সমর্থন অব্যাহত রয়েছে এবং মহড়ায় এ দুই দেশের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

মহড়ায় রাশিয়া থেকে কেনা এম-৩৪৫ গানশিপ এবং চীনের কাছ থেকে কেনা কে-৮ বোমারু বিমান ও এফটিসি-২০০০ যুদ্ধবিমান অংশ নেয়। এসব অস্ত্র বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে অনেক বেসামরিক ব্যক্তি ও শিশুও মারা গেছে।

গত এক বছর ধরে ধারণা করা হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যতই অত্যাচার-নিপীড়ন করছে, ততই জনসমর্থন হারাচ্ছে। মিয়ানমারে এখন কার্যত একাধিক ‘সরকার’ সক্রিয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন এ অবস্থা চলতে থাকলে মিয়ানমারের অখণ্ডতা টিকবে না। দেশটি কয়েক খণ্ডে খণ্ডিত হয়ে পড়তে পারে। এই মুহূর্তে বিশ্বে মিয়ানমারই একমাত্র দেশ যেখানে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। এই গৃহযুদ্ধের বয়স প্রায় ৭৮ বছর! অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সেখানে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর ভেতরে জাতিগত মুক্তির লড়াই জারি রয়েছে। বিদেশি শক্তিগুলো, বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স যার যার মতো স্বার্থসংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং নিজস্ব ‘পকেট গেষ্ঠীকে’ মদদ দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যু একটি কঠিন ও জটিল সমস্যা। দিন যত গড়াচ্ছে ততই যেন এর সমাধানের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। কিছুদিন আগে উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গার পৃথক সমাবেশ হয়েছে। তা ছাড়া উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের সব কটিতে ছোট ছোট ৩০টির বেশি সমাবেশ করে জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার দাবি জানায় রোহিঙ্গারা। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে তিন দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। তখন রোহিঙ্গাদের দাবি ছিল, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। লম্বাশিয়া আশ্রয় শিবিরের সমাবেশের স্লোগান ছিল, ‘বাড়ি চলো’ এবং তারা বলছেন, আমরা এই দেশে আশ্রিত, এটি আমাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা নয়। দিন যত বাড়ছে, সমস্যা তত প্রকট হচ্ছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশে থাকতে চাই না। আমরা নিজের অধিকার নিয়ে দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই। তাই বাড়ি চলো আন্দোলন।

নিদর্শন ও আলামত থাকার পরও ২০১৭ সালের আগে যেমন কেউ বুঝতে পারেনি আজকের অবস্থা, তেমনি দ্রুত একটা সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গারা ফেরত না গেলে আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মাথায় এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য কতখানি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। 

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর সংঘাত-সংঘর্ষ কয়েকশ বছরের পুরনো, আর বাংলাদেশ এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ১৯৭৮ সাল থেকে, তাও প্রায় ৪৩ বছর হয়ে গেল। এর কোনো সমাধান কার্যত হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি এখন যেমন কমে গেছে, তেমনি রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে বাংলাদেশের ওপর অভিঘাতের স্বরূপ বহুমুখী হয়েছে। ক্যাম্পগুলো ঘিরে মানবপাচারসহ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের বিস্তার ঘটছে ভয়াবহভাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ধর্মীয় উন্মাদনায় উদ্বুদ্ধ করে রোহিঙ্গা যুবকদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টাও চলছে জোরেশোরে।

এখন মিয়ানমারের যুদ্ধরত বিভিন্ন বাহিনীগুলোর অবস্থান, শক্তি-সামর্থ্য বাইরে থেকে অনুমান করা যাবে না। তবে এটা জানা যাচ্ছে যে সামরিক বাহিনী সব দিক সামাল দিতে পারছে না। সামরিক বাহিনীর পেছনে শক্তিশালী পরাশক্তি রাশিয়া-চীনের অকুণ্ঠ সমর্থন থাকার পরও বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী গ্রুপ এবং তাদের বাহিনী মরণপণ লড়ে যাচ্ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যুদ্ধরত কয়েকটি বাহিনী আবার সরকারের পক্ষের দেশগুলো থেকেও কীভাবে যেন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে। এক একবার আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে পিলে চমকানো খবর ছাপা হচ্ছে। কখনো হয়তো বলা হচ্ছে-‘যে কোনো সময় মিয়ানমার কয়েক খণ্ডে ভাগ হয়ে যেতে পারে।’ আবার পরদিনই বলা হচ্ছে-‘সামরিক বাহিনী কিছু কৌশলগত কারণে অলআউট আক্রমণে যাচ্ছে না। যদি নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন দেখে তাহলে তারা সর্বাত্মক আক্রমণে যাবে এবং নিশ্চিতভাবেই জয়ী হবে।’

চিন্তার বিষয় এটাই যে মিয়ানমারে তিন-চারটি পরাশক্তির প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদে কিংবা সাহায্যে যে লড়াই জারি আছে সেটা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে এবং আরও বাড়বে। ওই পরাশক্তিগুলো অর্থনৈতিক স্বার্থেই মিয়ানমারকে খণ্ডিত হতে দেবে না। তাই যুদ্ধের ভয়াবহতাও বাড়বে। অন্যদিকে ওই পরাশক্তিগুলোর প্রতিপক্ষ পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলো চাইবে সামরিক সরকার পরাজিত হোক। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীগুলো জয়ী হোক। তাতে করে মিয়ানমারের অখণ্ডতা বজায় থাকবে না। সে সময় মিয়ানমারে একাধিক সামরিক শক্তি বিক্ষিপ্তভাবে শাসন করতে চাইবে। 

এই সন্ধিক্ষণের সময়টা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে। মনে করা যাক আরাকানভিত্তিক একটি বা দুটি সামরিক গোষ্ঠী আরাকান অঞ্চল থেকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে হটিয়ে নিজেরা আঞ্চলিকভাবে ক্ষমতাসীন হলো। তারপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনী তাদের হাত থেকে অঞ্চল মুক্ত করতে সর্বগ্রাসী যুদ্ধ পরিচালনা করলে সেই যুদ্ধ সীমান্তে এসেই থেমে যাবে এমনটি ভাবার যুক্তি নেই। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী যদি মনে করে রোহিঙ্গা বা আরাকানি কোনো গোষ্ঠী বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশ থেকে সামরিক সাহায্য নিয়ে লড়ছে। তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের যুদ্ধ বেধে যাওয়ার বিপদকেও অবহেলা করার উপায় নেই। 

বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ইস্যুটাকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে। এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সংঘাতের বিপদ। যেটা এখন দেখা যাচ্ছে না তাই গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু যখন হুট করেই ঘাড়ে এসে পড়বে তখন প্রস্তুত হওয়ারও সময় মিলবে না। এই বিষয়টা সরকারের নীতিনির্ধারকরা দ্রুতই গুরুত্বসহ ভাববেন আশা করা যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh