আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪৫ পিএম | আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪৭ পিএম
প্রতি ১৫ দিনে একবার পানির ট্যাঙ্কার আসে পাড়া-মহল্লায়। ছবি: পিটিআই
বাসাবাড়িতে নেই সরবরাহকৃত পানি। কলে চাপ দিলে উঠছে না ভূগর্ভস্থ পানি। কৃত্রিম হ্রদ ফেটে চৌচির। এমন পরিস্থিতিতে প্রতি ১৫ দিনে একবার পানির ট্যাঙ্কার আসে পাড়া-মহল্লায়। ট্যাঙ্কার আসামাত্রাই হাজার হাজার মানুষ বালতি, কলস নিয়ে দৌড়াতে থাকেন এর পেছনে। কেউ পায়, আবার কারও ফিরতে হয় খালি হাতেই।
ভারতের প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বেঙ্গালুরুর ‘সিলিকন ভ্যালি’তে এ অবস্থা চলছে অন্তত এক যুগ ধরে। এবারের শুষ্ক মৌসুমে পরিস্থিতি আরও সংকটজনক হয়ে উঠেছে। পানির জন্য অপেক্ষা করতে করতে মানুষের চাকরি ও কাজ পর্যন্ত হারাতে হচ্ছে। খবর সিএনএনের
বেঙ্গালুরুর এমন অবস্থার জন্য মাত্রাতিরিক্ত নগরায়ণ ও ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি মানুষের চাপকে দায়ী করছে কর্তৃপক্ষ। এখানকার ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের প্রতিদিন অন্তত ২০০ কোটি লিটার পানি প্রয়োজন।
কিন্তু গত বছর বর্ষায় তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে গেছে। ফলে দৈনিক ২০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাসিন্দাদের অল্প পরিমাণে পানি ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এই সংকটকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দারা। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, গ্রীষ্ম পর্যন্ত তাপমাত্রার পারদ বেড়ে এই সংকট আরো করুণ হতে চলেছে।
‘গার্ডেন সিটি থেকে শুকনো হ্রদ’
বেঙ্গালুরুতে মানবসৃষ্ট বিস্তৃত হ্রদের কারণে কয়েক দশক ধরে এর সুনাম ছিল। শহরের বাসিন্দাদের পানির যোগান দিত সেই হ্রদ। সেইসঙ্গে সবুজের প্রাচুর্য, বন আর মনোরম জলবায়ু পরিস্থিতির কারণে ভারতের ‘গার্ডেন সিটি’ অ্যাখ্যা পায় বেঙ্গালুরু।
কিন্তু ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে সেখানে দ্রুত ব্যাপক নগরায়ন হয়েছে। ভারতের প্রধান প্রযুক্তি কেন্দ্র বা ‘টেক হাব’ হিসেবে গড়ে ওঠে বেঙ্গালুরু। বন কেটে হ্রদের চারপাশে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। নগরায়নের ফলে ৪০ লাখ ঘরবাড়ি গড়ে ওঠে যা, ওই সময়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
এখন শহরের মোট পানির সরবরাহের ৭০ শতাংশ আসে কাবেরী নদী থেকে। প্রধান এই জলের উৎসপথটি কর্ণাটকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
কিন্তু নগরায়ণে শহর সম্প্রসারিত হয়েছে। নতুন বাসিন্দাদের জন্য পানির লাইন সম্প্রসারিত করার পর্যাপ্ত সময় নেই কর্তৃপক্ষের। ফলে সেই এলাকাগুলো কূপ থেকে তোলা ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভর করে।
গত বছর বর্ষাও ছিল অল্প সময়, ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়। শহরটির জন্য ব্যাপক পানির সংকট তৈরি হয়। কিন্তু শহরের কিনারে বসবাস করা ৪০ লাখ ঘরবাড়ির যারা কূপের ওপর নির্ভর করে, তাদের জন্য পরিস্থতি আরো ঘোলাটে।
বেঙ্গালুরুর উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার জানান, শহরের কমবেশি ১৬ হাজার কূপের মধ্যে ৭ হাজার কূপ শুকিয়ে গেছে। এসব ভূক্তভোগীদের দিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বেঙ্গালুরুভিত্তিক পানি গবেষক ও প্রকৌশলী বিশ্বনাথান বলেন, কাবেরী নদীর ওপর নির্ভর করা শহরের ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের জন্য পানির স্বল্পতা আছে, কিন্তু সেটা সংকটের পর্যায়ের না। বাকি ৩৫ লাখ মানুষের সবাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে। ফলে সেই পানি শুকিয়ে যাওয়ায় তাদের সংকট হয়েছে।
পানি কম ব্যবহারের নির্দেশনা
বেঙ্গালুরুর দক্ষিণে বন্দেপাল্য শহরতলিতে নিম্ন-আয়ের মানুষের বাস। সকাল ৯টা থেকে বালতি হাতে তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় পানির ট্যাঙ্কারের জন্য।
নদী ও ভূগর্ভস্থ পানি কমে গেলে ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে পানি বিতরণ করে সরকার। এর জন্য বাসিন্দাদের পয়সা গুণতে হয়। আর চাহিদা বেড়ে গেলে পানির দামও বেড়ে যায়।
লাইনে দাঁড়িয়ে পানি নিতে এসে বিশৃঙ্খলা আর বাদানুবাদ তৈরি হয়। নারীদের প্রত্যেকে অন্তত দুটি বালতি পূর্ণ করে বাড়িতে পানি নিয়ে যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ আবার ট্যাংকারে বাড়ি দিয়ে পানি কতটুকু আছে, তা পরীক্ষা করে দেখেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ট্যাংকার খালি হয়ে যায়।
সংকটে ধাক্কা সবারই
বেঙ্গালুরুতে দরিদ্ররা পানির সংকটে ধাক্কা সামলালেও বাদ যাচ্ছে না উচ্চ মধ্যবিত্তরাও।
বিভিন্ন হাউজিং সোসাইটি তাদের ভাড়াটিয়া বা বাসিন্দাদের পানির ব্যাপারে প্রতিদিন আপডেট তথ্য পাঠাচ্ছে। পানির ঘাটতির বিষয়টি তাদের অবহিত করে এবং পানি ব্যবহারে সতর্ক হওয়ারও তাগাদা দিচ্ছে।
সিএনএন লিখেছে, বেঙ্গালুরুর একটি আবাসিক ভবনের বাসিন্দাদের নোটিশ দিয়ে পানির ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বলেছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, “পানির অবস্থা গুরুতর। কাবেরী পানি সরবরাহ লাইন থেকে আমরা খুব কম পানি পাচ্ছি। আমরা পুরোপুরি কূপ নির্ভর। ১১টি কূপের মধ্যে মাত্র পাঁচটি কুপ চালু আছে। সেগুলোও কখন শুকিয়ে যাবে, তা জানার উপায় নেই। আর সেটি ঘটলে নোটিশে কোনো সময়সীমাও থাকবে না।”
রয়টার্স লিখেছে, পানির ঘাটতির কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। রেস্তোরাঁয় পানির বিল দ্বিগুণ হয়েছে। কিছু কোম্পানি কর্মচারীদের মিটিং বাদ দিয়ে ট্যাংকার থেকে পানি আনার জন্য পাঠাচ্ছে।
এসময় এই বেঙ্গালুরু ছিল সবুজে ঘেরা জনপদ। ভারতের উদ্যানের শহর– হিসেবেও উপাধি পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে বেঙ্গালুরুতে দ্রুত নগরায়ণ হয়। বন কেটে, হ্রদের চারপাশে তৈরি হয়েছে কংক্রিটের নগরী।
জলবায়ু বিজ্ঞানী টিভি রামচন্দ্র বলেন, আজ বেঙ্গালুরুর ৮৩ ভাগ এলাকা কংক্রিটে আচ্ছাদিত। পানি ভূগর্ভে যেতে পারছে না। কোনো গাছপালাও নেই।