সুজিত সজীব
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৪, ০৮:১৪ পিএম
নয়ন মুন্শি। ছবি: সংগৃহীত
‘নয়ন সবার নয়নমণি
কানাডায় গিয়েছিলো গাইতে সে গান
সেই যে গেল ফিরে এলো না ফিরে এলো না
নয়ন সবার ...’
গুরু আজম খানের এই গানটির সাথে হয়তো সবাই পরিচিত। কিন্তু নয়নকে চেনেন না কেউ। বলতে গেলে অখ্যাত একজন মানুষ। তবে তার দ্বারা অনুপ্রাণিতরা বেশিরভাগই দেশের বিখ্যাত মানুষ। এই বিখ্যাতদের দলে আছেন দেশের কিংবদন্তিতুল্য গিটারিস্ট-ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু ও মাইলস ব্যান্ডের হামিন আহমেদসহ আরও অনেকে। বলছিলাম, নয়ন হক মুন্শির কথা।
নয়ন মুন্শি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী ব্যান্ড দল জাগরণের গিটারিস্ট। পপগুরু খ্যাত আজম খান বলতেন, আগামী ২০০ বছরেও বাংলাদেশে এমন গিটারিস্টের জন্ম হবে না। মাইলসের হামিন আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাদের প্রজন্মের অধিকাংশ গিটারিস্টের অনুপ্রেরণার নাম; নয়ন মুন্শি।
প্রথম বাংলাদেশি গিটারিস্ট হিসেবে নয়ন মুন্শি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও খ্যাতি পেয়েছিলেন। একবার বিখ্যাত গিটারবাদক কার্লোস সান্তানার কনসার্ট-ট্যুর প্রমোশনের জন্য গিটার প্রতিযোগিতা হয়েছিল, কথা ছিল সেখানের বিজয়ী সুযোগ পাবেন সান্তানার সঙ্গে এক মঞ্চে বাজানোর। নয়ন মুন্শি সেখানে বিজয়ী হয়েছিলেন। আবার তখনই আমেরিকান এক রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা চলছিল তার। যদিও এর কোনোটাই হয়নি আর। তার আগেই ঘটেছিল ভয়াবহ সেই সড়ক দুর্ঘটনা, যাতে ধূমকেতুর মতোন উত্থান ঘটা এই প্রতিভার আকস্মিক প্রস্থান হয়। মাত্র ২০ বছর বয়সে নিভে যায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। নয়ন মুন্শির গাওয়া কোনো গান, গিটারওয়ার্কের রেকর্ডেড কিছুই নেই। বর্তমান প্রজন্ম তার নাম, কাজ সম্পর্কে কিছুই জানে না। তবে জানা যায় লাকী আখন্দের সুরে, হ্যাপী আখন্দের গাওয়া ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানে গিটার বাজিয়েছিলেন নয়ন মুন্শি। বিখ্যাত এই গানের গিটারের মূর্ছনায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্নান করে চলেছে।
নয়ন মুন্শি জন্মেছিলেন ঢাকার শান্তিনগরে, এক সংগীতপরিবারে। ১১ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট নয়ন। সংগীতানুরাগী বড় ভাই কামাল হক ছিলেন মূলত পূর্ব পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন বক্সার। তার হাত ধরেই হক পরিবারের সন্তানেরা গানবাজনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। আরেক বড় ভাই আলমগীর হক আশির দশকের জনপ্রিয় পপগায়কদের একজন। তাকে অনেকে ‘প্রাচ্যের এলভিস প্রিসলি’ বলেও ডাকতেন।
আরেক ভাই জামাল হক মুন্শি তবলাবাদক, ওস্তাদ জাকির হোসেনের ছাত্র। আরেক ভাই জাহাঙ্গীর হক ড্রামার। আরেক ভাই দস্তগীর হক ছিলেন ভোকাল। আর বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার জর্জিনা হক তার বোন। নিজের ভাইবোনদের দেখেই গিটারিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।
নয়ন গিটার শিখেছিলেন নিজের চেষ্টায়। স্কুলে থাকতেই তার স্বপ্ন, বড় গিটারিস্ট হওয়ার। তার সাধনা ছিল ভিন্ন রকমের, হাতের গিটারটি ছিল তার প্রিয় বন্ধু। সব সময় সব জায়গায় তার সঙ্গী ছিল গিটার। ঘুম থেকে উঠে আর ঘুমাতে যাওয়ার আগে, প্রতিমুহূর্তে নয়ন টুংটাং করে সুর তুলত গিটারে।
এক সাক্ষাৎকারে তার বন্ধু মাইলসের শাফিন আহমেদ জানান, ঢাকার সায়েন্সল্যাবে চলতি রিকশায় তাকে গিটার বাজাতে দেখা যেত হরহামেশাই। তারা যখন স্কুলে আড্ডা দিতেন, সে সময় দেখা যেত গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে একমনে গিটার বাজাচ্ছেন নয়ন। বন্ধুরা যখন বিকেলে মাঠে খেলছেন, তখন নয়ন হয়তো সিনিয়র মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে অনুশীলন করছে।
বিভিন্ন হোটেলেও গিটার বাজাতেন নয়ন। তখন ‘অস্থির’ নামে ব্যান্ডও বানিয়েছিলেন। এভাবে গানের সূত্র ধরেই কিশোর বয়সে সান্নিধ্য পান আজম খানের। ১৯৭৫ সালে আজম খানের ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের কিবোর্ডবিহীন লাইনআপের লিড গিটারিস্ট ছিলেন তিনি। আজম খান হৃদয় দিয়ে যেটা গাইতেন, সেটাকে গিটারে অনুবাদ করতেন নয়ন মুন্শি।
ঢাকায় দীপ্তি ছড়িয়ে ১৮ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন বড় বোনের কাছে কানাডায়। সেখানে আরও মনোযোগের সঙ্গে গানবাজনা শুরু করেন। সেখানে ‘ফ্ল্যাশ ল্যান্ডিং’ নামে ব্যান্ডও তৈরি করেছিলেন। সেই ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট, ভোকাল এবং ম্যানেজার ছিলেন তিনি। পাশাপাশি নয়ন মুন্শি এডমন্টনের একটি পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়মিত গিটার বাজাতেন, তার দুর্দান্ত গিটার বাজানোতে মুগ্ধ হয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ এটির নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য নয়ন মুন্শি শো’। সে সময়ে এডমন্টনে তার জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো।
সড়ক দুর্ঘটনা তাকে কেড়ে নিল। হয়তো বিরাট প্রতিভাবানরা ক্ষণজন্মা হয়েই এই ধরায় আসেন।