রাজেকুজ্জামান রতন
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:১৪ এএম
প্রতীকী ছবি।
একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিন অঙ্গের অন্যতম হলো সংসদ বা আইন সভা। সেই আইন সভার সদস্য নির্বাচন তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংসদ সদস্য নির্বাচনের মহাযজ্ঞকে বলা হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এগারোটি জাতীয় নির্বাচন শেষে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন শেষ হলো, কিন্তু নির্বাচন যে বিতর্কের জন্ম দিয়ে গেল তা সহজেই শেষ হবে না। ক্ষমতাসীনরা বলছেন অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন তারা, বিরোধী পক্ষ বলছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সকল অঙ্গকে কাজে লাগিয়ে অবাধে সুনিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছে যা নির্বাচন থেকে গণতন্ত্রকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এই বিতর্ক কত দিন চলবে তা জানা নেই তবে আগামী দিনে নির্বাচনের প্রশ্ন এলে ২০২৪ সালের নির্বাচন একটি বিশেষ গুরুত্ব নিয়েই আলোচিত হবে।
নির্বাচন জনমত যাচাইয়ের একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কিন্তু দেশের মানুষ সেটা যেন ভুলে যেতেই বসেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে একদলীয় নির্বাচনের যে ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছে তাতে মানুষ ভাবছে- ভোট দেব যেখানেই, পড়বে কিন্তু একখানেই। অর্থাৎ এক দলের পক্ষেই যাবে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন হচ্ছে, প্রতিযোগিতা হচ্ছে এক ব্যক্তির দুই হাতের মধ্যে কোন হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে তা বাছাই করার মতো। ২০১৪, ২০১৮-এর ধারাবাহিকতায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-িত ২০২৪-এর নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। হয়তো পৃথিবীর কোনো কোনো দেশ এই পদ্ধতি তাদের দেশেও প্রচলন করতে পারে।
এবারের নির্বাচন ছিল অনেক দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। ক্ষমতাসীন সরকার চাইলে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারে তার সর্বশেষ নজির এবারের নির্বাচন। এর আগে বর্জন প্রতিরোধ সত্ত্বেও ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৪ সালে নির্বাচন হয়েছিল। সেই সব নির্বাচনে সহিংসতা হয়েছে, ব্যাপক ধরপাকড়, নির্যাতন হয়েছে কিন্তু এবারের নির্বাচন সেসবের তুলনায় অনেকখানি আলাদা। এবার একই দলের নেতা-কর্মীরা ভাগ হয়ে পাল্টা প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করেছেন, নিজের দলের বহুদিনের আবেগময় প্রতীকের বিরুদ্ধে প্রচারণা করেছেন, জোটসঙ্গীরা ভোটসঙ্গী হতে পারেননি, তাদেরকেও জোটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে, নতুন এবং হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দল এবং কী এক আশায় আকস্মিক দাঁড়িয়ে যাওয়া নেতারা মাঠে ছিলেন, ভোট চাওয়ার প্রতি আগ্রহ না থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের অনুগ্রহ পাওয়ার আকুতি ছিল তাদের। বিরোধী দল কারা হবে সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেকেই বিজয়ী হবেন এবং তাদের সংসদে অবস্থান কী হবে- এ নিয়ে চিন্তা বা দুশ্চিন্তা আর ট্রেনে আগুন নির্বাচনকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। এ সত্ত্বেও নির্বাচন হয়ে গেল। কিন্তু যে প্রশ্নগুলো রেখে গেল তার উত্তর খুঁজতে হবে বহুদিন। আর এই দৃষ্টান্ত যদি পরবর্তীকালেও ক্ষমতাসীন দল অনুসরণ করতে থাকে, তাহলে গণতন্ত্র থাকবে তলানিতে, জনগণকে ভুগতে হবে সমস্ত দিক থেকে আর রাষ্ট্রের চরিত্র হয়ে উঠবে স্বৈরতান্ত্রিক।
এবারের নির্বাচনবিরোধী দলসমূহের বর্জনের পরও ৫৭১ জন কোটিপতি নির্বাচন করেছেন। কিন্তু প্রার্থীদের মধ্যে রাজনীতিবিদের সংখ্যা মাত্র ২.৮৬ শতাংশ। স্বাধীনতার পর থেকে নির্বাচনে ও সংসদে কোটিপতিদের অংশগ্রহণ বাড়ছে আর রাজনীতিবিদের সংখ্যা কমছে। তবে এবার তা নতুন রেকর্ড করেছে। প্রশ্নও উঠতে পারে যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে বৈধ অবৈধ প্রভূত সম্পদের মালিক বনেছেন, তারা জনগণের সেবা করার জন্য সুযোগ পেতে কেন এত মরিয়া হয়ে ভোটের প্রার্থী হতে চান? নির্বাচিত হলে পাঁচ বছর নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেবেন তারা। কিন্তু এত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সেবা করার সুযোগ পাওয়া অত সহজ নয়। সে এক এলাহি কারবার এবং কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। নমিনেশন পাওয়া থেকে শুরু করে নির্বাচিত ঘোষণা করা পর্যন্ত কত জটিল পথ পাড়ি দিতে হয় প্রার্থীদেরকে, এসব মানুষ দেখে। কিন্তু ভেতরের কথা হলো, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিজেদের শাসক নির্বাচনের পদ্ধতি হলো নির্বাচন। কিন্তু এই শাসক নির্বাচনটাও শাসিতরা সুষ্ঠুভাবে করতে পারছে না। ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ এক দীর্ঘসময় পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন। এই সময়ে ব্যালট পেপারের হেলিকপ্টার ভ্রমণ থেকে ডামিপ্রার্থীর নির্বাচন দেখা হয়ে গেল। নির্বাচন উৎসবের পরিবর্তে জনগণের কাছে আতঙ্ক আর প্রার্থীদের জনগণের টাকায় আখের গুছানোর প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। জনমত বা জনচেতনা সৃষ্টির পথ দিন দিন কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ছে।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব যাদের হাতে সেই নির্বাচন কমিশন নানা চাপের মধ্যে থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ দৃশ্যমান করা এবং ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত পরিবেশ শান্ত রাখার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। নির্বাচনে সকল গুরুত্বপূর্ণ দলসমূহ অংশ না নেওয়ায় এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কত মানুষ ভোট দিয়েছে সেই বিষয়। ফলে ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে যান, সেটা ইসির অন্যতম প্রধান দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল। ইভিএম নিয়ে নানা বিতর্ক ও ডলার সংকটের কারণে শেষ পর্যন্ত এবার নির্বাচন হয়েছে ব্যালটে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, নির্বাচন নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে দুর্গম ও চরাঞ্চল এলাকায় অবস্থিত প্রায় তিন হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোটের আগের দিন শনিবার ব্যালট পাঠানো হবে। বাকি ৩৯ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার যাবে। এবার নির্বাচনে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ৪২ হাজার ১৪৯ জন আর ভোটার সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখ। ইসির কর্মকর্তারা বলেছিলেন, গত নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ রয়েছে। এবার যাতে ওই অভিযোগ না ওঠে, সেই সতর্কতা থেকে ভোটের দিন সকালে ব্যালট পেপার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আশংকা ও হতাশার এ নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা যাতে মোকাবিলা করা যায় সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮ লাখ সদস্য মাঠে ছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত ১৪ দল, জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। ইসির হিসাব অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন ১৯৭০ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল ২৬৬টি আসনে। কিন্তু প্রার্থী সংখ্যা যা-ই হোক ভোটের ফলাফলে দেখা গেল বিজয়ী ঘোষিত প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের অর্ধেকের কম ভোট পেয়েছেন বাকি সব প্রার্থী মিলে। ১৫৫ জন বিজয়ী এমপির প্রাপ্ত ভোটের ধারে কাছেও নেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
এ যাবৎকালে অনুষ্ঠিত প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশেষ ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রতিটি নির্বাচনে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচনকালীন সহিংসতা। কিন্তু এবারের চ্যালেঞ্জ যেন সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে। নির্বাচনের প্রধান বিবেচনা যে ভোটারদের ভোট, সেই ভোটারগণ কেন্দ্রে আসবেন কিনা সেই চ্যালেঞ্জটাই ছিল বড়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসেন তার সকল ব্যবস্থা করেছিলেন ক্ষমতাসীন দল। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য নানা সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। পাশাপাশি নির্বাচনে ভোটগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে নির্বাচন কমিশনও। ভোটারদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বিগত নির্বাচনে যানবাহনের ওপর যে ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল, এবার তা অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছিল।
এত কিছুর পরও কিন্তু ভোটার অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেল। ভোটার উপস্থিতি ২৮ শতাংশ নাকি ৪০ শতাংশ সেই বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে অনেকেই ধারণা করে বলছেন ভোটার উপস্থিতি ২০ শতাংশের বেশি হবে না। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কীভাবে বলা হবে? যেখানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরাই অংশ নেয়নি, সেখানে অংশগ্রহণমূলক কীভাবে হবে। আর তাতে নির্বাচন স্বচ্ছ হলেও গ্রহণযোগ্য হওয়ার পথ কি খোলা আছে? ফলে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা নির্বাচনের পরও চলতে থাকবে। গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা সুরক্ষিত হয়েছে এই দাবি এবং আইনগতভাবে বৈধ হয়েছে এভাবে উতরে গেলেও জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হবে এই নির্বাচন।
লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাসদ