টাঙ্গাইলের তাঁত: বন্ধ হচ্ছে মাকুর শব্দ

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৫০ এএম | আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:২৫ এএম

টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি; নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ভালোবাসা।

টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি; নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ভালোবাসা।

টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি; নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ভালোবাসা। এখানকার তাঁতিরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর বলে জানা যায়। যাদের আদিনিবাস ছিল ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট। তারা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘারিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইল যায় এবং পরবর্তীকালে সেখানে বসবাস শুরু করেন। শুরুতে এখানকার তাঁতিরা নকশাবিহীন কাপড় তৈরি করত। ১৯২৩-২৪ সালে তাঁতের কাপড়ে নকশা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৩১-৩২ সালে শাড়ি তৈরির জন্য জ্যাকার্ড তাঁত প্রবর্তন করা হয়। এর সঙ্গে বাস্তুপাড়া মুখরিত হয় মাকুর খটখট শব্দে। 

ইতিহাসের ধূসর পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বী বসাক সম্প্রদায় আদি তাঁতি, তন্তুবায় গোত্রের লোক। এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে আসে। মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে ঢাকার ধামরাই। এখানে আবহাওয়া, তাঁতের কাজ, কাঁচামাল ইত্যাদি ভালো হওয়ায় তারা পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই তাঁতিরা টাঙ্গাইলে এসে বসতি স্থাপন এবং কাজ শুরু করে। কালের পরিক্রমায় বসাক ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাঁতশিল্পের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে এবং তারা বসাক তাঁতিদের মতোই দক্ষ হয়ে ওঠে। মরক্কো দেশীয় পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চীনা পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের বর্ণনায় এ অঞ্চলের তাঁতশিল্প, কাপড় বুনন এবং তুলা থেকে সুতা তৈরির উল্লেখ আছে। গবেষক জেমস টেলরের লেখায় মির্জাপুর অঞ্চলে তুলা চাষ এবং তুলা থেকে সুতা কাটার কথা বিবরণ রয়েছে। 

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

টাঙ্গাইলের তাঁতিরা মসলিন শাড়ি বুনতেন বলে শোনা যায়। দিল্লির মোগল দরবার থেকে ব্রিটেনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এই মসলিনের সমাদর ছিল। ব্রিটিশ বণিকদের ষড়যন্ত্র আর ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের অভিঘাতের শিকার হয়েছে মসলিন। কিন্তু তার সার্থক উত্তরাধিকার হয়ে আজও টিকে রয়েছে টাঙ্গাইলের জামদানি, বেনারসি ও তাঁতের শাড়ি। বর্তমানে তাঁতশিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে সুতা, বুনন ও কাপড়ে। টাঙ্গাইলের সফট সিল্ক ও কটন শাড়ি এখন সবার নজর কেড়েছে এর বুনন ও ডিজাইনের কারণে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কারুকাজ। আবার তাঁতিরা তাঁতের শাড়ি ছাড়াও হাল-আমলের নানা রঙ ও ডিজাইনের থ্রিপিস, লুঙ্গি, গামছা, চাদর, ওড়না ইত্যাদি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। 

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

টাঙ্গাইল জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার, কালিহাতী, নাগরপুর, সখীপুর উপজেলা হচ্ছে তাঁতবহুল এলাকা। তা ছাড়া ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলায়ও তাঁতশিল্প রয়েছে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে হাতের কাজ করা হয় খুব দরদ দিয়ে, গভীর মনোসংযোগের সঙ্গে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুদৃশ্যভাবে। 

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

ভারতভাগের পূর্বে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বাজার বসত কলকাতায়। এখনো এর প্রভাব আছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে টাঙ্গাইল তাঁতের প্রধান হাট হচ্ছে টাঙ্গাইলের বাজিতপুর এবং পরে করটিয়া। বাজিতপুর হাট টাঙ্গাইল মূল শহর থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত আর করটিয়া আট কিলোমিটার দক্ষিণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসংলগ্ন। বাজিতপুরে সপ্তাহের প্রতি সোম ও শুক্রবার হাট বসে আর করটিয়ার হাট বুধ-বৃহস্পতিবার। ভোররাত থেকে এখানে হাট শুরু হয়ে সকাল ৯-১০টা পর্যন্ত চলে। এই হাটের বেশিরভাগ ক্রেতাই মহাজন শ্রেণির। পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও এই হাট থেকে অনেকে পছন্দের শাড়ি কিনে নিয়ে যান। ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, জাপান, সৌদি আরব, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ পশ্চিম বাংলায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যাপক কদর থাকলেও এই শাড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে মার খাচ্ছে নানা কারণে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১. দামের জন্য (টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ে যায়); ২. ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসন (ভারতের শাড়ি দামে সস্তা); ৩. টাঙ্গাইল শাড়ির বিপণনব্যবস্থা মহাজনি চক্রের হাতে বন্দি; ৪. গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ও সাশ্রয়ী দাম। 

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

সুন্দর একটা শাড়ি বুনতে তাঁতিদের ৪/৫ দিন লেগে যায়। তাতে যে দাম পড়ে ওই টাকা দিয়ে শাড়ি কেনার লোক কম। ফলে হ্যান্ডলুম তাঁতের শৌখিন তাঁতিরা মার খাচ্ছে। ইদানীং বিভিন্ন বড় বড় বুটিক কোম্পানি তাঁতিদের বেশি টাকা দিয়ে নিজেদের জন্য শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস বোনে। কোম্পানিগুলোর টাকার কাছে হারাচ্ছে ঐতিহ্য। 

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

পাথরাইল আকন্দ পাড়ার তাঁতি আবদুল আলম জানান, তারা যে লুঙ্গি বোনেন তাতে একটা লুঙ্গিতে খরচ পড়ে ৩০০ টাকা। তারা বিক্রি করেন ৪০০ টাকায়। যারা কিনলেন তারা শহরে নিয়ে বিক্রি করেন ৮০০ টাকায়। তাদের ৩০০ টাকা শ্রম সুতো রঙ সবসহ লাভ ১০০। আর মহাজনরা ১০০ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে লাভ করল ৩০০ টাকা। তাহলে এই লাভের দূরত্ব কমে কীসেপ্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের সমিতি করে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে ট্রাক কিনে দিলে আমরা গিয়ে শহরে বিক্রি করলে ক্রেতাদের লাভ, লাভ হয় আমাদেরও। সরকার কি তা করবে? এদিকে খেয়াল না দিলে মাকুর শব্দ একদিন বন্ধ হয়ে যাবে, টাঙ্গাইল শাড়ি ইতিহাসের পাতায় বন্দি হয়ে থাকবে।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh