আমীন আল রশীদ
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৫৪ এএম | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৫৫ এএম
মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ।
ভাষাসংগ্রামী, বাংলাদেশে বামপন্থি রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের চারটি মাত্র আলোকচিত্র পাওয়া যায়, আর সেগুলো মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর তোলা। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সৈনিক। এই আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য তিনি গ্রেপ্তারও হন।
প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে তকীয়ূল্লাহ। পুরো নাম আবুল জামাল মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একজন প্রথম সারির বিপ্লবী নেতা। জীবনের একটি বড় সময় তার কেটেছে কারাগারে।
তার মেয়ে কবি ও সাংবাদিক শান্তা মারিয়া বলেন, বাবার ছাত্রজীবনে তার চাচা কলকাতা থেকে একটি ক্যামেরা এনে দিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে সেই ক্যামেরা দিয়েই তিনি ভাষা আন্দোলনের ছবি তোলেন। তবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, যেদিন ঢাকার রাজপথে রক্ত ঝরে; ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা মিছিল বের করার ফলে পুলিশ গুলি চালায়, তকীয়ূল্লাহ তখন কারাগারে। এই ঘটনার মাস কয়েক আগে তিনি গ্রেপ্তার হন। তবে বায়ান্ন সালে কারাগারে শহীদ মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘কবর’ নাটকে তিনি অভিনয় করেন। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনে ছাত্রজনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তিনি কারাগারে অনশন করেন।
ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি ত্যাগ করেছিলেন সেনাবাহিনীতে তার সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার। কেননা ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সার্ভিস সিলেকশন পরীক্ষায় তিনি অংশ নেন এবং প্রথম বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়ায় আর সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি।
১৯৪৯ সালে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং তার নামে হুলিয়া বের হওয়ায় আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৫১ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৫১-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রাজবন্দি থাকেন। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আবার গ্রেপ্তার হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৬ নম্বর সেলে বন্দি ছিলেন।
পেশাগত জীবনে তকীয়ূল্লাহ পাকিস্তান আমলে পাটকলে চাকরি করেছেন। কিন্তু এই ব্যবসা বাঙালিদের হাতে থাকা উচিত বলে মনে করতেন এবং সেখানেও তিনি শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তী সময় অবশ্য সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসে বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি চর্চারও অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। তিনি মূলত শ্রমজীবী মানুষের ছবি তুলতেন।
মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ
১৯২৬ সালে জন্ম এই বিপ্লবীর মৃত্যু হয় ২০১৭ সালে। মৃত্যুর বছরখানেক আগে একেবারে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন। কারাগারে নির্যাতনের ফলে তার রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শেষ বয়সে এসে সেটির প্রভাবে দৃষ্টিহীন হয়ে যান। অপারেশন হয়েছিল। কিন্তু তাতে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাননি। যদিও তার মধ্যেও দৈনন্দিন কাজ নিজেই করতেন। নিজের কাপড়চোপড়, এমনকি থালা বাটি গ্লাসও নিজে পরিষ্কার করতেন। ভাষার মাসে এই বিপ্লবীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।