লোহিত সাগর সংকটে বিশ্ববাণিজ্যে নতুন হুমকি

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪১ এএম

লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে হুথির হামলার কারণে শিপিং ব্যাহত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে হুথির হামলার কারণে শিপিং ব্যাহত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ চালানোর সঙ্গে সঙ্গে লোহিত সাগরে এক নতুন সংকট শুরু হয়েছে। সম্প্রতি দেখা গেছে, ইসরায়েলের পথে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিচ্ছে বিশ্বের বড় বড় জাহাজ পরিবহন সংস্থাগুলো। এই তালিকায় রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জাহাজ পরিবহন প্রতিষ্ঠান ডেনমার্কের মেয়ার্স্ক ও জার্মানির হ্যাপাগ-লয়েডের মতো প্রতিষ্ঠান। 

কিছুদিন আগে ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন হুতি যোদ্ধা গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে জানায়, লোহিত সাগর হয়ে যেসব জাহাজ ইসরায়েলে যাবে, সেগুলোর ওপর হামলা চালানো হবে। এরপর বেশ কয়েকটি জাহাজে হামলাও চালানো হয়। হুতিদের ঘোষণার পর থেকেই নড়েচড়ে বসেছে আন্তর্জাতিক জাহাজ পরিবহন প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ লোহিত সাগর বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত নৌপথ। বিশ্বের অধিকাংশ তেল ও জ্বালানি পরিবহন হয় এই পথে। 

১৫ ডিসেম্বরের পর বিশ্বের পাঁচটি বড় কনটেইনারবাহী জাহাজের মধ্যে চারটিই লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। 

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে পাঠানো এক বিবৃতিতে মেয়ার্স্ক বলেছে, ‘এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর সাম্প্রতিক হামলা উদ্বেগজনক এবং নাবিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য উল্লেখযোগ্য হুমকি। মেয়ার্স্ক জিব্রাল্টার ও অন্য একটি কনটেইনার জাহাজে দুটি ব্যর্থ হামলার পর বাব আল-মান্দেব প্রণালি হয়ে আমাদের যেসব জাহাজ ভূমধ্যসাগরের দিকে যাচ্ছিল, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তাদের যাত্রাবিরতি করার নির্দেশ দিয়েছি।’ হ্যাপাগ-লয়েডও মেয়ার্স্কের মতো একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। গত ১৫ ডিসেম্বর হ্যাপাগ-লয়েডের একটি জাহাজে হামলার ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় এই অঞ্চল দিয়ে নিজেদের জাহাজগুলো চলাচল থেকে বিরত থাকতে অস্থায়ী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

৩২ কিলোমিটার চওড়া বাব এল-মান্দেব প্রণালিটি ইয়েমেন, জিবুতি, ইরিত্রিয়ার মাঝে অবস্থিত। এই প্রণালি হয়ে খুব সহজেই এশিয়া থেকে কোনো জাহাজ সুয়েজ খাল হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আটলান্টিকে যেতে পারে। ফলে এশিয়া থেকে ইউরোপের নৌপথের দূরত্ব অনেক কমে আসে। প্রতিবছর এই প্রণালি হয়ে অন্তত ১৭ হাজার জাহাজ পাড়ি দেয়। আফ্রিকা ও আরব উপদ্বীপের মাঝে অবস্থিত বাব এল-মান্দেব প্রণালি দিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ ও মোট কনটেইনার ট্রাফিকের ৩০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। 

হুতিরা ১৫ ডিসেম্বর একটি জাহাজে হামলার হুমকি দেয়। একটিতে হামলা চালানো হয় ড্রোন দিয়ে, পণ্যবাহী জাহাজ লক্ষ্য করে চালানো হয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলাও। যেসব জাহাজে হামলা চালানো হয় তার সবগুলোই ছিল লিবারিয়ান পতাকাবাহী। ১৬ ডিসেম্বর মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ক্যারনি লোহিত সাগরের ওপর থেকে অন্তত ১৪টি ড্রোন ভূপাতিত করে। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজও একটি ড্রোন ধ্বংসের দাবি করে।

জাহাজ বিকল হয়ে যাওয়া ও ক্রুদের হতাহতের আশঙ্কায় চাপে পড়েছে শিপিং কোম্পানিগুলো। ১৫ ডিসেম্বর মেয়ার্স্ক ও হ্যাপাগ-লয়েড তাদের সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর সার্ভিস বন্ধ করে সিএমএ সিজিএম ও এমসসি। বলা হয়েছে, লোহিত সাগর নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত তারা কার্যক্রম বন্ধ রাখবে এবং কিছু জাহাজকে কেপ অব গুড হোপ দিয়ে পরিচালনা করা হবে। সার্ভিস বন্ধ করা এই চারটি কোম্পানি বিশ্বের কনটেইনার বাণিজ্যের ৫৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এখন ছোট ছোট কোম্পানি যেমন ড্রাই বাল্ক ও অয়েল ট্যাঙ্কারস তাদের অনুসরণ করতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।

এ সংকটের জেরে ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া এ যুদ্ধ নতুন দিকে মোড় নিতে পারে। একই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে। এই সংকটের দুটি গুরুতর দিক আছে। একটি বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে, আরেকটি মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তাজনিত। অর্থনীতির দিক হলো-সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজ পরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে সময় ও খরচ দুটিই বাড়বে। সেই সঙ্গে পণ্য সরবরাহে সংকট তৈরি হবে। ২০২১ সালে তাইওয়ান পরিচালিত এভারগিভেন জাহাজ সুয়েজ খালে ছয় দিন আটকে থাকায় বৈশ্বিক সরবরাহ সংকট ঘনীভূত হয়েছিল। এরপর লোহিত সাগরের সংকট কাছের আরব সাগরে সঞ্চালিত হলে আরেক বিপদ। বিশ্বের সয়াবিন তেলের এক-তৃতীয়াংশ এই পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। মিশরের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস হচ্ছে সুয়েজ খাল। তারা এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজ পরিবহন দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে তাদের সংকট আরও বাড়বে।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান-সমর্থিত হুতিরা আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে হামলা চালাচ্ছে। এ হামলায় বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা মধ্যপ্রাচ্যে নৌ তৎপরতা বৃদ্ধি করছে। এমনকি বাণিজ্যপথ বিপদমুক্ত করতে তারা হুতি যোদ্ধাদের ওপর হামলাও করতে পারে। তবে কয়েক বছর আগে যেভাবে সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো হুতিদের ওপর হামলা চালিয়ে আসছিল, এখন সে অবস্থা বদলে গেছে। চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান সমঝোতা আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন মোড় নিয়ে এসেছে। এর ফলে হুতিদের সক্ষমতা ও সমর্থন দুটিই বেড়েছে।

এসব ঝুঁকির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হতে পারে। তবে হুতিদের হুমকি জটিল ও সবাইকে সন্ত্রস্ত করার মতো হয়ে উঠছে। হুতিরা বলছে, গাজায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করা না পর্যন্ত ইসরায়েলের বন্দরগামী জাহাজে আক্রমণ করা হবে। তবে তারা এখন পর্যন্ত যেসব জাহাজে হামলা চালিয়েছে, তার কোনোটি ইসরায়েলগামী ছিল না বা সেগুলোর মালিকানা ইসরায়েলের হাতে ছিল না; বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাহাজ হুতিদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেসব জাহাজে তারা হামলা করেছে, তার একটি ছিল হংকংয়ের পতাকাবাহী। তবে হুতি যোদ্ধাদের ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে তাদের কাজের তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। 

মধ্যপ্রাচ্য সফররত মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান দাবি করেছেন, ইয়েমেনের হুতি যোদ্ধারা লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক মুক্ত জাহাজ চলাচলের পরিবেশ নষ্ট করছে। তবে হুতি নেতারা বলেছেন, তারা তাদের পানিসীমা অতিক্রমকারী জাহাজগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদের বৈধ অধিকার চর্চা করছে এবং যেসব জাহাজ তাদের আদেশ অমান্য করছে শুধু সেসব জাহাজে হামলা চালানো হচ্ছে।

এ সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বের তেলের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পাশাপাশি এর নেতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। তবে এমন সংকটে বিশ্বের শক্তিধর ও পরাশক্তিগুলো কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, তার ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এই সাগরপথে তেলবাহী জাহাজে মাসজুড়ে হুতি যোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়েছে। ৩ ডিসেম্বর যে তিনটি জাহাজে তারা হামলা চালিয়েছে, এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বাত্মক হামলা শুরুর পর জ্বালানি তেল সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়। এদিকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেকভুক্ত দেশগুলোর সরবরাহ কমানোর ঘোষণা তেলের বৈশ্বিক সরবরাহে অনিশ্চয়তা ও ধোঁয়াশা তৈরি করে। বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান সিএমসি মার্কেট বিশেষজ্ঞ টিনা টেং জানিয়েছেন, গাজা যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব লোহিত সাগরে ছড়িয়ে পড়ায় নতুন করে তেলের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যুদ্ধের ধরন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, খুব শিগগিরই লোহিত সাগরে হুতি হামলা বন্ধের তেমন কোনো নিদর্শন দেখা যাচ্ছে না। 

ওয়াশিংটনভিত্তিক শক্তি বিষয়ক তথ্য সংস্থা এনার্জি ইন্টেলিজেন্সের সিনিয়র বিশ্লেষক কলবি কনেলি আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, লোহিত সাগরে এই আক্রমণগুলোর প্রভাব তেলের বাজারে সীমিতভাবে প্রভাব ফেলবে। তবে এটি পুরোপুরি অস্বীকার করার মতো নয়। যেহেতু এই আক্রমণগুলো এখনো চলছে, তাই বাজারে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। অপরিশোধিত তেলের দাম সপ্তাহের শেষের দিকে গত কয়েক দিনের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যেহেতু এমন আক্রমণগুলো দেখে মনে হচ্ছে না যে, মধ্যপ্রাচ্যের নীতিনির্ধারকদের তা দমানোর কোনো কার্যকর প্রচেষ্টা রয়েছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh