এম ডি হোসাইন
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:০৬ এএম
বই উৎসবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
বছরের প্রথম দিন সারা দেশে উৎসব করে নতুন বই তুলে দেওয়া হলো শিক্ষার্থীদের হাতে। কিন্তু খোদ রাজধানীতেই থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার গাফিলতিতে নতুন বই পায়নি দুই শতাধিক বেসরকারি স্কুল। ফলে সকাল থেকে তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর হতাশা আর মনোবেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে বেশির ভাগ বই না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো স্কুলে অষ্টম আর নবম শ্রেণিতে কোনো বই-ই দেওয়া হয়নি, এমনও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। আর ছাপার কাজ দ্রুত শেষ করতে গিয়ে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার অভিযোগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
দেশের অন্যান্য স্কুলের মতো নীলফামারী সদরের রামগঞ্জ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়েও বই উৎসবের আয়োজন করা হয় গতকাল। কিন্তু এ স্কুলের অষ্টম ও নবম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীই বছরের প্রথম দিনে কোনো বই পায়নি। বই ছাড়াই ফিরতে হয়েছে তাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক জানান, তাদের জানানো হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের পর এ দুই শ্রেণির বই পাওয়া যাবে। তবে এ স্কুলে অন্য সব শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা গতকাল নতুন বই পেয়েছে।
একই চিত্র দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন স্কুলে। অষ্টম আর নবম শ্রেণির বেশির ভাগ বই স্কুলগুলোয় পৌঁছেনি। এমন ঘটনা রাজধানীতেও। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষক জানান, এ প্রতিষ্ঠানে অষ্টমের মাত্র চারটি বই পেয়েছে ছাত্রীরা। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও সব বই পায়নি। রাজধানীর ডেমরার সামসুল হক খান স্কুলের অষ্টম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থী গতকাল বই পায়নি। নবম শ্রেণিরও পৌঁছেনি সব বই। তবে এ স্কুলে অন্য শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা বই পেয়েছে।
রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন যেসব বেসরকারি স্কুলের ইআইআইএন (এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) নেই, তাদের বছরের প্রথম দিন বই দেননি ক্যান্টনমেন্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার। তবে এসব স্কুলের প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব বই যথাসময়ে পৌঁছে দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন থানা শিক্ষা অফিসার। আর বই না পেয়ে রাজধানীর মাটিকাটার স্কাইলার্ক মডেল স্কুলের শিক্ষার্থী নাফিজা আঞ্জুম, রাকিবুল ইসলাম, রত্না আক্তারসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ফিরে গেছে মন খারাপ করে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ বই উপজেলা শিক্ষা অফিসে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আর অষ্টম ও নবম শ্রেণির অর্ধেকের বেশি বই পৌঁছানো হয়েছে; অর্থাৎ শুধু অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব বই পাবে না। তবে অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শতভাগ বই পাওয়ার কথা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বছরের শুরুতে সাধারণত মার্চ মাসে সব ধরনের স্কুল থেকে বইয়ের চাহিদাপত্র নেয় এনসিটিবি। এরপর সেই চাহিদা অনুযায়ী উপজেলা শিক্ষা অফিসে (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) বই পৌঁছে দেয়। আর উপজেলা অফিস থেকে সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলে চাহিদা অনুযায়ী বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হয়।
রাজধানীর মাটিকাটার স্কাইলার্ক মডেল স্কুলের অধ্যক্ষ মো. সাফায়েত হোসেন বলেন, ‘আমার স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার শতাধিক। এর মধ্যে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের কাউকে বই উৎসবের দিনে নতুন বই দিতে পারিনি। খুবই মন খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। আমরা কিন্তু বছরের শুরুতে সঠিকভাবেই চাহিদা দিয়েছি। এরপর দুই সপ্তাহ ধরে শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের কোনো বই দেওয়া হয়নি। অথচ প্রাথমিকের শতভাগ বই আমরা পেয়েছি।’
একই কথা বলেন আইডিয়াল পাবলিক স্কুলের অধ্যক্ষ নার্গিস আক্তার। তার স্কুলেও মাধ্যমিকের কোনো বই দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের সবাই মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছে।
ক্যান্টনমেন্ট থানার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনী নানা দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এ ছাড়া অফিসে লোকবলেরও সংকট রয়েছে। ফলে যেসব স্কুলের ইআইআইএন নম্বর নেই, তাদের বই আমরা এখনো দিইনি। হয়তো কাল-পরশু থেকেই তাদের বই দেওয়া শুরু করব। তবে আমাদের বইয়ের সংকট নেই।’ তাহলে বই উৎসব কীভাবে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাল-পরশুর মধ্যেই তারা বই পাবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ এবং ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ ও ‘বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠ’ বইয়ের চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি ছাপাখানাগুলোয় দেরিতে দেওয়ার কারণেই এসব বই ছাপা ও সরবরাহে দেরি হচ্ছে। এ দুই শ্রেণির প্রায় দেড় কোটি বই এখনো শেষ করতে পারেনি ছাপাখানাগুলো। জানা গেছে, এ দুই শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু হচ্ছে চলতি শিক্ষা বছরে। জানা গেছে, গত বছর নতুন কারিকুলামের নানা ভুলভ্রান্তি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। এবার সমালোচনা এড়াতে এই দুই শ্রেণির কয়েকটি বই অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের নামে কালক্ষেপণ হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের পর এ বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই মূলত বিলম্ব করেছে মন্ত্রণালয়। এদিকে বেশির ভাগ বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকরা। তারা বলছেন, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপা হয়েছে। প্রাথমিকের বই উৎসব উপলক্ষে গতকাল মিরপুরে কেন্দ্রীয়ভাবে ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বই উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে মাধ্যমিকে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বই উৎসব হয়নি। কেন্দ্রীয়ভাবে বই উৎসব না হলেও সারা দেশের স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হয়।
এ বছর মাধ্যমিকে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো বই উৎসব হয়নি। তবে প্রাথমিকের বই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল রাজধানীর ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সারা দেশে শতভাগ বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির মোট ১৫০ লটের মধ্যে ১০০ লটের বই চলে গেছে। নবমেও অল্প কিছু বই পাঠানো বাকি রয়েছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণি মিলিয়ে মাত্র দেড় কোটি বই পাঠানো বাকি আছে, যা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (৭ জানুয়ারি) আগেই পৌঁছে যাবে।