টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই বিতর্ক

প্রতীক সিফাত

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:১৪ এএম

টাঙ্গাইল শাড়ি। ফাইল ছবি

টাঙ্গাইল শাড়ি। ফাইল ছবি

সফট পাওয়ারের এ যুগে একটি দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর বা জিআই পাওয়া পণ্যগুলো। তাই ঐতিহাসিকভাবে নিজের দেশের কোনো একটি পণ্যকে জিআইয়ের তালিকাভুক্ত করতে মুখিয়ে থাকে দেশগুলো। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় যখন একই পণ্যকে দুই দেশ নিজেদের বলে দাবি করে। এমনই ঘটনা ঘটেছে টাঙ্গাইলের শাড়ির বেলায়। 

টাঙ্গাইলে উৎপত্তি হলেও টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের নয়, বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বলে দাবি করেছে দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়িকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর। যদিও বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে প্রায় এক মাস পর, টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। বিতর্কের জেরে পোস্টটি অবশ্য পরবর্তী সময়ে সরিয়ে নেওয়া হয়।

শাড়িটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাঁতি ও ব্যবসায়ীদের মতে, ঐতিহাসিকভাবেই টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের। শাড়িটির উৎপত্তির বিষয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুরাম বসাক বলেন, আজ থেকে ২০০-২৫০ বছর আগে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে তাঁতের শাড়ি বোনা হয়। সেই থেকে শুরু এর যাত্রা। এই এলাকার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় শাড়ি বোনার তন্তুটা নরম থাকে। চাকচিক্য বেশি থাকে। এর ফলে শাড়ির গড়ন আলাদা হয়; যা এটিকে করে তুলে অধিকতর আরামদায়ক। কিন্তু একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যদি ভারত এই শাড়ি তৈরি করে তবু জলবায়ুগত পার্থক্যের জন্য তাদেরটা এত আরামদায়ক হবে না। ফলে গুণগতভাবে একটি পার্থক্য রয়েই যাবে। 

পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে ভারত কোনোভাবেই টাঙ্গাইলের শাড়ি পশ্চিমবঙ্গে উৎপন্ন হয়েছে সেটি দাবি করতে পারে না। কেননা ভারতে তাঁতের শাড়ি তৈরি শুরু হয় ১৯৪৭ সালে। সেই সময় টাঙ্গাইল থেকে অনেক বসাক তাঁতি পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। তবে ৭১-এর স্বাধীনতার সময়ও অনেক তাঁতি সেখানে চলে যান এবং একই পেশায় কাজ শুরু করেন। 

গবেষকরা বলছেন, টাঙ্গাইল নামের মধ্য দিয়েই শাড়িটির উৎপত্তির বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ছাড়া ইতিহাসও টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশের বলে সাক্ষ্য দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আশফাক হোসেন বলেন, যে কোনো স্থানের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সেখানকার সাংস্কৃতিক ইতিহাস গড়ে ওঠে। টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসটিও তাই। বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায় টাঙ্গাইলের ছেলেরা পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লুঙ্গি, গামছা। এ অঞ্চলের মেয়েরা পরিধান করে শাড়ি, যা টাঙ্গাইল শাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এ শাড়ির নাম থেকেই এর উৎপত্তিকালের সময়টা বোঝা যায়। টাঙ্গাইল অঞ্চলটি যখন থেকে গড়ে ওঠে তখন থেকেই এই শাড়ি তৈরি শুরু হয়। কিন্তু টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি ভারতে নয়। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায়ভারত থেকে বাংলাদেশে যারা বেড়াতে আসেন তারা এখান থেকেই টাঙ্গাইলের শাড়ি নিয়ে যান। 

২০১৩ সালে দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। ডব্লিউআইপিও নিয়ম মেনে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে ডিপিডিটি। 

অধিদপ্তরটির সহকারী পরিচালক মো. বেলাল হোসেন বলেন, টাঙ্গাইল শাড়িকে এখনো জিআই পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে কেন তাদের তালিকাভুক্তি করেছে সেটি প্রথমে বুঝতে হবে। ভারতের কোথাও টাঙ্গাইল নামে কোনো জায়গা আছে কিনা অথবা যদি অন্য কোনো কারণ থেকে থাকে সেটি জানতে হবে। 

বাংলাদেশ প্রথম পর্যায়ে জিআই স্বীকৃতি পায় জামদানির। তারপর আসে ইলিশ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমের স্বীকৃতি। গত ৮ বছরে মোট ২১ পণ্য জিআইয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। 

জিআই স্বীকৃতির এই তালিকায় এখনো টাঙ্গাইল শাড়িকে অন্তর্ভুক্ত করেনি ডিপিডিটি। শুধু তাই নয় এমনও ঘটেছে যেসব পণ্য বাংলাদেশে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে একই ধরনের কিছু পণ্য ভারতও তাদের জিআই হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের মধ্যে নকশি কাঁথা, জামদানি ও ফজলি আম উল্লেখযোগ্য। এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি বলে জানান ডিপিডিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। 

ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি আইনের বিশ্লেষকরা বলেন, একই পণ্যকে দুই দেশ স্বীকৃতি দেওয়ায় যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে ভারত তাদের প্রিমিয়াম পণ্য হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করে তাহলে পণ্যের মূল্য ও মূল্যায়ন দুইয়েই ব্যবধান তৈরি হবে। তাদের মতে, জিআই প্রিমিয়াম পণ্যের মূল্য ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। এই ধরনের পণ্যের প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। ফলে জিআই পণ্য হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশের জিআই স্বীকৃতি পাওয়া পণ্যগুলো। এই সংকট থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাসমতীর স্বীকৃতি নিয়ে লড়াই চলছে। অতীতে একই ভূখণ্ডে থাকায় এ সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মো. আতাউল করিম বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত ভৌগোলিকভাবে দীর্ঘদিন একই সঙ্গে অবস্থান করায় তাদের মধ্যে সংস্কৃতির বিনিময় হয়েছে। এতে করে কিছু কিছু বিষয়ের উৎপত্তি নিয়ে ঘোলাটে অবস্থা তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে ইতিহাস পাঠ করে সেগুলো মীমাংসা করতে হয়। জিআই পণ্যের স্বীকৃতির বেলায় এর ব্যতিক্রম নয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh