আহসান হাবীব সুমন
প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৪, ০৮:২১ পিএম | আপডেট: ০৯ জুন ২০২৪, ০৮:৩২ পিএম
রানী হামিদ। ছবি: সংগৃহীত
রানী হামিদ
বাংলাদেশের দাবার জগতে তিনি আক্ষরিক অর্থেই ‘রানী’। বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। উজ্জ্বল উদাহরণ এই মহীয়সী নারী। ৭৯ বছর বয়সেও বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য দাবাড়ু প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেপাই, মন্ত্রী আর হাতি-ঘোড়া নিয়ে লড়াই করেন প্রতিপক্ষের রাজাকে ঘায়েল করতে।
২০১৯ সালে ৩৯তম জাতীয় মহিলা দাবায় রানী হামিদ গড়েছেন বিস্ময়কর রেকর্ড। ৭৬ বছর বয়সে অর্জন করেছেন অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব। বিশ্ব দাবা ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে শিরোপা জয়ের যৌথ রেকর্ড এখন বাংলাদেশের রানী হামিদের। রেকর্ডটি এককভাবে দখলে নেওয়ার আশায় আছেন। এতেই বোঝা যায়, এখনো কতটা অদম্য রানী।
বাংলাদেশের নারীদের জন্য শুধু দাবা নয়, যে কোনো খেলাধুলায় রানী হামিদ অনুপ্রেরণা। তার পুরো নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন। ডাক নাম রানী। ১৯৪৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত নাম কর্নেল এম এ হামিদ তার স্বামী। বিয়ের পর স্বামীর নাম যুক্ত করে রানী হামিদ হন।
জাতীয় দাবায় রানী হামিদ সর্বাধিক ২০ বার শিরোপা জিতেছেন। এর মধ্যে ১৯৭৯-১৯৮৪ পর্যন্ত টানা ছয়বার জাতীয় দাবার শিরোপা জয়ের অনন্য কৃতিত্ব আছে তার। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত রানী হামিদ তিনবার জিতেছেন ব্রিটিশ নারী দাবার শিরোপা। রানী হামিদ প্রথম মহিলা বাঙালি দাবাড়ু, যিনি ইউরোপের ক্রীড়াঙ্গন থেকে দেশের জন্য সুনাম বহন করে নিয়ে এসেছেন। ২০১৫ সালে কমনওয়েলথ দাবায় স্বর্ণপদক জিতেছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক রেটিং দাবার বহু শিরোপায় সমৃদ্ধ করেছেন নিজের ‘শোকেস’।
১৯৮৫ সালে রানী হামিদ ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব পান। সিলেটে জন্ম নেওয়া রানী হামিদের বড় ছেলে কায়সার হামিদ বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। আরেক ছেলে ফুটবল আর ভলিবল খেলোয়াড় ববি হামিদ কিছুদিন আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অকালে পৃথিবী ছেড়েছেন।
সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারে রানী হামিদের জন্য ২০২২ সালটি ছিল কিছুটা হতাশার। তাকে ছাড়াই চেন্নাইয়ে দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নেয় বাংলাদেশ। যা দেশের ইতিহাসে প্রথম। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ প্রথম দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিল। সেই থেকে টানা ২০টি আসরে কখনো উন্মুক্ত বিভাগে, কখনো মেয়েদের বিভাগে খেলেছেন রানী হামিদ। জাতীয় প্রতিযোগিতার সর্বশেষ আসরে ফলাফল বিপর্যয়ে রানী সুযোগ পাননি অলিম্পিয়াডে। প্রতিযোগিতার আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন এই কিংবদন্তি দাবাড়ু। আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনাতেও। যে কারণে আসরে নিজের সেরাটা দিতে পারেননি।
২০২৪ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত হবে ৪৫তম দাবা অলিম্পিয়াড। জানা গেছে, রানী হামিদ বুদাপেস্ট যাবেন না। যা হতাশার। তবে রানী খেলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন না। তিনি আছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করতে চান দাবার সাদাকালো খোপের ঘরে।
সাবিনা খাতুন
বাংলাদেশের ফুটবলের প্রথম নারী সুপারস্টার। নেতৃত্বগুণ আর গোল করার অসাধারণ দক্ষতায় পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। অনেকের কাছেই তিনি বাংলাদেশের ফুটবলের লিওনেল মেসি। আবার কোনো কোনো ভক্ত তাকে তুলনা করতে ভালোবাসেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে। নারী-পুরুষ মিলিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের বহু রেকর্ড সাবিনার দখলে। ২০১৯-২০ লিগ মৌসুমে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে করেছেন ৩৫ গোল; যা বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। ছেলেদের ফুটবলে ১৯৮২ সালে ঢাকা লিগে সালাম মুর্শেদী ২৭ গোল করেছিলেন। লিগের ৪ মৌসুমে তার গোলের সংখ্যা ১১৫টি! এ ছাড়া ১৯২০ সালের লিগে আটটি হ্যাটট্রিক করেছিলেন সাবিনা। যা হয়তো আগে কল্পনাও করেনি কেউ।
সাবিনা বাংলাদেশের ‘গোল-মেশিন’। আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৪টি গোলের মালিক তিনি। ২০২২ সালে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল প্রথমবারের মতো জিতেছিল সাফ শিরোপা। নেপালে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে ৮ গোল করা সাবিনা ছিলেন সেরা খেলোয়াড় আর সেরা গোলদাতা। ২০১৪ সালের সাফেও ছিলেন সবার সেরা। বাংলাদেশের প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে খেলেছেন বিদেশের ক্লাবে। প্রথমবারেই বিদেশি লিগে খেলতে গিয়ে সাবিনা যে কৃতিত্ব করেছেন তা বোধহয় রূপকথাকেও হার মানায়। ২০১৫ সালে মালদ্বীপে পুলিশ ক্লাবের পক্ষে অভিষেকেই করেছেন ৪ গোল, পরের ম্যাচে একাই করেছেন ১৬ গোল (৫টি হ্যাটট্রিক!)। এর আগে ঢাকার মাঠে এক ম্যাচে ১৪ গোলের রেকর্ড ছিল এই স্ট্রাইকারের। মালদ্বীপে মোট ছয় ম্যাচে সাবিনা গোল করেছিলেন ৩৭টি এবং এর পাঁচটিতেই ছিলেন ম্যাচসেরা। মালদ্বীপ ছাড়াও ভারতে তামিলনাড়ুর সেথু এফসি আর কিকস্টার্ট ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। বাংলাদেশে বসুন্ধরা ছাড়া চাপিয়েছেন মোহামেডান, শেখ জামাল ধানমণ্ডির মতো বড় ক্লাবের জার্সি।
একটা সময় কাজী সালাউদ্দিন, চুন্নু, কায়সার হামিদ, মুন্না, আসলাম আর সাব্বিরদের একনামে চিনেছে গোটা বাংলাদেশ। এখন চেনে সাবিনাকেও। ব্রাজিলের তারকা মার্তাকে আদর্শ মানেন সাবিনা। ‘স্কার্ট পরা পেলে’ হিসেবে পরিচিত মার্তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে একটি দেশের নারী ফুটবলের সমার্থক হয়ে গেছেন সাবিনা।
১৯৯৩ সালের ২৫ অক্টোবর সাতক্ষীরায় জন্ম নেওয়া সাবিনার ফুটবলে হাতেখড়ি অষ্টম শ্রেণিতে থাকাবস্থায়। তার ফুটবল গুরু আকবর আলী, যিনি বাংলাদেশের ফুটবলে তৃণমূল পর্যায়ে খেলোয়াড় তৈরির কারিগর ছিলেন। শুধু সাবিনাই নয়, দেশের ফুটবলের প্রথম পেশাদার নারী কোচ ও সাবেক ফুটবলার মিরোনা খাতুন, জাতীয় দলের ফুটবলার সুরাইয়া খাতুন, মাসুরা পারভীনদেরও কোচ ছিলেন আকবর আলী।
ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মুড়ি মুড়কির মতো গোল করে চলেছেন সাবিনা। শুরুটা সাতক্ষীরার হয়ে। ২০০৯-১২ পর্যন্ত নিজ জেলা সাতক্ষীরার হয়ে ২১ ম্যাচে ৭০ গোল করেছেন। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে তার গোলের সংখ্যা ৫ ম্যাচে ১টি। গোল করা সাবিনার নেশা। ৩০ বসন্ত পেরিয়েও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সামনে থেকে। সাবিনার সবচেয়ে বড় গুণ তার জয়ের নেশা। কিছুতেই হার মানতে রাজি নন। তাই তো সাবিনাদের বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নারী ফুটবলে শ্রেষ্ঠ শক্তি।
সানজিদা আক্তার
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নারী ফুটবলে আলোচিত নাম সানজিদা। মূলত ইস্ট বেঙ্গলে নাম লিখিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসা। ২০২৩ সালে সানজিদা প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে যোগ দিয়েছেন লাল-হলুদ শিবিরে। গোলও করেছেন। ইস্ট বেঙ্গলের প্রথম বিদেশি নারী গোলদাতা হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।
২২ বছর বয়সেই বাংলাদেশের তারকা সানজিদা। গত এক দশকে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর থেকে উঠে এসেছে একঝাঁক নারী ফুটবলার। গারো পাহাড়ের পাদদেশে নেতাই নদের পারের শান্ত গ্রামের মেয়ে সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্ডা, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তাররা। প্রত্যেকেই খেলেছেন জাতীয় দলে।
কলসিন্দুর গ্রাম থেকে সানজিদাদের উঠে আসা সহজ ছিল না। মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবে এটাই মানতে পারেনি গ্রামবাসী; কিন্তু সব সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে সানজিদা এখন প্রতিষ্ঠিত ফুটবলার। শুরুটা হয়েছিল ২০১১ সালে কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (স্কুল অ্যান্ড কলেজ) হয়ে। বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে প্রথম খেলেন। ২০১৯ সালের বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে বয়সভিত্তিক জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৪ দলে সুযোগ পান। একে একে খেলেছেন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬, অলিম্পিক বাছাই, এশিয়ান কাপের বাছাই কাপ, এসএ গেমস, বয়সভিত্তিক সাফ ও জাতীয় দলে।
২০১৯-২০ মৌসুম থেকে দেশের ঘরোয়া ফুটবলে অংশ নিয়েছেন বসুন্ধরার হয়ে। দুবার শিরোপা জিতেছেন। ২০২২ সালে সাফ শিরোপা জয়ের ঐতিহাসিক অর্জনের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন। ২০১৬ সালের সাফ ফাইনালেও খেলেছেন। ২০১৬ সালের দক্ষিণ এশিয়ান গেমস ফুটবলে ব্রোঞ্জ জিতেছেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে জিতেছেন অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। অনূর্ধ্ব-১৪ সাফেও তার শিরোপা রয়েছে। মধ্যমাঠের কুশলী যোদ্ধা সানজিদা বল রিসিভিং, মুভিং, পাসিং, ড্রিবলিংয়ে দক্ষ। ৭ নাম্বার পরায় অনেকেই তাকে ‘এসএ-সেভেন’ নামে ডাকে। সানজিদা নিজেও সিআর-সেভেন মানে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ভক্ত।
সানজিদা বর্তমানে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে স্নাতকে পড়াশোনা করছেন। সুশ্রী মুখশ্রীর কল্যাণে তিনি এখন বাংলাদেশের ফুটবলের ‘পোস্টার গার্ল’। ইতোমধ্যে মডেল হয়েছেন একাধিক বিজ্ঞাপনে। ভালো গান গাইতে পারেন। তবে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সানজিদার প্রথম ভালোবাসা ফুটবল।
নাহিদা আক্তার
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার আইসিসির মাসসেরা নারী ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছেন নাহিদা আক্তার। ২৩ বছর বয়সী বাঁহাতি স্পিনার নাহিদা ২০২৩ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি পান। ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানকে ২-১ ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ওই সিরিজের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন নাহিদা। তিন ম্যাচে স্রেফ ১৪.১৪ গড়ে তিনি নিয়েছিলেন ৭ উইকেট।
কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নাহিদার অভিষেক। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের এশিয়া কাপ জয়ে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে কোনো উইকেট না পেলেও নির্ধারিতও ৪ ওভারে দিয়েছেন মাত্র ১২ রান। পুরো টুর্নামেন্টে পেয়েছেন পাঁচ উইকেট।
দেশের হয়ে নাহিদা ৪০ ওয়ানডে আর ৭৫ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে উইকেট সংখ্যা ৫১ আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৮৬টি।
২০২২ সালে হ্যাংঝু এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের হয়ে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। আর ২০১৯ সালে কাঠমান্ডু এসএ গেমসে জিতেছেন স্বর্ণ। নাহিদা এখন পর্যন্ত তিনটি আইসিসি টি-টোয়েন্টি, বিশ্বকাপ খেলেছেন। ২০১৯ সালের টি-টোয়েন্টি, বিশ্বকাপ বাছাইয়ের পাঁচ ম্যাচে ১০ উইকেট নেন। খেলেছেন ২০২২ সালে নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ।
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত
বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। তিনি মাদারীপুরের মেয়ে। বাবা হারুনুর রশিদ মুদি দোকানি। বেড়ে উঠেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। এক সময় দারিদ্যের জন্য পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যায়। তবে ক্যারিয়ার গুছিয়ে নেওয়ার পর ভর্তি হয়েছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মাবিয়ার মামা বক্সিং কোচ শাহাদাত কাজী। ২০১০ সালে মামার অনুপ্রেরণাতেই ভারোত্তোলন অনুশীলন শুরু করেন। খুব অল্প সময়ে ধরা দেয় সাফল্য। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে জেতেন প্রথম স্বর্ণ। ৬৪ কেজি ওজন শ্রেণিতে বাংলাদেশের রেকর্ড মাবিয়ার নামের পাশে। ২০২৩ সালের জুনে জাতীয় ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় সীমান্ত স্ন্যাচে ৮১ এবং ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ৯৯ কেজি তুলে মোট ১৮০ কেজি স্কোর করেন। ভাঙেন নিজের গড়া রেকর্ড।
২০১২ সালে দক্ষিণ এশীয় ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ জয় করেন। যা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ২০১৩ সালে কমনওয়েলথ গেমসে আসে রুপার পদক।
মাবিয়ার সেরা সাফল্য আসে ২০১৬ সালে ভারতের শিলং-গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে। সোনালি সাফল্য পাওয়ার পর পুরস্কার গ্রহণের মঞ্চে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে তার অঝোর কান্না ছুঁয়ে যায় সবার হৃদয়। ২০১৯ সালে কাঠমান্ডু এসএ গেমসেও মাবিয়া স্বর্ণ জিতেছেন। গড়েন দেশের প্রথম নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে এসএ গেমসের টানা দুটি আসরে স্বর্ণ জয়ের ইতিহাস। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে কলম্বো সাফ গেমসে প্রথম নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড রাইফেলের একক ইভেন্টে স্বর্ণ জয় করেন শুটার কাজী শাহানা পারভীন। পরের আসরেও স্বর্ণ জয় করেছিলেন শাহানা। তবে তা ছিল দলগত। ২০১৬ এসএ গেমসে সুইমিং পুলে ঝড় তুলে দুটি স্বর্ণপদক জয়ের ইতিহাস গড়েন শীলা।
চলতি বছর পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হবে ১৪তম এসএ গেমস। মাবিয়ার লক্ষ্য টানা তিনটি আসরে স্বর্ণ জয়ের নতুন রেকর্ড গড়ার।
শিরিন আক্তার
১০০ মিটার স্প্রিন্টে শিরিন আক্তার প্রতিষ্ঠা করেছেন একক রাজত্ব। ২০২৪ সালের জাতীয় অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপেও ১২.২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে সেরা হয়েছেন শিরিন। সব মিলিয়ে ১৫তম বারের মতো দেশের দ্রুততম মানবী হওয়ার উল্লাসে মেতেছেন। নারীদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে জাতীয় রেকর্ড শিরিনের দখলেই। ২০২২ সালে ১৬তম জাতীয় সামার অ্যাথলেটিক্সে প্রথম হওয়া শিরিন সময় নিয়েছিলেন ১১.৯৫ সেকেন্ড। এ ছাড়া ২০১৬ সালের এসএ গেমসে শিরিন সময় নেন ১১.৯৯ সেকেন্ড। যদিও কোনো পদক আসেনি। ২০১৬ সালের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। বাদ পড়েন হিটেই।
বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা কিংবা অলিম্পিক দূরের কথা, বাংলাদেশের কোনো নারী স্প্রিন্টারের দক্ষিণ এশিয়ায় স্বর্ণ জয়ের পর্যায়ে নেই। ১৯৯৪ সালের ১২ অক্টোবর সাতক্ষীরায় জন্ম নেওয়া শিরিনের যত সাফল্য, সবই দেশের গণ্ডিতে।
দিয়া সিদ্দিকী
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশ সাফল্য পাচ্ছে আর্চারি বা তীরন্দাজিতে। ২০২১ সালে আর্চারি বিশ্বকাপে রিকার্ভ মিশ্র দলগত বিভাগের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। সেই দলের অংশ ছিলেন দিয়া সিদ্দিকী। নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে বাংলাদেশ চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি; কিন্তু বৈশ্বিক পর্যায়ে যে কোনো খেলার ফাইনালে ওঠার ইতিহাস গড়ে দিয়ার আর্চারি দল।
২০১৯ সালের আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে দিয়ার অভিষেক। শুরুতেই বাজিমাত করেন মেয়েদের রিকার্ভ বিভাগে একক সোনা জয়ের মধ্য দিয়ে। ২০২৩ সালে এশিয়া কাপ ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং টুর্নামেন্টে (স্টেজ ওয়ান) রিকার্ভ মিশ্র দলগত ইভেন্টে মোহাম্মদ হাকিম আহমেদ রুবেল ও দিয়া সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ স্বর্ণপদক জয় করে। দেশেও দিয়া সফল। শেখ রাসেল চতুর্থ জাতীয় যুব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ জুনিয়র ক্যাটাগরিতে নারীদের একক ইভেন্টে বিকেএসপির হয়ে দিয়া জিতেছেন স্বর্ণপদক। জাতীয় আর্চারি প্রতিযোগিতার একক ইভেন্টে টানা দুটি স্বর্ণ রয়েছে তার। দলগত ইভেন্টেও দিয়ার রয়েছে স্বর্ণালি সাফল্য।
দিয়া সিদ্দিকী টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। খেলেছেন মেয়েদের রিকার্ভ এককের চূড়ান্ত পর্বে। রোমান সানার সঙ্গে জুটি গড়ে অংশ নেন মিশ্র দ্বৈত ইভেন্টেও। যদিও কোনো পদক আসেনি।
ফাতেমা মুজিব
২০১৯ সালের দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত হয় ফেন্সিং। তাতে যেন কপাল খোলে বাংলাদেশের ফাতেমা মুজিবের। ফেন্সিং এমনিতেই বাংলাদেশের প্রচলিত খেলা নয়। তলোয়ার নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় বাংলাদেশে, সেটাও হয়তো অনেকে জানে না। অপ্রচলিত খেলাটির চর্চাও বেশি হয় না দেশে, বছরে হয় মাত্র দুটি টুর্নামেন্ট। তাই তলোয়ারবাজ ফাতেমার নামও জানা ছিল না কারও। অথচ সেই ফাতেমাই কাঠমান্ডুতে সৃষ্টি করলেন ইতিহাস। জিতে নেন স্বর্ণ। এসএ গেমসই প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, যেখানে ফাতেমা অংশ নিয়েছেন। বিমানেও উড়েছেন প্রথম। বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেলেই অংশ নিচ্ছেন। খেলেছেন ২০২২ সালে তুরস্কের মাটিতে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে। এসএ গেমসে ফাতেমার স্বর্ণজয়ের পর থেকে আলোচিত ফেন্সিং নামক খেলাটি। নিজেই জানালেন, ‘ফেন্সিংয়ের কথা শুনলে সবাই নাক সিটকাত। এখন ব্যাপারটা বদলে গেছে। সাফের পর মিডিয়ায় এ খেলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, মানুষও চিনতে শুরু করেছে। আমিও গর্বের সঙ্গে বলতে পারছি।’
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফাতেমা নিজেই ফেন্সার হতে চাননি। স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবেন। কিন্তু বড় ভাই ফেন্সার সাদ্দাম মুজিবের অনুপ্রেরণায় নাম লেখান ফেন্সিংয়ে। শুরুতে ভালো লাগেনি। পরে মানিয়ে নেন। এখন তো ফেন্সিং খেলোয়াড় গড়ে তুলেছেন নিজের ক্যারিয়ার।
ফাতেমা হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের মেয়ে। বাবা খোরশেদ আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। ২০০১ সালে ফাতেমার দুমাস বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মারা যান তার মা। এরপর বড় বোন খাদিজা মুজিব অনেকটা মায়ের মতো করেই লালন-পালন করেছেন ফাতেমাকে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে ওঠা ফাতিমার মধ্যে রয়েছে যোদ্ধা মনোভাব। দৃঢ় মনোবলকে সঙ্গী করেই এগিয়ে চলেছেন ফাতেমা মুজিব।
পরিশেষ, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদরা উঠে আসছে, সন্দেহ নেই। অনেকেই নিজেদের নাম খোদাই করে রাখছেন ইতিহাসের পাতায়। বাংলাদেশ নারী দলের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি, ফরম্যাটে সেঞ্চুরির রেকর্ড ফারজানা হক পিংকির। ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশের প্রথম নারী সেঞ্চুরিয়ানও তিনি। কারাতের দুই কন্যা মারজান আক্তার প্রিয়া আর হুমায়রা আক্তার অন্তরা ২০১৯ সালের এসএ গেমসে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন স্বর্ণ। আর্চারির সুমা বিশ্বাস আর ইতি খাতুনরা সোনালি সাফল্য পেয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায়। সদ্যই খেলা ছেড়ে কোচিং পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন সাঁতারু শীলা আর শাপলার মতো সফল ব্যাডমিন্টন তারকা। তারা চেষ্টা করছেন নতুনদের তৈরি করার। তাতে বাংলাদেশের নারীরা ভবিষ্যতে খেলাধুলার জগতে অতীতের সাফল্য ছাড়িয়ে যাবে-প্রত্যাশা সকলের।