গুরুপক্ষে

সৌগত রায় বর্মন

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৪, ০৯:৩৫ পিএম | আপডেট: ২৮ মে ২০২৪, ১১:২২ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

বৃহস্পতিবার। রাত ১০.০২ মিনিট

-ওভাবে গুলি বের হবে না, বাবা। ওই যন্ত্রটা খারাপ। গুলিও বোধহয় নেই।

-আপনি ঠিক জানেন?

-হান্ড্রেড পারসেন্ট।

-তাহলে তো কেস জন্ডিস। আপনাকে যে মারা যাবে না।

-আহা, অত তাড়া কীসের? আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। একটু রেস্ট নাও। জল খাও। চা খেলে বানিয়ে দিচ্ছি। পিস্তলটাও তো ঠিকঠাক ধরতে পারোনি! কে যে তোমাদের এসব সিরিয়াস কাজে পাঠায়, কে জানে! এটাই তোমার প্রথম সুপারি না?

-না... মানে... হ্যাঁ। কথাটা কিন্তু কাউকে বলবেন না কাকা। খুব লজ্জায় পড়ে যাব। প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে।

-না না। আমি তো একটু পরেই মরব, কাউকে বলে যাবার টাইম পাব না।

-আপনি কি শিওর যে এই পিস্তল থেকে গুলি বের হবে না?

-আজ্ঞে হ্যাঁ।

-আপনি এতটা শিওর হচ্ছেন কী করে? 

-আমাকে পিস্তল চেনাবে বাবা! হাতে পুলিপিঠে নিয়ে তো আর জনপ্রতিনিধি হওয়া যায় না। পুলিশ আর পিস্তলটাও লাগে। 

-তাহলে তো খুব মুশকিলে পড়ে গেলাম, কাকা... ঠিক আছে, চাকু দিয়েই নলিটা কাটতে হবে। স্যরি কাকা! এ ছাড়া আমার হাতে আর কোনো উপায় নেই। তবে আপনি যদি একটু কো-অপারেট করেন তো আমার কাজটা সহজ হয়ে যাবে। শুধু আপনি কোনো টেনশন নেবেন না। টেনশন তো আমার। আপনি শুধু চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেবেন। আমি কুচ করে গলার নলিটা কেটে দেব।

-মরব তো? 

-সেটা তো আমি বলতে পারব না, কাকা! তবে প্লিজ, মরেছেন কি না তা আমাকে জানিয়ে দেবেন। আরে, তাড়াহুড়োর কিছু নেই! কিন্তু জানাবেন কাকা। নইলে বাকি পেমেন্ট পেতে খুব হুজ্জত করতে হবে।

-তুমি ফুল পেমেন্ট না পেলে কি শান্তিতে মরতে পারব? 

-সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন। শান্তিতে মরতে না পারলে সারাজীবন আপনার মনের মধ্যে একটা কষ্ট থেকে যাবে।

-ঠিক। তাহলে সেই কথাই রইল, শান্তিতে মরেছি কি না, তা তোমাকে মরার পর জানিয়ে দিতে হবে, তা-ই তো? এবার দাও দেখি। যন্ত্রটা আমার হাতে দাও। আমি চেক করে দিচ্ছি।

-মামাবাড়ির আবদার পেয়েছেন কাকা? নো চুদুর-বুদুর! আপনার হাতে দেব পিস্তল? তারপর... 

-আরে না না। ওটা অচল। আমি দেখেই বুঝেছি, ও মাল চলবে না। এবার বলো তো বাবা, কে তোমায় পাঠিয়েছে? কত টাকা দিয়েছে? অ্যাডভান্স না ফুল পেমেন্ট?

-অত কথা জেনে আপনার কী লাভ? একটু পরে তো আমার হাতেই মরবেন।

-এ কথা তুমি জোর দিয়ে বলতে পারো না। তুমি এখনো নবিশ। 

-আপনি কিন্তু কথা দিয়েছেন, আমাকে সাহায্য করবেন, যাতে আমি কুচুত করে আপনার নলিটা কেটে ফেলতে পারি। আমি পেমেন্ট না পেলে আপনার মনে ব্যথা লাগবে না?

-না না, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তোমাকে ফুল কো-অপারেট করব। যাক, চা খাবে?

-চা? হ্যাঁ, মন্দ হয় না। তবে বানাবে কে? আমি তো আপনাকে ছেড়ে যেতে পারব না।

-হাসালে বাবা। হাতে তোমার পিস্তল। ওটা অকেজো হতে পারে, কিন্তু চাকু? ওটা তো বিট্রে করবে না। কুচুত করে আমার নলি তুমি কেটে নেবে। আমি বুড়ো মানুষ, তোমার সঙ্গে কি পেরে উঠব?

-তাই তো বলছি, এই বয়সে রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাবেন কেন? আমিই বরং নিচে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে আসি। তবে হ্যাঁ, কথা দিতে হবে, পালাবেন না। আপনি নিশ্চয় চিনি খান না? আমি একটু খাই। বেশি না। বেশি চিনি খেলে যদি ফিগার নষ্ট হয়ে যায়?

-আরে না না। নিচে যাওয়ার দরকার নেই। ফালতু রিস্ক হয়ে যাবে। টেবিলের ওপরে ওই যে ফ্লাস্কটা দেখছ। চা ভরতি আছে। তবে চিনি দেওয়া নেই। রান্নাঘরে চিনির ডিব্বা আছে। যত খুশি নিতে পারো।

-তাহলে তা-ই হোক। আপনি কিন্তু চেয়ার ছেড়ে নড়বেন না কাকা। ভদ্রলোকের এককথা।

-এক হাতে পিস্তল নিয়ে তুমি ফ্লাস্ক খুলবে কী করে? চা-ই বা ঢালবে কীভাবে? ওটা রেখে যাও। আমি ছুঁয়েও দেখব না। ওই সব পচা মাল দেখার শখ আমার নেই।

-মালটা পচা বলবেন না কাকা। টেকনিক্যাল ফল্ট হতেই পারে। বিজ্ঞানে সব হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে!

-তার মানে, তুমি আমায় মারতেও পারো, আবার না-ও পারো। তা-ই তো?

-হ্যাঁ, তবে পিস্তল দিয়ে হয়তো মারতে পারব না। কিন্তু চাক্কু দিয়ে... এই শালা, তাড়াহুড়ায় চাকুটাও আনতে ভুলে গেছি যে। এখন কী করি?

-চিন্তা কোরো না বাবা। রান্নাঘরে ভালো চপার আছে। সেটা দিয়েও মারতে পারো। তবে তোমার যা চেহারা, তাতে এক কোপে আমার নলি কাটতে পারবে কি না সন্দেহ আছে!

-অসুবিধা নেই। কিচেনটা মার্বেলের তো? নাকি সস্তার স্পার্টেক্স? ধার দেওয়া যাবে?

-হ্যাঁ হ্যাঁ। যত খুশি। রাজস্থান থেকে আনা মার্বেল। একটু ধৈর্য ধরে ধার দিলে এক কোপে মোষের গলাও কাটা যাবে।

-কাকা, একটা কথা বলব, যদি কিছু মনে না করেন!

-তুমি বাবা একটু পরেই আমায় মারবে, তাতেও কিছু মনে করছি না! আর কী এমন বলবে, যাতে মুখ গোমড়া করে বসে থাকব? বলো বাবা। কী বলতে চাও, বলো।

-আজ্ঞে, মোষের গলা কাটা যাবে তা মানছি; কিন্তু আপনার গর্দানটা ঠিক মোষের মতো নয়... 

-গন্ডারের মতো, তা-ই তো? ভয় পেলে চলবে? তুমি এক রাতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে। কাগজে তোমার ছবি দিয়ে লেখা হবে : “চপারের চাপে গন্ডার দু-ফাঁক করলেন...” তোমার নামটা যেন কী?

-বলা নিষেধ আছে। 

-কে নিষেধ করেছে? আরে ধুর! আজকাল আর এসব নিয়ে কারও কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আইন-টাইন কাজে লাগে না। উলটো তুমি মন্ত্রী হয়ে যাবে। কত বড় সম্মান বলো তো? কত টাকা!

-যেমন আপনি হয়েছেন, তা-ই তো? কাকা, মন্ত্রী হতে গেলে ক-টা লাশ ফেলতে হয়, বলুন তো?

-ধুস! এখন আর কেউ লাশ ফেলে না। চোষে। চুষে চুষে যখন ছিবড়ে হয়ে যায়, তখন ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয়।

-আপনি কত মানুষ চুষেছেন?

-তা কয়েক লাখ তো হবেই। গল্প পরে শুনিস, আগে চা খেয়ে গলাটা নরম করে নিই। তোর নলি কাটতে সুবিধাই হবে। এই আমি আরাম করে পা তুলে বসলাম। তুই চা ঢেলে নিয়ে আয়।

দুই

রাত ৯.৫৭ মিনিট

-দাদা, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি। লাইন বিজি। এতক্ষণে পেলাম।

-পেয়েই যখন গেছ, তখন বলে ফ্যালো, তোমার কী চাই?

-একটু টাইম চাই। আসলে ওই ঘরে লোক বসে আছে।

-কেন, টাইম লাগবে কেন? পঞ্চাশটা বস্তা পাচার করতে কতক্ষণ লাগে? 

-বস্তা? মানে? আপনি তো দাদা, আমাকে লাশ ফেলতে বলেছেন!

-কার লাশ?

-কার লাশ? কী বলছেন দাদা! আমাদের স্ট্যান্ডিং মন্ত্রী সাহেবের। ব্যাটা মরলেই তো আপনি... 

-শাট আপ! বড্ড সাহস হয়েছে না তোর? উনি আমাদের শিক্ষাগুরু। তাঁকে তুই ব্যাটা বলছিস? দাঁড়া, তোর একদিন কি আমার। দেখাচ্ছি মজা!

-যাচ্চলে! আপনিই তো আমাকে পাঠালেন গুরুর ব্যাটাকে মারতে!

-যদি বলেই থাকি, তবে টাইম নিচ্ছিস কেন? তবে হ্যাঁ, গুরুচণ্ডালী যেন না হয়! মানে আলতো করে গলার নলিটা কেটে ফেলবি। বেশি কষ্ট দিবি না। এক ব্যাগ টাকা তো দিয়েছি। ওটা না নিয়ে যাস না। তোর যা ভুলো মন! ওই টাকার ব্যাগটা কিন্তু তোর কাজে লাগবে।

-না না, ভুলব কেন, স্যার? স্যার, টাকাগুলো কি আসল না জাল?

-জাল নোট নিয়ে আমরা রাজনীতি করি না। আমরা চোর হতে পারি, জোচ্চোর হতে পারি, খুনি হতে পারি, কিন্তু ক্রিমিন্যাল নই। আমরা রাজনীতিবিদ! উন্নয়ন করি। এত যে মানুষের উপকার করি, সার্ভিস ট্যাক্স নেব না? 

-নিশ্চয়ই নেবেন স্যার। কিন্তু আমি যে মুশকিলে পড়েছি, তার কী হবে?

-তোর বাল সব কিছুতেই মুশকিল! কী হয়েছেটা কী?

-উলটোদিকের ফ্ল্যাট থেকে দেখতে পাচ্ছি, ঘরে একটা লোক অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে। মালটা কে, স্যার?

-সিকিউরিটির কেউ হবে বলে মনে হচ্ছে। তুই ভয় পাবি না। সব আমার লোক। বুঝলি?

তিন

রাত ৯.৫৮ মিনিট

-কী করতে হবে, বুঝে নিয়েছ তো?

-ইয়েস স্যার। লোকটার কাছে কি খোকা থাকবে?

-থাকতেই পারে। তাতে তোমার কী? তোমার কাছেও তো আছে। প্রফেশনালদের তো ভয় থাকার কথা নয়?

-স্যরি স্যার। ওক্কে স্যার।

-টাইম যেন নড়চড় না হয়। এ ক্ষেত্রে টাইমিং কিন্তু খুব ইম্পরট্যান্ট। 

-জানি।

চার

রাত ১০.০৭ মিনিট

-এই নিন চা।

-তুই আমার অতিথি। আগে তুই নে। 

-নিয়েছি। চমৎকার চা, কাকা! দামি পাতা। এত ভালো চা আমি জীবনে খাইনি।

-খাবে খাবে। আগে এসব কাজে পোক্ত হও, তারপর সব খাবে।

-আশীর্বাদ করুন যেন জীবনে বড় হতে পারি।

-নিশ্চয়ই হবে। আজ যে কাজে এসেছ, সেটা সফল হলেই দেশে তোমার নাম ছড়িয়ে পড়বে। অনেক কাজ পাবে। বড় হবে। আরও উন্নতি করবে।

-আপনার মতো ভালো লোককে মারতে কিন্তু খুব কষ্ট হবে, কাকা!

-কষ্ট পাস না বাবা। এটাই তোর কর্ম। কোনো কাজই ছোট নয়।

-আপনার মতো লোক খুব কম আছে। আমি অন্তত দেখিনি।

-কত লোককেই তো তুই চিনিস না। তাতে কী আছে? সব লোকই একরকম হবে, তার কোনো মানে নেই। উফ! এই হয়েছে জ্বালা! দাঁড়া, আগে ফোনটা ধরি। নইলে বারবার ফোন করে বিরক্ত করবে। শুভকাজে এত বাধা পেলে কি চলে? 

-সাবধান কাকা। ফোনে উলটো-পালটা কিছু বলবেন না। কেউ যেন কিচ্ছু বুঝতে না পারে!

-আমাকে এত বোকা ভাবিস না রে। কথা যখন দিয়েছি, তখন বেইমানি করব না। তুই তৈরি হয়ে নে। এই যাঃ, ফোনটা ধরতেই পারলাম না। যাক গে, ভালোই হয়েছে। বারবার বাধা পাওয়া ঠিক না। 

-আপনি ফোনটা সুইচ অফ করে দিন। কাজ হয়ে গেলে তারপর খুলবেন।

-বলিস কী রে তুই? কাজ হয়ে গেলে মানে? আমি তো তখন স্কন্ধকাটা হয়ে থাকব। ফোন ধরব কী করে?

স্যরি কাকা! আবার বলছি, টেনশন করবেন না। স্কন্ধকাটা আপনাকে করা যাবে না। ওই গর্দান করাত ছাড়া কাটা যাবে না... আসলে... আসলে আপনাকে মারতে না আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কী করি, বলুন তো?

পাঁচ

রাত ১০.০৫ মিনিট

-ফোন বন্ধ, স্যার!

-এই বাইনচোদ! তোকে ফোন করতে কে বলেছিল?

-না... মানে... আমি ভাবলাম, ফোন করে বাইরে আসতে বলি। বেরিয়ে এলেই পিছন থেকে নলিতে ক্ষুর চালিয়ে দেব। ঘর নোংরা হবে না। কার্পেটটা খুব দামি। দাদা, ওই ঘরে ঢোকা বহুত ঝামেলার কাজ। আর ওই লোকটা এখনো বসে আছে যে!

-দুজনকেই উড়িয়ে দে। আগে টার্গেট, পরে শাগরেদ।

-আমি একার হাতে দুজনের নলি একসঙ্গে কাটব কী করে দাদা? যদি ওই লোকটা পেঁদিয়ে দেয়? 

-তাহলে আর কী করবে? প্যাঁদানি খেয়ে প্যান্টে মুতে ওখানেই শুয়ে পড়বে!

আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছেন না।

-তোকে পাঠিয়েই আমি ভুল করেছি। শোন, আগে ঘরে ঢুকেই ব্যাগ থেকে টাকা ছড়িয়ে দিবি। ওই লোকটা হকচকিয়ে গেলেই টার্গেটের নলিতে রদ্দা মারবি। ওতেই কাজ হবে। নলির হাড় ভেঙে যাবে। তুই রিস্ক নিবি না। নলিতে ডিপ করে ক্ষুর চালিয়ে বেরিয়ে আসবি।

-জামায় রক্ত লেগে গেলে?

-ওয়াশিং মেশিনে জামা ধুয়ে, শুকিয়ে, সকালবেলা জেলে বসে জিলিপি খাবে! বোকাচোদা।

-ঠিক আছে, দাদা! বুঝে গেছি।

ছয়

রাত ১০.০৭ মিনিট

-স্যার, একটা ফোন সুইচ্‌ড অফ।

-জয় গুরু। প্রসিড।

সাত

রাত ১০.০৭ মিনিট

-তোর শরীরে খুব মায়া না? এসব কাজে মায়া রাখতে নেই। নির্মম হতে হবে। কঠোর হতে হবে। জেনো, কর্মই তোমার জীবন। আমরা তো জন্মাবার পর থেকে মরেই আছি। মৃত্যুই অনিবার্য। তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। জন্মিলে মরিতে হবে। নাও, আমাকে কী করতে হবে, এবার বলো তো দেখি?

-আমার খুব কান্না পাচ্ছে, কাকা! কী যে করি? একটু বাইরে থেকে কেঁদে আসি?

-বুঝেছি। তোর মুড আসছে না। তা-ই তো? ঠিক আছে, তোর মুড ভালো করে দিচ্ছি। এই লাইনে আছিস, কাজের খুব চাপ, জানি। অত চাপ নিবি না। মাঝে মাঝে আরাম করবি। এই লাইনে আসছিস, মদ-মাল খাস তো?

-যাহ্, আপনি গুরুজন! বড়দের মিথ্যে বলা ঠিক নয়। হ্যাঁ কাকা, ওই একটু-আধটু খাই বটে! মাঝেমধ্যে।

-মাঝেমধ্যে কী রে? রোজ রাত্রে খাবি। নইলে ইজ্জত চলে যাবে তোর! যা, আমার শোবার ঘরে যা। দেখবি, সেলার, মানে আলমারিতে দামি মদ আছে। সিঙ্গল মল্ট। এক পেগ খেলেই দেখবি, মন কেমন চাঙ্গা হয়ে উঠছে। 

-কী বললেন? সিগন্যাল ফল্ট! ধ্যাত, এই নামের কোনো মদের নাম বাপের জন্মে শুনিনি। কী খাওয়াতে কী খাওয়াবেন! তারপর বেহুঁশ হয়ে গেলে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন।

-বোকা ছেলে! আমাকে শেষ পর্যন্ত তুই এই বুঝলি রে! তোর তো কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের মতো অবস্থা হয়েছে! যুদ্ধ করতে গিয়ে হেগে-মুতে একাকার! 

মনেপ্রাণে সাহস আনতে হবে। তোকে যে কাজ দিয়ে এখানে পাঠিয়েছে, তার সম্মান রাখতেই হবে। যা, হাতের সামনে যে মদেরই বোতল পাবি, সেটাই নিয়ে আসবি। 

-নেশা হবে তো স্যার? আসলে চুল্লু খেয়ে অভ্যেস তো তাই ভাবছি, কাজ হবে কি না!

-এখন আর চুল্লু বলে কিছু নেই রে বাবা। সব বোতলে বোতলে বাড়ি বাড়ি হোম ডেলিভারি হচ্ছে। যা বলছি, শোন। ঘরে যা। কাচের আলমারিটা খোল। হাতের কাছেই পাবি ব্ল্যাক লেভেল। কালো বোতল। ওটা নিয়ে আয়। আর দুটো গ্লাস। বরফ আছে ফ্রিজে। 

-স্যার, আমার কলের জলে খাওয়ার অভ্যেস। বরফ দিয়ে খেলে গলা ফুলে কলা গাছ হয়ে যাবে না তো? লোকে কী বলবে? ভাববে, কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না।

-তুই সত্যিই খুব সরল ছেলে। তোর বস কে রে? কে তোকে পাঠিয়েছে এই কাজে?

-জানি না তো! আমি ছিলাম খালধারের ছোটখাটো মস্তান। একটু নামডাক হচ্ছিল। সবাই আমাকে চাক্কু বলে চেনে। একদিন একটা পেল্লায় গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। একটা লোক এসে বলল, তোকে একটা কাজ করে দিতে হবে। পারবি? আমি বললাম, কেন পারব না। কাজটা কী? লোকটা চাপা গলায় উত্তর দিল, গোপন কাজ। অনেক টাকা পাবি। এখন এক লাখ রাখ। কাজের পর আরও এক লাখ। মাইরি বলছি কাকা, এত টাকা আমি জীবনে দেখিনি। বাজারের ব্যাগের এক ব্যাগ। মাথাটা বনবন করে ঘুরতে লাগল। ভয়ে বমি করে দিই আর কী!

-কী কাজ, তোকে বলল না?

-না। বলল, ঠিক সময়ে জানতে পারবে। লোকটা চলে গেল। বলল, এখান থেকে কোথাও যাবি না। যখন-তখন কাজটা চলে আসতে পারে।

-টাকাটা গুনে নিয়েছিলি তো? 

-মাথা খারাপ, স্যার। ওই টাকা রান্নাঘরে ব্যাগসুদ্ধ লুকিয়ে রেখেছি। গ্যাসের পিছনে। সত্যি কথা বলতে কী, ওই ব্যাগটা দেখলেই আমার শিরদাঁড়া বেঁকে যাচ্ছে। হজম হবে তো স্যার?

-হবে না মানে? নিশ্চয়ই হবে। তোকে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেব। কাজ শেষ হয়ে গেলে খেয়ে নিস। দিনে দুটো করে, পাঁচ দিন। আরেকটুকুন দেব রে তোকে? মজা আসছে তো?

-কী বলব, স্যার! দারুণ মজা! মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনটাও কেমন যেন দিওয়ানা হয়ে যাচ্ছে।

-তাহলে কাজটা শুরু করে দে।

-আরে দাঁড়ান-না। বাংলা খেয়ে খেয়ে না জিভটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সকালের হিসিতে কী গন্ধ! বাপ রে! দিন, আরেকটু দিন আপনার সিগন্যাল ফল্ট!

-দিতে পারি। কিন্তু আমার গলায় চাক্কু চালাতে পারবি তো?

-আলবাত পারব। আমার নাম খালপাড়ের চাক্কু। ও, আমার গল্পটাই তো এখনো শেষ হয়নি।

-লাস্ট ঢোকটা গলায় ঢেলে তারপর বল। 

-হিক... স্যরি স্যার! মাল খেলেই আমার হিক্কা ওঠে। যা-ই হোক, ডোন্ট মাইন্ড স্যার! হিক... হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম... সেই লোকটা বেশ কিছুদিন পরে ফিরে এসে বলল, হিক... সব রেডি তো? আমি বললাম, রেডি তো বটেই... হিক... কিন্তু শালা কাজটা কী, সেটাই তো জানি না... হিক... লোকটা সেই পেল্লায় গাড়িতে উঠে বসতে বলল। উঠলাম... হিক... লোকটা আমার পাশে বসে আপনার ছবি দেখাল। বলল, একে মারতে হবে... হিক... আপনার ছবি তো পেপারে দেখেছি। আমি আঁতকে উঠে বললাম... হিক... অসম্ভব। ইনি আমাদের এমএলএ, তায়... মন্ত্রী! মারব কী করে? না না, এসব খুনখারাপির মধ্যে আমি নেই... হিক... শেষে ফাঁসিতে ঝুলব নাকি... হিক... লোকটা চাপা গলায় হিসহিস করে বলল, হিক... যখন টাকা নিয়েছিলি, তখন মনে ছিল না... হিক... এত টাকা যে কাজের জন্য দেওয়া হচ্ছে... হিক... সেটা পাতি চুরি... হিক... জোচ্চুরি নয়... তা বুঝিসনি... ? এখন কাজটা না করলে যে তোকে মরতে হবে! ঠিক করে বল... বাঁচবি না মরবি... হিক? আমি ভয়ে ভয়ে বলে উঠলাম, বাঁচব। কিন্তু ওনার ঘরে ঢুকব কী করে... হিক? সিকিউরিটি... হিক... পুলিশ? কথা শেষ করতে না দিয়েই লোকটা বলল, হিক... সেসব আমরা ম্যানেজ করে নেব... হিক... তোকে ঢোকানোর দায়িত্ব আমাদের... হিক... বার হওয়া তোর... কেরামতি... হিক... একটা হুমদোমুখো ছেলেকে বলল... হিক... খোকাটা বার করে ওকে দেখা... ভালো করে চালানো শিখিয়ে দে... বাচ্চা নাদান আছ... এখনো ব্লেড... চালিয়ে মস্তানি করে... হিক... শোন বাচ্চা, এই খোকাটা কিন্তু লোডেড... হিক... এখন বিছানার তলায় লুকিয়ে রাখ, নাড়াচাড়া করিস না। গুলি যেন বেমক্কা বেরিয়ে না যায়! অপারেশনের ডেট, টাইম ঠিক সময়মতো... জানতে পারবি... হিক।

-ওরকম শেয়ালের মতো হুক্কাহুয়া করলে আমার নলি কাটবি কী করে?

-কাকা তুমি... তুমি... আমায়... অপমান করতে... হিক... পারলে? আমি... তোমায় কত হিক... শ্রদ্ধা... করি... হিক... 

-ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর কিছু বলেনি?

-না... তেমন কিছু নয়... তবে একটা কথা... একটা কথা... হিক... মানে লোকটা ছেলেটাকে বলল... গুরুকে বলে দিস কেস ফিটিং... হিক... মানে কী স্যার... দাঁড়ান দাঁড়ান... মাথাটা খুলে যাচ্ছে... আপনার নাম... কী যেন কী যেন... গুরু... পদ... সামন্ত... গুরুটা কে... মাথাটা... হিক... খুলছে... খুলছে... হিক... ঠিক... ঠিক... ঠিক... কা...ক্কা... হিক... কে বলেছে... হিক... আমি... বোকাচোদা... গবেট... আলবাত... আমার বুদ্ধি আছে... ধরে ফেলেছি... হিক... কা...ক...খা... হিক... 

 আ... আ...আ... পনি... হিক..!

-কী বলতে চাইছিস তুই? আমিই তোকে এখানে পাঠিয়েছি আমাকে মারতে?

-না... তা বলছি না। তবে... আমার না স্যার... গুরু... গুরুপদ... হিক... কাক্কা... আপনি অত দূর থেকে... কী করে বুঝলেন... এই পিস্তল থেকে গুলি... বার হবে না! আপনি... জানতেন না... হিক?... এই পিস্তলটা... আপনিই... হ্যাঁ... হিক... আপনিই... দিয়েছিলেন... আপনাকে... মারতে... হিক... কেন... কা... ক্কা?

আট

রাত ১০.০৮ মিনিট

-কত দূর?

-সিঁড়ি দিয়ে উঠছি।

-পুলিশ ছিল?

-ছিল।

-কী বলে উঠলি?

-জয় গুরু।

-পুলিশটার নাম জানিস?

-না।

-ওকে।

নয়

রাত ১০.১০ মিনিট

ঝটিতে ঝড়ের মতো দরজা খুলে গেল। উড়ে এলো একটা মুখ খোলা চটের থলি। চাক্কুর মাথায় লেগে থলে থেকে বেরিয়ে এলো রাশি রাশি টাকা। চলন্ত ফ্যানের ব্লেডে লেগে টাকা উড়তে লাগল সারা ঘরময়। 

চাক্কু ব্যালান্স হারিয়ে মাটিতে উবু হয়ে পড়তেই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা কালো পোশাক-পরা ছেলে। হাতে চমকাচ্ছে চপার। চুলের মুঠি ধরে চাক্কুর মাথাটা এক ঝটকায় উপরে তুলে চপার চালিয়ে দিল গলার নলির ওপর দিয়ে। উঠে দাঁড়াল লোকটা। সেন্টার টেবিলটা এক লাথিতে উলটে দিয়ে লোকটা চপার তুলল। গুরুপদ ঠিক দু-হাত দূরে স্থির বসে আছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে বন্ধ দরজার দিকে। লোকটার চপার মাথার উপর উঠতেই ফটাস করে একটা শব্দ ভেসে এলো। দরজা থেকে। বুলেট। লোকটার চপার ছিটকে পড়ল মাটিতে। মাথার ঠিক পিছনে লেগেছে গুলি। কিছুটা ঘিলু ছিটকে কার্পেট নোংরা করে দিল।

-ওয়েল ডান। নিখুঁত টাইমিং। পুরো অঙ্কটাই মিলে গেল। ক্রিটিকাল কেসে তাই তোমার স্মরণ নিতে হয় আমার। যাও। পুলিশকে বলা আছে। আর হ্যাঁ, টাকাগুলো কুড়িয়ে নাও। সামান্য টাকা! কত আর হবে! বড়জোর দু-লাখ।

-ওই টাকাগুলো জাল, গুরু। আমি জানি। এভাবে ফাঁসিয়ো না আমায়। এখনো আমাকে তোমার অনেক কাজে লাগবে। আর একটা কথা। আমি কিন্তু এই বাচ্চাগুলোর মতো নাদান নই। প্রো। বাকি পেমেন্ট ঠিক জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ো। ক্যাশে। জাল নোট পাঠিয়ো না। আমার স্ক্যানার আছে। ঠিক ধরে ফেলব।

দশ

শুক্রবার

সকাল ৫.০১ মিনিট

পরের দিন সকাল

রাজ্যের প্রবীণ বনমন্ত্রী 

গুরুপদ সামন্তর উপর হামলা

অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেন তিনি

নিজস্ব সংবাদদাতা : রাজ্যের প্রবীণ মন্ত্রী গুরুপদ সামন্তর উপর আক্রমণ। প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন তিনি। দুজন অজ্ঞাতপরিচয় সশস্ত্র আততায়ী তাঁর বাসভবনে ঢুকে তাঁর উপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে। পুলিশ শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় এবং অন্তিম সময়ে দুজন আততায়ীকে গুলি করতে বাধ্য হয়। মৃত আততায়ীদের খোঁজে কলকাতা পুলিশ ও রাজ্য পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত করছে।

এদিকে অঞ্চলের প্রভাবশালী তরুণ নেতা তরুণ হালদার জানান, সামনেই নির্বাচন। বিরোধী পক্ষ সম্মিলিতভাবে গুরুপদদাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। তবে পুলিশি তৎপরতায় সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। তরুণবাবু পুলিশের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

বিরোধী নেতৃত্ব এই অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছে, শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবার প্রকাশ্যে চলে এলো। সামনেই নির্বাচন। কে এবার অঞ্চলের টিকিট পাবে তা নিয়ে আগেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শাসকদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সাধারণ মানুষ তিতিবিরক্ত। বিরোধী পক্ষের নেতা আরও বলেন, এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে কোনো কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরের হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়া হোক।

এগারো

দুপুর ১১.০৫ মিনিট

-তরুণ, গুরুদা বলছি।

-এই নম্বরটা তো জানি না। চেঞ্জ করলেন নাকি?

-বাধ্য হলাম। আসলে তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ফোন করলাম। গোপনে।

-একবার কেন, দাদা? হাজারবার করবেন। বলুন, কী করতে পারি?

-কিছু করতে তো বলিনি তোমাকে। উলটো বলছি, আমাকে আহত কোরো না ভাই, তাহলে তুমি যে-কোনোদিন নিহত হতে পারো।

-কী যে বলেন দাদা! যা করার তা তো আপনিই করলেন। আমি তো নিমিত্তমাত্র!

-ঠিক। তুমি নিমিত্ত। আমি নেতৃত্ব। 

-যা বলেছেন! কিন্তু খালপাড়ের চাক্কু এর মধ্যে এলো কী করে? ও তো একটা গবেট, পাগল। আমি কিন্তু ওকে পাঠাইনি, দাদা। মাইরি বলছি।

-জানি। কে পাঠিয়েছে, সেটাও আমি জানি। তোমার মেলা আঁচ পাবার লোক আমার আছে। ইলেকশনের আগে যে তুমি এই খেলাটাই খেলবে, সেটা আমি জানতাম। ডেট অ্যান্ড টাইম জানার উপায় আমার জানা আছে। আসলে একটা শিখণ্ডী দরকার ছিল, তরুণ শিখণ্ডী। বেচারা চাক্কুর জন্য খারাপ লাগছে, ভাই। 

-তাহলে বলদটাকে পাঠালেন কেন? 

-বাঘ পাঠালে যদি খেয়ে ফেলত, তাই।

-আপনার প্রফেশনাল পিস্তলবাজ কিন্তু এ ক্লাস, দাদা। আমার লোককে কুত্তার মতো গুলি করে মারল! কী টিপ মাইরি!

-তুমি আরও কিছু লোক পাঠাতে পারতে। তাতে বডির সংখ্যা বাড়ত। বডির সংখ্যা না বাড়ালে হামলা ঠিক জমে না। পাবলিক খায় না। আরও দু-একটা বডি পড়লে ভালো হতো। চাক্কুকে এ কারণেই পাঠাতে হলো, ভাই। বডি বাড়াতে। তার পরলোকগত আত্মা যেন শান্তি পায়! যা-ই হোক, যে কারণে ফোনটা করলাম। তুমি নিশ্চয়ই জেনে গেছ, এবারও টিকিট আমিই পাচ্ছি? এবারও তিন লক্ষের লিড আমিই নেব। তোমার সাহায্য আমার লাগবে না, ভাই। সহানুভূতি ভোটের জোর খুব শক্তিশালী। গুড ডে। তোমার দিনটা ভালো কাটল না। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

বারো

দুপুর ১২.০৫ মিনিট

-স্যার গুরুপদ সামন্তর কেসটা কি আমি দেখব?

-এত দেখার জিনিস থাকতে গুরুপদকে দেখার কী আছে। ওটা আমিই দেখব। আর তুমি? কাল রাতে রজনী সেন লেনে এক বস্তা বালু খোয়া গেছে। তুমি বরঞ্চ চোর ধরার বন্দোবস্ত করো।

-ইয়েস স্যার!

তেরো

রাত ১১.০৬ মিনিট

-শুয়োরের বাচ্চা বুড়ো ভাম শালা শেয়ালের চাইতেও খচ্চর।

-শুয়োর ভাম শেয়াল খচ্চর, আপনি আর আমি, এই ছজনের মধ্যে আপনার ফেভারিট কে, মানে আপনি কোন পক্ষে?

-আমরা সবাই এখন আপাতত গুরুপক্ষে। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh