বিজয়ের বায়ান্ন
শেখর দত্ত
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:২৮ এএম
বিজয়ের মাস। ছবি: সংগৃহীত
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা কি কেবল লাল-সবুজের একটি পতাকা? ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬শ ১০ বর্গকিলোমিটারের একটি মানচিত্র? বিজয়ের ৫২ বছর পালনকালে এই প্রশ্নটি ঘুরেফিরে মনে আসছে এবং হ্যাঁ-না উত্তরে দোল খাচ্ছে। উত্তর বলছে, পতাকা তো জাতির সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। মানচিত্র স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের। মানচিত্র আছে বলেই আমরা নিজেদের ভাগ্যবিধাতা হতে পেরেছি।
তবে না উত্তরও পিছু ছাড়ছে না। বুকে ঘণ্টা পিটিয়ে বলে দিচ্ছে, শরীরের অবয়ব আর পোশাক-পরিচ্ছদই কি সব! তুমি কী রকম, মন আর আচরণ কেমন, তা দিয়েই তোমার পরিচয় নির্ধারিত হয়। জাতি হিসেবে তোমরা যদি নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করতে না পারো, জাতির জন্মলগ্নের মর্মবাণী স্মরণে রেখে শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হতে না পারো; তবে স্বাধীনতা হবে পোশাকের মতো নিছকই পতাকা, অবয়বের মতো হবে মানচিত্র।
জাতির জন্মের উৎসে রয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ নেতৃবৃন্দ এবং শহীদ বীরদের সাহস, ত্যাগ ও দূরদর্শিতার অমর কাহিনি, যাকে অবশ্যই অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে স্মরণে রাখতে হবে। এটাই যথেষ্ট নয়, রয়েছে তাদের রক্ত-ত্যাগ-বীরত্ব মাখা স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ফানুস বা অলীক কল্পনা তখন ছিল না, ছিল দেশবাসীর আন্দোলন-সংগ্রামের কষ্টিপাথরে যাচাইকৃত, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ; সমাজতন্ত্র জয়যাত্রার যুগে বিশ্ববাস্তবতার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
জাতির জন্মলগ্নের মর্মবাণী স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে আমাদের ইতিহাসের প্রথম গৃহীত সংবিধানে। পাকিস্তানের কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ থেকে স্বদেশের মাটিতে এসেই বঙ্গবন্ধু এই মর্মবাণী এককথায় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি বা কাজ না পায়।’ প্রকৃত বিচারে বাংলার ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’র জন্যই তিনি জাতীয় চার নীতিকে জাতির সামনে ধ্রুবতারার মতো বাস্তবায়নযোগ্য আদর্শ হিসেবে সামনে রেখেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশকে অগ্রসর হতে হবে চারটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।’ চার মূল সূত্র ও নিজস্ব পথ- এটাই হচ্ছে জাতির জন্মলগ্নের মর্মবাণী। বাংলার পলিমাটি, হাজার বছরের লালিত বাঙালি-মানস এবং বাঙালির রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ভৌগোলিক স্বাতন্ত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে ধর্ম-বর্ণ-পেশা-লিঙ্গ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর লক্ষ্যেই তা গ্রহণ করা হয়েছিল।
তখন এমন কথাও ছিল যে, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র রয়েছে দুই মেরুতে। এ দুই নিয়ে অগ্রসর হওয়া যাবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানে চারটি নীতিকেই সূত্রবদ্ধ করা হয়। একটা থেকে অপরটাকে পৃথক করা হয় না। চারটা মিলে হয় এক ও অবিভাজ্য। ঘর যেমন চারটি খুঁটির ওপর দাঁড়ায়, তেমনি জাতিও সেই চার স্তম্ভের ওপর দাঁড়াবে, এটাই ছিল প্রত্যাশা। এমন মানবিক-গণতান্ত্রিক আদর্শ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই মানচিত্রের জনগণ হাজার বছরের সুকীর্তি ধারণ করতে পেরেছিল বলেই।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে সুস্পষ্ট হবে, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোর ‘জাতীয় সরকার’ বা ‘বিপ্লবী সরকার’ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ না নিয়ে ১৯৭৩ সালেই নির্বাচন করে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভেতর দিয়ে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা হতে দেয়নি একাত্তরের পরাজিত শক্তি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্য নিয়ে চলে কিসিঞ্জারি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। রাতের বাহিনীর সঙ্গে যে পাকিস্তান কানেকশন ছিল তা কারোরই অজানা নয়। আর চাটার দলের প্রধান তো ছিল বিড়াল তপস্বী খুনি মোশতাক।
সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হতে থাকলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় চার মূলনীতি বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একদল গঠন করেছিলেন। মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, আতাউর রহমান খান, হাজী দানেশ, মোজাফফর আহমেদ প্রমুখ নেতাও ছিলেন একদলের পক্ষে। জিয়াউর রহমানও যোগ দিয়েছিলেন একদল বাকশালে। দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য প্রথম বিপ্লব তথা মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু হয়েছিল।
কিন্তু তা হতে দেয়নি জাতীয় মূল চারনীতির শত্রুরা, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত খল নায়কেরা, কায়েমি স্বার্থের দেশি-বিদেশি স্বার্থের রক্ষকরা। প্রথমে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং পরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে ওই চিহ্নিত শত্রুরা কেবল জাতিকে নেতৃত্বশূন্যই করেনি, মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণীকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। ওরা যে অনেকটাই সফল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাহাত্তরের সংবিধান ওই অপশক্তি পরিবর্তন করতে পেরেছে। বিষবৃক্ষরূপী জামায়াত নামের ঘাতক-দালাল দল রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত অর্থনৈতিক মুক্তির নিজস্ব পথ থেকে বিচ্যুত করে সাম্রাজ্যবাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বানাতে সচেষ্ট থেকেছে। রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য ‘ডিফিকাল্ট’ করা হয়েছিল গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি এবং রাজনীতিকে ধর্মের মোড়কে অর্থ ও অস্ত্রের কাছে জিম্মি করে রাখার জন্যই।
সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র ঠান্ডাযুদ্ধ যুগের অবসানের পর এককেন্দ্রিক বিশ্ব ক্রমেই ডানমুখী হতে থাকে। এর প্রভাব পড়ে ডানমুখী অধোগতির দিকে ক্রমঅগ্রসরমাণ বাংলাদেশেও। নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় যুগের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় মূলনীতির পতাকাবাহী দল আওয়ামী লীগ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্য সামনে রেখে মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে এবং ‘বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে শরিক’ হয়। সামরিক কর্তাদের শাসন যখন ‘রাবারস্ট্যাম্প’ গণতন্ত্র ও লুটেরা অর্থনীতির মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগ ‘ভোট ও ভাত’-এর দাবি দলটি সামনে রাখে।
১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির উপযোগী নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে জাতীয় চারনীতি বাস্তবায়নে নামে। সুদীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আবার জন্মলগ্নের মর্মবাণী অভিমুখে ঘুরে দাঁড়ায়। নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা হওয়ার প্রথম ও প্রধান রক্ষাকবচ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে পরনির্ভরতা হ্রাস করে। দেশে প্রথমবারের মতো সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে অর্পণ করে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির। ২০০১ সালের অক্টোবরের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসে জাতীয় চার মূলনীতি বিরোধী শক্তি। ঘাতক-দালালদের দল বিষবৃক্ষ জামায়াত ক্ষমতার অংশী হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশ অধোগতির চরমে পৌঁছে। যার চরম বহিঃপ্রকাশ ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা। পঁচাত্তরের মতো জাতীয় চার মূলনীতির ধারক-বাহক-রক্ষক দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, দুই মেরুতে বিভক্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক লড়াইটা আগামীর উন্নত-সমৃদ্ধ-গণতান্ত্রিক-কল্যাণমূলক-মানবিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে হচ্ছে না। বাস্তবে বর্তমানে ক্ষমতার বাইরে একাত্তরে পরাজিত ও পঁচাত্তরের মাস্টারমাইন্ডরা চাইছে জাতির জন্মলগ্নের মর্মবাণী অভিমুখী পথ থেকে দেশকে বিপরীতমুখী করতে আর ক্ষমতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জাতীয় রাজনীতির মূলধারা চাইছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নির্বাচনের মাধ্যমে সেই অভিমুখেই দেশকে চলমান রাখতে।
তবে যতটা সহজ ও সরলভাবে কথাটা বলা হলো বাস্তবে চলার পথ ততটা সোজাসাপটা নয়। বর্তমান বিশ্ব এখন বহুকেন্দ্রিক এবং ডান অভিমুখে ক্রমধাবমান। বৃহৎ শক্তিসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধির অশুভ প্রতিযোগিতায় একদিকে দেশে দেশে লোভ-লালসা-হিংসা-দ্বেষ বাড়ছে, তেমনি অগণতান্ত্রিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, পরস্পর হানাহানি, বিদ্বেষ বিস্তারলাভ করছে। যুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধ, অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতিতে বিশ্ব টালমাটাল।
আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। বিশেষভাবে আমাদের মতো দেশগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির গতিতে মানুষ অসহায়। তবে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ও সমস্যা জর্জরিত অবস্থার মধ্যেও রয়েছে দেশকে উন্নতি-সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর করে নেওয়ার সুযোগ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল কাজে লাগিয়ে একবিংশ শতকের উপযোগী প্রযুক্তিনির্ভর দেশ গড়ে তোলা এখন আকাশ-কুসুম কল্পনা নয়।
এই অবস্থায় জাতির সামনে এসেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নানা সমস্যা-সংকটের মধ্যেও দেশ নির্বাচনের ভেতর দিয়ে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাবে এবং আগু-পিছু-চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে দেশকে জন্মলগ্নের মর্মবাণী অভিমুখে চলতে অনুপ্রেরণা জোগাবে- এটাই নতুন বছর সামনে রেখে একান্ত কামনা।
-কলাম লেখক, রাজনীতিক