সমাজের শিকল ভাঙার প্রেম

আনিস মণ্ডল

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:৪৪ পিএম | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:৪৭ পিএম

শাহনাজ খুশি ও বৃন্দাবন দাস।

শাহনাজ খুশি ও বৃন্দাবন দাস।

গ্রামবাংলার সহজ-সরল মানুষের হৃদয়পোড়া গল্প টেলিভিশনের পর্দায় উপস্থাপনের জন্য যদি কারও দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হয়, তাহলে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে প্রখ্যাত নাট্যকার বৃন্দাবন দাসের ছবি। আর গ্রামীণ মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠা কোনো অভিনেত্রীর কথা ভাবতে গেলে নিঃসন্দেহে আসবে শাহনাজ খুশির নাম। তাদের সৃষ্টি অকপটে বলে, সমাজের না বলা দুঃখ-কষ্ট, হাসি-আনন্দের কথা। বৃন্দাবন দাসের নাটক দেখে হৃদয় নিংড়ানো দুফোঁটা চোখের জল ফেলেননি এমন মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট কম। আবার ‘হাড়কিপটে’ নাটকে বহরের (চঞ্চল চৌধুরী) মৃত্যুর পর শিবানী রানী দত্তের (শাহনাজ খুশি) আর্তনাদ কাঁদায়নি এমন মানুষও পাওয়া যাবে না খুব একটা। এ তো তাদের সৃষ্টির গল্প। এত এত দুঃখ-কষ্ট ফেরি করে বেড়ানো মানুষ দুটির জীবনেও এসেছে অনেক দুঃখ-কষ্ট। হারানোর ব্যথা কিংবা না পাওয়ার হতাশা। হাজারো কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে বৃন্দাবন দাস ও শাহনাজ খুশির দাম্পত্য জীবন আজ উদাহরণ। তাদের প্রেম অস্বীকার করেছে সমাজে খুঁটি গেড়ে থাকা হাজার বছরের অন্ধকার। তাদের প্রেমের কাছে হেরে গেছে ধর্মীয় গোঁড়ামি। তাদের প্রেম শিখিয়েছে হাজারো বাধা ডিঙিয়ে পাশাপাশি হাত ধরে বাঁচতে। সেই সব গল্প নিয়েই দেশকাল পত্রিকার শিল্পী দম্পতি আসরে এবার উপস্থিত বৃন্দাবন দাস ও শাহনাজ খুশি। তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিস মণ্ডল।

বৃন্দাবন দাস
দেশের একজন জনপ্রিয় নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক। ১৯৬৩ সালের ৭ ডিসেম্বর পাবনার চাটমোহর উপজেলার সাঁরোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা দয়ালকৃষ্ণ দাস ছিলেন প্রখ্যাত কীর্তনশিল্পী, পদাবলি কীর্তন ও সাহিত্যে অগাধ পা-িত্যের অধিকারী। তার মায়ের নাম ময়না রানী। 

‘বন্ধুবরেষু’, ‘মানিক চোর’, ‘বিয়ের ফুল’, ‘গরু চোর’, ‘হাড়কিপটে’, ‘সার্ভিস হোল্ডার’, ‘ঘর কুটুম’, ‘পাত্রী চাই’, ‘তিন গেদা’, ‘আলতা সুন্দরী’, ‘সম্পর্ক’, ‘সাকিন সারিসুরি’ ও ‘কাসু দালাল’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকের রচয়িতা বৃন্দাবন। নাটকে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) ও বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিআরএ) সেরা নাট্যকার পুরস্কার লাভ করেন তিনি। 

১৯৮৫ সালে চাটমোহর সাংস্কৃতিক পরিষদে ‘চোর’ নাটকের ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে শুরু তার। পরে ঢাকায় নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের আরণ্যক নাট্যদলে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে আরণ্যক ছেড়ে ‘প্রাচ্যনাট’ গঠন করেন এবং ‘কাঁদতে মানা’ নামক নাটকটি লেখেন।

শাহনাজ খুশি
দেশের টিভি নাটকের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। খুশি তার অভিনয় জীবনের সূচনা করেছিলেন নব্বইয়ের দশকে। পরবর্তী সময়ে মঞ্চ ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন। তিনি ‘ভবের হাট’, ‘সাকিন সারিসুরি’, ‘হাড়কিপটে’, ‘গরুচোর’, ‘হারাধনের একটি বাগান’ ও ‘পাল বাড়ি’সহ একাধিক জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেছেন।

খুশির বড় ভাই খন্দকার বজলুল করিম বৃন্দাবনের বন্ধু। সেই সূত্রেই তাদের চেনাজানা। খুশি যখন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী, সেই সময়ই তাকে প্রেমের জালে ফেলেন বৃন্দাবন। জালে আটকেও যান বালিকা। লুকোচুরির প্রেমের গল্প লিখতে লিখতেই একদিন তাদের জীবনে নেমে আসে বাস্তবতা নামক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার চিত্র। সব ছেড়ে ঢাকায় এসে বৃন্দাবনের হাত শক্ত করে ধরেন খুশি। দুই ধর্মের দুই মানুষের একসঙ্গে ঘর বাঁধতে তাদের ছাড়তে হয় নিজ ঘর, স্বজন ও চেনা পরিবেশ। 

এরপর কেটে গেছে ২৮টি শীতবসন্ত। সুদীর্ঘপথের যাত্রাটা আদৌ মসৃণ ছিল না। ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলেন বাবার সবচেয়ে আদরের কন্যা খুশি। এরপর সেই বাবার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হয়নি। এমনকি বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে বিএনপির ডাকা হরতালের মধ্যে ১৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ১৭ বছর পর পাবনা গিয়েও স্বজনদের বাধায় দেখা পাননি বাবার। অথচ বছরখানেক পরই নিজ জেলায় ২৫ হাজার মানুষের সামনে বিশাল সংবর্ধনা দেওয়া হয় এই দম্পতিকে। ধীরে ধীরে ফিরে আসেন স্বজনরাও। 

বৃন্দাবন মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তারাও খুব বেশি দূরে ঠেলতে পারেননি। দিনে দিনে অন্ধকার কেটে জ্বলে ওঠে আলোর শিখা। তাদের ঘর আলো করে আসে দুই যমজ পুত্রসন্তান। একসময়ের অভাব অনটনের সংসার ভরে ওঠে ফুলে-ফলে। 

১৯৯৪ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এই দম্পতি। বিয়ের ২৪ বছর পর ফেসবুকে একটি গল্প শোনান খুশি। তাদের দাম্পত্য জীবনের সেই গল্পটিই মেপে দিতে পারে তাদের সম্পর্কের গভীরতা কত বিশাল। টাকার অভাবে বিয়ের প্রথম সাত মাস তাদের একটা ডিমও খাওয়া হয়নি, মাছ-মাংস দূরেই থাক। প্রায় প্রতিদিনই তাদের পেঁপে ভর্তা ও ভাত দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হতো। এ অবস্থায় একদিন অফিসের কাজে বৃন্দাবনকে মেট্রোপলিটন হোটেলে যেতে হয়। সেখানে সমাজ রক্ষার্থে সবার সঙ্গে তাকেও মাছ-মাংস খেতে হয়। এরপর বাড়ি ফিরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন বৃন্দাবন। খুশির ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ভীষণ কান্নাকাটি। তার কান্নাকাটি দেখে আমি খুবই হতবাক হয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো আমাদের বাড়িতে কেউ মারা গেছে। তারপর সে যখন শান্ত হলো তখন সে আমার হাত ধরে বলে, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, ক্ষমা করে দাও। কী ক্ষমা করে দেব? তখন বলে, তোমাকে রেখে মাছ-মাংস দুটি দিয়েই ভাত খেয়ে এসেছি আজ।’ 

সেসব দিনের কথা স্মরণ করে খুশি বলেন, ‘একটা সময় ছিল রোজ মনে হতো, মরে যাই! এখন রোজ মনে হয়, অনেক দিন বেঁচে থাকি।’

বৃন্দাবন ও খুশির যমজ দুই সন্তানের নাম দিব্য জ্যোতি ও সৌম্য জ্যোতি। মা-বাবার মতো তারাও অভিনয়ের মাধ্যমে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ‘কারাগার ২’, ‘কাইজার’, ‘ইন্টার্নশিপ’, ‘মহানগর ২’ সিরিয়ালের মাধ্যমে তারাও বেশ আলোচনায়। তবে তাদের অভিনয়ের যাত্রা শুরু আরও আগেই। সৌম্য প্রথম ‘পাদুকা বিতান’ নাটকে চঞ্চলের শৈশবের চরিত্রে অভিনয় করেন। দিব্যর শুরু ‘সন্তান’ নাটক দিয়ে। দুই সন্তানের চেহারা হুবহু একই রকম হওয়ায় প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় বৃন্দাবন ও খুশিকে। এমনকি ভক্তরা বুঝতে পারেন না, কোনজন সৌম্য আর কে দিব্য। 

এ-সংক্রান্ত মজার দুটি গল্পও শোনান খুশি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘ছেলেদের চিনতে বাবা বৃন্দাবন প্রায়ই ভুল করে বসেন। একবার এক ছেলের জ্বর এসেছে; কিন্তু বৃন্দাবন ওষুধ খাইয়ে দেন আরেকজনকে। পরে সে ওষুধ খেয়ে বলে, বাবা আমার তো জ্বর না। আরেকবার একজন দুষ্টুমি করে চলে যাওয়ার পর অন্যজনকে কাছে পেয়ে ভুল করে চড় কষে দেন বৃন্দাবন।

ছেলেদের নিয়ে খুশি বলেন, ‘তাদের কাছে আমার চাওয়ার কিছু নেই। কখনোই তাদের বলিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে হবে। বরাবরই বলি, ভালো মানুষ হতে। সৎ থাকুক। তারা ভালো থাকলেই আমরা খুশি।’

দুই ছেলের সঙ্গে খুশি ও বৃন্দাবন।

বৃন্দাবন ও খুশি বেড়ে উঠেছেন এক অজ পাড়াগাঁয়ে। শৈশবে বিদ্যুতের আলো দেখা হয়নি। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় প্রথম দেখা মিলেছে টেলিভিশনের। পরে তারই রচনায় সেই টেলিভিশনের মাধ্যমে গ্রাম দেখেছে শহরের মানুষ, দেখেছে গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ। গ্রামের সেসব দিন এখনো সমানভাবে কাছে টানে এই প্রখ্যাত নাট্যকারকে। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই গ্রামে কেটেছে। অনার্স পড়তেই ঢাকায় আসা। কৈশোর ও যৌবনের শুরুটা গ্রামের মানুষের সঙ্গেই না শুধু একদম মাটির সঙ্গে কেটেছে। সে কারণে ওখান থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পারিনি এখনো। আর পারবও না হয়তো। নিজ হাতে কৃষির সব ধরনের কাজ করেছি আমি।’

কী হতে চেয়েছিলেন বৃন্দাবন? জানতে চাইলে এই অভিনেতা বলেন, ক্যারিয়ার নিয়ে কখনো স্বপ্ন দেখিনি। একটা সময় ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম। সেসব নিয়ে অনেক গল্প আছে। এরপর আর কখনো কিছুই খুব পরিকল্পনা করে করিনি।

বৃন্দাবন ও খুশির মতো সফল তারকা দম্পতিকে দেশকাল পত্রিকার পক্ষে একটি প্রশ্ন করা হয়, কোন সে মূলমন্ত্র, যার বলে পথচলা সুদীর্ঘ হয়, একজনের হাতে হাত রেখেই কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাজীবন? উত্তরে বৃন্দাবন বলেন, ‘মন্ত্রটন্ত্র কিছু না। থাকতে হয় পরস্পরকে বুঝতে পারা, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ও চাহিদার লাগাম টানার সক্ষমতা। লাগামটা নিজের হাতে রাখা। চাহিদা সীমিত রাখলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’ 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh