শীতে বাড়ছে আগুনে পোড়া রোগী, সংকটে ধুকছে শেবাচিমের বার্ন ইউনিট

বরিশাল প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:০৮ পিএম | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:০৫ এএম

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ছবি- সাম্প্রতিক দেশকাল

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ছবি- সাম্প্রতিক দেশকাল

গত কদিন ধরেই বরিশালের তাপমাত্রার পারদ নিম্নমুখী। মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ঠেকেছে ১০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াতে। ফলে শীতের তীব্রতার সাথে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে বাড়ছে অগ্নিদগ্ধ রোগী। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না এ হাসপাতালে।

এর নেপথ্যের কারণ চিকিৎসকসহ দক্ষ জনবল এবং জায়গা সংকট। কাঙ্ক্ষিত সেবা এবং জায়গা সল্পতার কারণে বার্ন ইউনিটের রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে সাধারণ সার্জারি বিভাগে। আর গুরুতর দগ্ধ রোগীদের পাঠাতে হচ্ছে ঢাকায়।

তবে চলমান সংকট থাকবে না বলে জানিয়েছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, খুব শীঘ্রই শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বতন্ত্র বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট নির্মাণ হবে। চলতি বছরেই নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে আশাবাদী তিনি।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি সময়ে প্রায় প্রতিদিনই অগ্নিদগ্ধ রোগী আসছে এই হাসপাতালে। যার মধ্যে বেশিরভাগ শীতের থেকে ঊষ্ণতা পেতে আগুন পোহাতে গিয়ে অথবা গরম পানিতে ঝলসে যাওয়া রোগী। আর দগ্ধ রোগীদের মধ্যে বয়স্ক এবং শিশু রোগীর সংখ্যাই বেশি। এসব রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে।

সরেজমিনে হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে দেখা যায়, নির্ধারিত ৩০টি শয্যায় ৩০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে এদের মধ্যে রবিবার দুপুর পর্যন্ত ২০ রোগী ছিল আগুনে পোড়া। যাদের মধ্যে শিশু রোগীর সংখ্যাই বেশি। এর বাইরে সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন রোগীদের চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে এই ইউনিটটিতে।

বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্স (ব্রাদার) লিংকন দত্ত জানান, শীতের এই সময়টাতে আগুনে পোড়া রোগীর চাপ কিছুটা বেশিই থাকে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত ১৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে বার্ন ইউনিটে। তবে গুরুতর দগ্ধ রোগীদের এখানে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঢাকা বার্ন ইউনিটে পাঠাতে হচ্ছে। তবে সেটা সার্জারি বিভাগ থেকে প্রেরণ করা হয়। যে কারণে ঢাকায় রেফার হওয়া রোগীর সঠিক হিসেব নেই বার্ন ইউনিটে।

লিংকন দত্ত বলেন, ২০১৫ সালের ১২ মার্চ হাসপাতালের মূল ভবনের পাশে হৃদরোগ ভবনের নিচতলায় আটটি শয্যা নিয়ে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ চালু হয়। বর্তমানে শয্যা সংখ্যা ৩০টি। নির্ধারিত ৮টি শয্যার বাইরে বাকি শয্যাগুলো রোগীদের প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থাপনকালে ৮ জন চিকিৎসক ও ১৬ জন নার্সের পদ রাখা হয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। শুরুতে ইউনিটটি পরিচালনার দায়িত্ব পান সহকারী অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। বছরখানেক পর তিনি অবসরে গেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক শাখাওয়াত হোসেনকে সেখানে পদায়ন করা হয়। কিন্তু তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেননি। পরে জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ এ কে এম আজাদকে বার্ন ইউনিটের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল নগরীর একটি বেসরকারি ক্লিনিকের লিফটের নীচ থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এর পরপরই একই বছরের ১৫ মে চিকিৎসক শূন্যতায় আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটটি।

এর মধ্যেই ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ৪৩ জনের মৃত্যু ও অর্ধশতাধিক মানুষ দগ্ধ হন। প্রাথমিক অবস্থায় গুরুতর ৮৬ জন দগ্ধ রোগীকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এখানকার বার্ন ইউনিটে চিকিৎসক না থাকায় ঢাকা থেকে সাতজন চিকিৎসককে এই হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

এ নিয়ে সমালোচনায় পড়তে হয় গোটা স্বাস্থ্য বিভাগকে। এর প্রেক্ষিতে বন্ধ থাকার ২০ মাস পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে একই স্থানে পুনরায় চালু করা হয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটটি। কিন্তু চালু হওয়ার গত দুই বছরেও সংকট কাটেনি ইউনিটটিতে। বরং সংকট ক্রমশ বাড়ছে।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মারুফুল ইসলাম জানান, অধ্যাপকের পদ শূণ্য। সহযোগী অধ্যাপকের দুটি পদের মধ্যে আমি একাই আছি। তাছাড়া সহকারী অধ্যাপক দুজন থাকলেও মিডলেভেল চিকিৎসকের সকল পদই শূণ্য। রেজিস্ট্রার-সহকারী রেজিস্ট্রারের ৫টি পদই শূণ্য। নেই মেডিকেল অফিসার। ১৪ জন স্টাফ নার্স রোটেশন অনুযায়ী কাজ করলেও এদের মধ্যে একমাত্র যিনি ইনচার্জের দায়িত্ব আছেন তিনিই সংশ্লিষ্ট কাজের বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফলে রোগীদের সেবা দেওয়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকাটা জরুরি। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির কর্মসূচির সংকটের কারণে সেই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া যেই ভবনটিতে বার্নের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সেই জায়গাটাও উপযুক্ত নয়। ভবনের অবস্থান ভালো না, রোগীদের অস্ত্রপচারের জায়গা নেই, ড্রেসিং রুম একটি থাকলেও তার অবস্থা বেহাল।

ডা. মারুফুল ইসলাম বলেন, যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো না। এই ভবনের প্রধান গেটটি বন্ধ করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এ কারণে দীর্ঘ পথ ঘুরে এখানে আসতে হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে গেটটি খুলে দেওয়ার জন্য বহুবার বলেছি। কিন্তু মালামাল চুরি হওয়ার অজুহাতে তিনি গেটটি খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন না। তাই এই মুহূর্তে বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগটি স্থানান্তরের পাশাপাশি পর্যাপ্ত জনবলের ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

এ প্রসঙ্গে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, গোটা হাসপাতালেই জায়গা সংকট। যে কারণে প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ইউনিটটি স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই সংকট কেটে যাবে জানিয়ে পরিচালক বলেন, স্বতন্ত্র ‘বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি’ ইউনিট স্থাপনে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য হাসপাতালের বর্তমান মডেল ফ্যামিলি প্লানিং ক্লিনিক অথবা পুরাতন ভবনের পশ্চিম পার্শ্বের পুকুর পাড়ে সম্ভাব্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি বছরেই ১৫ তলা ভবনের কাজ শুরু হবে। এর মধ্যে পাঁচতলা বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট এবং বাকি তলাগুলো অন্যান্য বিভাগের জন্য ব্যবহার করা হবে। আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যেই এ হাসপাতালে স্বতন্ত্র বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি চিকিৎসায় পূর্ণতা পাবে বলে আশাবাদী হাসপাতাল পরিচালক।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh