একাত্তর, ‘বিহারি’ জনগোষ্ঠী। আমরা

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪, ০৯:৩৭ এএম

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি

কথাগুলো হয়তো কারও পছন্দ হবে না, তবে আমরা বর্ণবাদে অনেকটাই আক্রান্ত বা মনে মনে তার প্রতি দুর্বল। বর্ণবাদ খুব সোজা একটা বিষয়।। অমুক, তার মানে খারাপ, বোকা ইত্যাদি। অতএব ওর পক্ষে সব খারাপ কাজ করা সম্ভব। তাই ও হচ্ছে ইতিহাসের নন্দ ঘোষ, যত দোষ তার। আমাদের নিয়ে পাকিস্তানিদের যেমনটা ছিল বা আছে। আমরাও তেমনি বিহারি মানুষকে দেখি, ভাবি সব বিহারি খারাপ, খুনি ইত্যাদি। 

দুই
২০২৪ সালে এসেও ১৯৭১ নিয়ে এই সব কথা শুনতে হয়। আমার একটা উপন্যাস প্রকাশ হয়েছে এ বছর। নাম ‘রক্তের মেহেন্দি দাগ’। ১৯৭১ নিয়ে। একাত্তরে আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ, যাদের আমরা ‘ভিক্টিম’ বলি তাদের নিয়ে। একটি চরিত্রও কাল্পনিক নয়। মূল চরিত্র এক নারী, যে এক পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে তার স্বামীর জান বাঁচাতে রাত্রিযাপন করতে বাধ্য হয়, মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। সেই অফিসার বলেছিল, বিছানায় না গেলে তার স্বামীকে সে মেরে ফেলবে, যাকে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু নভেম্বর মাসে ওই নারী আরেক অফিসারের কাছে জানতে পারে তার স্বামীকে সেই ধর্ষণকারী মে মাসেই মেরে ফেলেছে। মেয়েটি যখন বিষয়টি জানতে পারে তখন সেই ধর্ষক হঠাৎ মারা গেছে। আর মেয়েটি এক পাকিস্তান আর্মির শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে পরিবারের কাছে পরিচিত, ঘৃণিত। তার যাওয়ার কোনো পথ ছিল না, দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া। সে তাই করে এবং সেই অসহায় জীবনের বিবরণ এই লেখায়। ইতিহাস এভাবে অনেক সময় সকল পথ বন্ধ করে দেয়। মেয়েটার কী দোষ ছিল? শক্তির সামনে মেয়েটা ছিল সম্পূর্ণ অসহায়।

তিন
এই উপন্যাসে আর একটি সমান্তরাল বয়ান আছে। সেটা মোহাম্মদপুরের বিহারি জনগোষ্ঠী নিয়ে। এরাও অসহায় ছিল রাজনীতির হাতে। ৪৭-এর আগের পাকিস্তানের রাজনীতির কাছে। কারণ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ কোনোদিন একক কেন্দ্র শাসিত পাকিস্তান চায়নি। এটা লাহোর প্রস্তাবে (১৯৪০) ছিল না। এটা করা হয় ১৯৪৬ সালে দিল্লি প্রস্তাবে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতারা ‘যৌথ বাংলা’ প্রস্তাব করে যেটা জিন্নাহও সমর্থন করে। কিন্তু কংগ্রেস করেনি, নেহরু করেনি তাই কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করে। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের তরুণরা তখন ‘স্বাধীন দেশ’ করার জন্য গোপনে কাজ করতে থাকে। আর পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৭ সাল থেকেই, ভাষা আন্দোলন তার একটা অংশ। অর্থাৎ কোনোদিন এই অঞ্চল পাকিস্তান ছিল না, যেটা আমরা সাধারণভাবে বুঝি, জানি।

চার
সেই জিন্নাহর ‘পাকিস্তানে’ আসে বিহারিরা। কিন্তু সেটা তো কোনোদিন পাকিস্তান ছিল না। তারা ইন্ডিয়ার পূর্ব অঞ্চলের মানুষ, নিকটস্থ পাকিস্তানে আসে যেটা জন্ম থেকেই বাংলাদেশে যাওয়ার গাড়ি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব পাকিস্তান নামক স্টেশনে। তাই বিহারিরা যে দেশের সমর্থক ছিল সে দেশই ছিল না। তারা উদ্বাস্তু, পাকিস্তানও কোনোদিন তাদের খবর রাখেনি। না ১৯৪৭-এর পরে, না ১৯৭১-এর পরে। 

সে রাতের আক্রমণের পর চারদিক প্রতিরোধ শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হিসেবে তাদের ওপরই প্রতিশোধ নেয় মানুষ। ২৫ মার্চের পর, ১৬ ডিসেম্বরের পরও। তারা নিজেরাও যেখানে পেরেছে পাকিস্তানের জন্য করেছে। কিন্তু তারা কয়জন? 

পাঁচ
বিহারিরা মানুষ হিসেবে কেমন? আমরা যেমন, পৃথিবীর অন্য সবাই যেমন, তেমন। ভালো-মন্দ সবার মাঝেই আছে।

বাংলাদেশি বিহারি মানুষের একটি খণ্ডিত ছোট্ট চিত্র উঠে এসেছে সদ্য প্রয়াত সাদি মহম্মদের মায়ের দেওয়া সাক্ষাৎকারের একটি অংশে। এটি ২০০১ সালে নেওয়া হয়েছিল। 

জেবুন্নেসা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
আমার পরিবারকে ২৬ মার্চ বিহারিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে ইকবাল নামের এক বিহারি তরুণ। নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন জনৈক পাঞ্জাবি মুজাহিদ সাহেব। যিনি আমাদের পুরো পরিবারকে গাড়িতে করে মধুবাজার নামিয়ে দিয়েছিলেন মার্চের পর। ঠিক স্বাধীনতার দিন ১৬ ডিসেম্বরে ওনাকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে রাখে। আমি ইকবালের কাছে কোরআন নিয়ে কসম করেছিলাম যে, যদি আমার একটা ছেলেমেয়েও বেঁচে না থাকে, তবু আমি একটা লোককে মারতে দেব না। এ কথার বিনিময়ে আমি আমার বড় ছেলেকে পাঠিয়ে দেই মুজাহিদ সাহেবকে কুমিল্লা থেকে আনতে। যেখানে ওনাকে আটকে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে এনে আমার নিজের বাড়িতে ওনাকে রাখলাম। এই ঘরটার মধ্যে রেখেছি ওনাকে। দরজা-জানালা কিছু নেই। তবু রেখেছি পাহারার জন্য। যেন উনাদের উপর আর কোনো বাঙালি অত্যাচার করতে না পারে। তারপর সেই ইকবালকে আমি স্বাধীনতার পর মোহাম্মদপুরে এসে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু ইকবালের যারা পরিচিত ছিল, তারা বলল যে ইকবালকে মেরে ফেলেছে বাঙালিরা।

লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh