বাংলা কবিতার নতুন দিগন্ত: আল মমীনের ব্রত

সলিমুল্লাহ খান

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ০৭:০২ পিএম | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪, ০৭:০৪ পিএম

আল মমীন

আল মমীন

‘সমাজের ভালো কাজ করলে কেউ যখন তারিফ করে না, খারাপ কাজ করলে কেউ যখন নিন্দা করে না, তখন সমাজের শ্বাসকষ্ট চলতে থাকে। এই অবস্থাটিকে খুব সহজ কথায় অবক্ষয় বলা যেতে পারে।’ -আহমদ ছফা 

শামস আল মমীন আমার বাল্যকালের না হইলেও দীর্ঘদিনের বন্ধু। তাঁহার সহিত আমার পরিচয়ের যখন শুরু তখনো তিনি ‘চিতায় ঝুলন্ত জ্যোৎস্না’ ঘরের বাহির করেন নাই। বইটি তখন মাত্র বাহির হই হই করিতেছে। মনে হয় এই সেদিন উত্তর আমেরিকার বাংলা কাব্য-সেবকদের এক সমাবেশে তিনি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করিতেছেন। আর আমার মনে হইতেছে তিনি ভিন্ন, আর পাঁচজনের ছাঁচে গড়া নহেন।

১৯৯৫ সালের গোড়ার দিকে ‘চিতায় ঝুলন্ত জ্যোৎস্না’ ছাপা হইলে আমি তাহার একটি অসমাপ্ত পর্যালোচনা-বলা যায় প্রশস্তি-লিখিয়াছিলাম। জ্যোৎস্না ও চিতার বৈপরীত্য আমাকে বোদলেয়ার প্রণীত ক্লেদ ও কুসুমের বৈপরীত্য স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল। বিগত প্রায় ত্রিশ বছর ধরিয়া এই কবির কবিতা পড়িতেছি। তাঁহার সকল কবিতা গুণে ও মানে সমান মাপের-এমন কথা বলিব না। কিন্তু লক্ষ না করিয়া পারা যায় না-তিনি ধীরে ধীরে আগাইতেছেন। তাঁহার কবিতায় এমন একটা নতুনত্বের সূচনা হইয়াছে যাহা আমি যাঁহাদের কবিতা পড়ি তাঁহাদের মাপে নতুন। আল মমীন আত্মগত কিন্তু পরম বিনয়ী, নীরব, নিভৃতচারী প্রায় বৈষ্ণব মানুষ। উত্তর আমেরিকায় অভ্যাগত সমাজের মুণ্ডিতমাথা অভিজ্ঞতা তাঁহার কবিতাকে নতুন অভিজ্ঞান দিয়াছে। বাংলাদেশে শামসুর রাহমানের আবির্ভাব হইতে এই নিবন্ধ লিখিবার সময় পর্যন্ত যে যুগকে আমরা আধুনিক-বা নিদেনপক্ষে নতুন বাংলা-কবিতা বলিতে অভ্যস্ত সে যুগের অভিধানে অভিনব একটা অভিধা যোগ করিয়াছেন শামস আল মমীন। এই নিবন্ধে আমি দুই চারটি কবিতার আশ্রয়ে কথাটা পেশ করিবার কোশেস করিব। 

স্বীকারোক্তি

‘শামস আল মমীনের জন্ম ১৯৫৭ সালের ছাব্বিশে ডিসেম্বর, রংপুরের বদরগঞ্জে। তাঁর প্রাথমিক বিদ্যাপাঠ স্থানীয় স্কুল ও কলেজে। [তিনি] ১৯৮২ সালে যান [উত্তর] আমেরিকা। সেখানে তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য এবং শিক্ষাশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৮৯ সন থেকে তিনি নগর নিউইয়র্কের শিক্ষা বিভাগে ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন’মোটামুটি এই কথাগুলি তাঁহার ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের বিক্রয় প্রলাপ বা বিজ্ঞাপনযোগে পাওয়া গেল। তাঁহার নবীনত্ব কোথায় তাহা বুঝিতে এই তথ্য কিছুটা কাজের কাজ করিবে।

আল মমীনের যে কবিতটি প্রথম আমার চোখে পড়িয়াছিল তাহার নাম ‘খুঁটি’। এই কবিতা মাথায় বসাইয়াই তিনি ‘চিতায় ঝুলন্ত জ্যোৎস্নাা’র বিসমিল্লাহ করিয়াছিলেন। এই কবিতা একদিকে যেমন তাঁহার কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা, তেমনি অন্যদিকে ভাষার সহিত পরকীয়া প্রেমও। নামান্তর ও রূপান্তর-অথবা হাজার বছরের পুরানা বাংলা ভাষায় যাহাকে বলে লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা-এখানে জমিয়া একটা রূপক (বা অ্যালেগরি) বানাইয়াছে। উপদেশ অপেক্ষা উদাহরণ ভালো। তাই আমি আস্ত কবিতাটাই এখানে উদ্ধার করিতেছি। জনৈক স্কুল-শিক্ষকের জবানিতে কবিতাটি গড়াইতেছে। গড়াইতে গড়াইতে অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির জমাট রূপক বাঁধিয়াছে। বিশেষ ও সামান্য এক কাতারে-বলা যায় এক দেহে-লীন হইয়াছে।

অবেশেষে স্কুলের প্রবেশপথের সামনে এসে

দাঁড়াই। পাঁচটা ক্লাসে গুরুগিরি করে

বোধশক্তিগুলো ক্রুদ্ধ। জেদি কিশোরের মতো

অকারণে রেগে থাকি। শেষ এপ্রিলের

উষ্ণ ঠান্ডা হাওয়া ঠান্ডা করে আমার ইন্দ্রিয়

যেমন শিশুরা ছোট ছোট ফুঁ দিয়ে গরম স্যুপ।

রাস্তার ওপারে নগরকর্মীরা ঘেমে

উঠেছে থালার মতো গোল আর বাঁশের চেয়েও

লম্বা বিদ্যুৎখুঁটির সাথে ধস্তাধস্তি

করে। আমি বলি

‘থাক না এতদিনের পুরনো জিনিশ

কাজ তো চলেই যাচ্ছে’-ওরা বলে,

‘পুরনো কাঠখুঁটিতে লোকের আগ্রহ কমে গেছে।

দেখছেন না এই নতুন খুঁটিতে চারপাশের

রঙ কেমন বদলে গেলো।’ তারপর

ওরা বুড়ো খুঁটিটা ট্রাকের পিছে ফেলে

হল্লা করতে করতে চলে যায় নগরের দিকে।

বারো-চৌদ্দ বছরের এক দুরন্ত বালক

আমাকে চমকে দিয়ে বলে,

‘এক্সকিউজ মি, মিস্টার মমীন।’

আমি তার পথ রোধ করে আছি, বুঝতে পারিনি।

আজ থেকে ষোল কিম্বা বিশ বছর পর ঐ

ছেলেটি আমার দিকে সন্দেহে তাকাবে

আমার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এবং

আমাকে বদলে দেবে।

তারপর একদিন

ট্রাকের পিছনে পুরনো খুঁটির মতো

টেনে নিয়ে যাবে ওদের যেখানে ইচ্ছা। 

নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা ইতিহাসের উপলব্ধির সহিত মিলাইয়া দিবার ঢের উদাহরণ আছে আল মমীনের কবিতায়। ‘লি শেন’ তাঁহার স্কুল-শিক্ষক জীবনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাস আনিয়া যুক্ত করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদের কলাপাতা অল্প বাতাসে কেবল এক পিঠ দেখাইতে পারে না। তাহাকে আরবার ঐ পিঠও দেখাইতে হয়। আল মমীনের দ্বিতীয় বই ‘মনোলগ’ (২০০১) এই কবিতা শিরোধার্য করিয়াই ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল।

সেপ্টেম্বর। সবার পেছনে বসা বারো বছরের 

লি শেন রাতের পাড়াগাঁর মতো শান্ত।

মুঠিবাঁধা দুহাতে বানায় নিখুঁত ত্রিভুজ। পাখির ছানার 

মতো আধফোটা চোখ, ধানিরঙ চুল

যেন ঝড়ের তাণ্ডবে নুয়ে গেছে, তবু খাড়া শির

দাঁড়া, প্রতিবাদী। 

লি হোমওয়ার্ক করে

যত্নে রাখে খাতা বই,

সে রচনা লেখে ভালো, প্রায় 

শুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজি বলে; ইঁদুরের মতো

চুপচাপ রোজ ক্লাসে ঢোকে,

আটটা চল্লিশে।

এপ্রিলের শেষে নতুন পাতার দোল। সকালের

রোদ বাড়ে তার রঙধনু গালে।

বৈশাখী হাওয়ায় এলোমেলো

নিজেকে হারায়। গতকাল লাঞ্চরুমে নিয়ম ভাঙায় তার

শাস্তি হয়। আমার ইংরেজি ক্লাসে,

ক্লাস-পালানো মেরীর সাথে ফিসফাস করে।

আমি পাহাড়ের মতো তার সামনে দাঁড়াই, বলি,

পড়ায় তোমার মন নেই। আজ তোমার আব্বাকে 

কল করা হবে। ওয়ান্টন

স্যুপের মতোই তাকে বিষণ্ণ দেখায়।

আমি বলি, তিনি কি অফিসে?

তিনি নেই।

তবে তোমার মা?

সে আমার রক্তচোখে চোখ রেখে নরম শিশুর মতো বলে,

ভিয়েতনামে। 

কবি মহাত্মা মতিন বৈরাগী-এই ‘লি শেন’ পড়িয়াই-বলিয়াছিলেন, “কেন যেন আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল ছুটে যাই লি শেনের কাছে যে একা, বিচ্ছিন্ন, বাবা বা মায়ের কাঙাল, যার অন্তরের কান্না প্রতিমুহূর্তে বড় হচ্ছে, বিশাল হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায়, আফ্রিকায়, 

পৃথিবীর দেশে দেশে।”  এই আবেগের আরেক ঘনীভূত প্রকাশ ‘আয়লান কুর্দি’: ‘ভূমধ্যসাগর তীরে, একা শুয়ে আছে আয়লান।’

ছোট ছোট ঢেউ

জ্যোৎস্নাভরা রাত

আর শোকের হাওয়ায় ভিজে যায় তীর

লাল জামা

নীল প্যান্ট

কালো চুল। 

স্বীকৃতি

১৯৭১ সালের মার্চ মাস হইতে শুরু করিয়া বাংলাদেশের শরণার্থীর ঢল যখন বাঁধ ভাঙিয়া পাশের দেশ সয়লাব করিয়াছিল, যখন মুক্তিসংগ্রাম পায়ে হাঁটিয়া ভারতে চলিয়া গিয়াছিল, সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধীনতা অভিলাষী নতুন দেশকে স্বীকার করিয়া লয় নাই ভারত। বাংলাদেশকে তিনি 

স্বীকৃতি দেন ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন। সেদিন হইতে পাশ্চাত্যের মুখে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলিয়া অভিহিত হইতে শুরু করে। স্বীকৃতি কথাটি ততক্ষণে নতুন তাৎপর্য অর্জন করিয়াছে। ১৯৭১ সালের সাড়ে আট মাস ‘স্বীকৃতি’ শব্দটি অনেক শরণার্থী দিবারাত্রি তসবিহ দানার মতো জপিতেন। এক বছর পর একধাক্কায় স্বাধীন বাংলাদেশে-১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে-আবুল হাসান ‘স্বীকৃতি চাই’ নামে একটি কবিতা রচিয়াছিলেন। ঐ কবিতায় স্বীকৃতি কি পদার্থ তাহার একটি নামান্তর (বা লক্ষণ তালিকা) হাজির করিয়াছিলেন তিনি।

আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই

স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে

মৃত্যুমাখা মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছি একলা মানুষ

বেঁচে থাকার স্বীকৃতি চাই

স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে!

ঐ যে কাদের শ্যামলা মেয়ে মৌন হাতের মর্মব্যথায়

দাঁড়িয়ে আছে দোরের গোড়ায়

অই মেয়েটির স্বীকৃতি চাই

স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে!

সস্তা স্মৃতির বিষণ্ণতার

নাভিমূলের অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি চাই

স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে!

আমি আমার আলো হবার স্বীকৃতি চাই

স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে!

অন্ধকারের স্বীকৃতি চাই

স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে, স্বীকৃতি দে! 

এই স্বীকৃতির দাবি আল মমীনের অভিজ্ঞতায় আরো একটা নতুন পাতা যোগ করিয়াছে। ২০১০ সালে রচিত এই কবিতার নাম ‘বেড়ে ওঠা’। এই শিশুটিও স্বীকৃতি চায়-সে আর ‘বেবী’ নয়, সে এতদিনে ‘বিগ বয়’ হইয়া গিয়াছে। 

কিন্ডারগার্টেন ক্লাস।

হাত পা গুটিয়ে

গোল হয়ে বসে ওরা...

মন দিয়ে শোনে ঈশপের গল্প।

একটা নরম ছেলে নিয়মের বেড়া ভেঙে 

দাঁড়ায় আমার মুখোমুখি,

মুখ ভার...

হঠাৎ বৃষ্টির মতো

ঝর ঝর বলে যায়, ‘ইভান আমাকে বেবী বলে’।

ওর অভিমানী শরমরাঙা মুখের দিকে

বিস্ময়ে তাকাই কিছুক্ষণ, তারপর বলি :

‘তাহলে তুমি কি?’

ও হাত উঁচিয়ে মাথা দুলিয়ে ঠোঁট বড় করে বলে,

‘আমি বি.....গ বয়।’

আচ্ছা! তুমি বি....গ বয়!

‘হ্যাঁ, মা বলে আমি বিগ বয়।’

আমি ওর বেড়ে ওঠা দম্ভ প্রাণ ভরে দেখতে দেখতে

আবারো কাক ও শেয়ালের গল্প বলতে থাকি... 

এই স্বীকৃতির কোন শেষ নাই। ইংরেজি ২০১১  সালের জাতক আরেকটি কবিতার নাম-কোন প্রকার রাখঢাক ছাড়াই-‘কিন্ডারগার্টেন ক্লাস’। এই কবিতার শিশুটি আর শিশু নাই, আরেকটু বড় হইয়াছে। তাহাকে ইচ্ছা করিলে আপনি কিশোর বলিতে পারেন। তাহার দাবি ন্যূনতম। তাহার পুরুষ বড় হইয়া যাইতেছে। খুব বিরক্তি উৎপাদন করিতেছে। এই বিরক্তির পরের নাম স্বীকৃতি। আর মনে হয় স্বীকৃতির অপর নাম নিষ্কৃতি নাই। 

স্বীকৃতি অ-নে-ক বিরক্ত করিয়া থাকে।

কর্ণবিদারী কিচিরমিচির পাখিদের মতো 

মুখরিত ওরা।

এক 

দুই 

তিন

যে যার আসনে মুহূর্তে নির্বাক...

মুষ্টিবদ্ধ হাত

তবুও কেউ হাস্যরসে হাসির পরেও মুখ টিপে হাসে।

যদি ফুলে ফুলে নাম ধরে ডাকি, তবে

ওরা কেউ সূর্যমুখী

কেউ হাসনুহেনা

কিম্বা দুধশাদা সুরভিত ভোরের বকুল।

তারই মাঝে, এক কোণে একা,

প্যান্টের জিপার ধরে

ধস্তাধস্তি, আর

মুখে রাজ্যের বিরক্তি।

আমি বলি, ‘কি ব্যাপার, ড্যানিয়েল?’

‘নুনুটা আমার, বার বার, বড় হয়ে যাচ্ছে,

খুব বিরক্ত করছে।’

আকাশ মাটির মতো মুখোমুখি, নির্বাক আমরা।

তারপর খুব ধীরে, তার দিকে ঝুঁকে, তাকে বলি,

‘ওটা তোমাকে অ-নে-ক বিরক্ত করবে’

ও আমার দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসে, অনেকক্ষণ... 

এই স্বীকৃতির সমস্যাটি নেহায়েত কোন ড্যানিয়েল কি কোন বিশেষ বিগ বয়ের একার নহে। এই সমস্যা অনিঃশেষ। সমস্যা স্বয়ং কবিরও। বয়স্য কবি বা কথক যে এলাকায় বসবাস করেন-ধরিয়া লইলাম-তাহার নাম ‘বেলরোজ’। ‘হাউ আর ইউ টুডে’ কবিতার ‘স্বীকৃতি চাই’ স্বরটি ধরিবার জন্য এলাকার নামটা কি তাহা না জানিলেও আমাদের হইত। মার্কিন মুলুকে নতুন অভ্যাগত বা সর্বশেষ আগত ডেনিজেন অর্থাৎ গতরজীবীদের যে কোন পাড়ার নাম হইলেও চলিত আমাদের। কেননা ‘মনুষ্য পরিবারে দেখি নানান মানুষ’।

পৃথিবীর কোন্ নদীজলে ভিজেছিল মেয়েটির হাত?

কোথাকার জল ছুঁয়েছিল তার চোখমুখ, কদম ফুলের

মতো গাল? মিসিসিপি? নীলনদ? ব্রহ্মপুত্র? নাকি

আরো দূর আমাজনে?

কোন্ আদিম সভ্যতা তার রক্তধারায়?

মিশরীয়? অ্যারিয়ান? ইনকা না মায়া?

পৃথিবীর সব ভাষা, ভূগোল ও ইতিহাস ভুলে

শুধু মনে হয়...

তাকে দেখি প্রতিদিন, দেখি

ব্যাকপ্যাক কাঁধে মাথার ভিতর জট বাঁধে

হোমওয়ার্ক, মিডটার্ম, ফাইনাল। বেলরোজ দিয়ে 

রোজ যায়, আসে। এলোমেলো চুল হাওয়ায় ছড়িয়ে

বিকেলের প্রায় যাই যাই রোদে

বলবে কি সে কোনদিন, হাউ আর ইউ টুডে? 

স্বীকৃতির এই বাসনাটা সামান্যই। কবি চাহেন মেয়েটি তাহাকে বলুক, আজ আপনি কেমন আছেন? এই বাসনা সামান্য। ‘অল্প’ এবং ‘যাহা সমান করে’-এই দুই অর্থেই। এই বাসনা অশেষ। এই বাসনার শেষ নাই। ‘স্বীকৃতি চাই’ মাত্রেই তাই বাসনার রূপান্তর। স্বীকৃতির আরেক নাম এই কারণেই ‘সভ্যতা’। যেখানে পরজীবী জীবমাত্র থাকেন না, হইয়া উঠেন সভার সদস্য বা সভ্য, নাগরিক। স্বীকৃতির সহিত স্বীকৃতির ঠোকাঠুকি হয়। বদলোকে বলে ‘সভ্যতার সংঘাত’ ঘটে। সেই লোকটি কি জানেন আজ এই দুনিয়ায় এমন কোন সভ্যতা নাই যাহা একই সঙ্গে অসভ্যতার, বর্বরতার নিদর্শন নহে? বাহ্লটার বেনিয়ামিনের প্রসিদ্ধ উক্তি মনে পড়ে : ‘সভ্যতার প্রতিটি অর্জনই একেকটি বর্বরতার নিদর্শন।’

‘জাতিবিদ্বেষ’ নামে হালফিল প্রণীত একটি কবিতায় শামস আল মমীন (একদা) মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি সদুক্তি শিরে ধারণ করিয়াছেন। এই সদুক্তিকর্ণামৃতের অনুবাদ অক্ষরে অক্ষরে করা কঠিন। ইহার মর্মার্থ-‘এখানে পায়ুপথতুল্য (শিটহোল) নানান দেশের লোকজনে জায়গা দেওয়া হইতেছে কেন?’ জবাবস্বরূপ আমাদের কবি জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তুমি যাহাদিগকে পায়ুপথিক বলিতেছ তাহাদের যতটুকু সভ্যতা তাহাও তো তোমার অর্জন করা হইল না! তুমি কেন এতদিনেও এতখানি সভ্যও হইতে পারিলে না, ভ্রাতা!

শ্বেতাঙ্গরা 

দিনের বেলায়

গাছে ঝুলিয়ে মারতো ওদের

মুখের উপর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে

বলতো অসভ্য, জংলী, আনসিভিলাইজড্

কয়েক শতাব্দী শেষে

এই জংলীরাই ওদের শেখায়:

লিসন্ ব্রাদার

জাতিবিদ্বেষে মহৎ কিছু নাই। কিন্তু

আমি ভেবে অবাক

কি করে আজও তুমি

‘নট সো সিভিলাইজড্’... 

শুদ্ধ উত্তর আমেরিকায় কেন, শ্বেতাঙ্গ সভ্যতার অর্থাৎ বর্বরতার দুই পা পড়ে নাই এমন দেশ বা মহাদেশ আজ আর কোথায়ও পাইবেন না আপনি। এই পৃথিবীর নিঃসঙ্গতার পথে হাজার বছর ধরিয়া যিনি হাঁটিতেছেন তাহাকে স্মরণ করিয়া আল মমীন লিখিতেছেন :

ওই তো তিনি! ‘কালো মুখ, শাদা মুখোশ’ এঁটে

হাঁটছেন, একা আরো কিছুদূর!...

কবিতাটির নাম, ‘আপনি বলুন, স্যার’। উদ্ধার চিহ্ন না থাকিলেও, বলা বাহুল্য, আপনি জানেন পরাধীন মানুষের আর্তস্বরের নাম-ফ্রানৎস ফানোঁ। তাঁহার প্রণীত কেতাবের নাম ‘কালো মুখ, শাদা মুখোশ’। এই কবিতায় কবি আছেন, শিক্ষক আছেন, ছাত্র-ছাত্রী আছেন। পার্থক্যের মধ্যে, তাহারা সকলেই নির্বাক, অবলা, ভাষাহীন। তাহারা জলজ প্রাণী-‘জলের সমস্ত প্রাণীকুল’। নভো-জল-স্থলচারী মানুষ হাঁটিতেছে হাজার বছর। একা। মানুষের একাকিত্বই যতি। তাহার নিয়তি-বলা যাক নিঃযতি বা নিয়তির নতুন নাম-‘ঝাঁকে ঝাঁকে গাংচিল’ কিংবা ‘চরে ঠেকে থাকা কচ্ছপের দল’।

কতগুলো ঢেউ এসে ধুয়ে দেয় তার যুগল চরণ।

স্তব্ধ বালুপথে হাঁটছেন তিনি, একা

হঠাৎ মেলবোর্নের ‘গ্রেট ওশান’ রহস্যময় হয়ে ওঠে আরও।

ঘাড় ফিরে দেখলেন তিনি

জলের সমস্ত প্রাণীকুল জড়ো হয়ে আছে তীরে;

সবিনয়ে বলে ওরা,

আপনি বলুন, স্যার, আমরা শুনছি।

বেসামাল জলোচ্ছ্বাস, মাথার উপর ঝাঁকে ঝাঁকে গাংচিল, আর

চরে ঠেকে থাকা কচ্ছপের দল

নতশিরে বলে ফের

আপনি বলুন, স্যার, আমরা শুনছি।

যতদূর চোখ যায়, তার চেয়ে দূরে চোখ রেখে দেখলেন তিনি

লাকাঁ নেই, ফানোঁ নেই ... কিছু

অমর পংক্তি কোটের পকেটে নিয়ে শহরের ফুটপাতে

দাঁড়িয়ে আছেন বোদলেয়র।

ভিনদেশি সব সাগরবিহঙ্গ, উড়তে উড়তে হর্ষোৎফুল্ল গুঞ্জনে মেতে ওঠে।

ওই তো তিনি! ‘কালো মুখ, শাদা মুখোশ’ এঁটে

হাঁটছেন, একা আরো কিছুদূর!... 

নিয়তির অপর নাম যে যতিহীনতা-মানে হাঁটা-সে সত্যে কি আর সন্দেহ রাখা চলে? তাহাকে হাঁটিতে হইবে আরো কিছুদিন, কিন্তু একা। কেন এই একাকিত্ব, কেন এই হাঁটাহাঁটি?

স্মৃতি

১৯৮৯ সালে-যে বছর শামস আল মমীন নিউইয়র্ক নগরের শিক্ষা বিভাগে কাজ শুরু করিলেন সে বছর-ঢাকায় স্বদেশে পরবাসী মহাত্মা আহমদ ছফা স্মরণ করিতেছিলেন : “আমাদের দেশের পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ গাঁটের পয়সা খরচ করে, অবর্ণনীয় ক্লেশ স্বীকার করে চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটির মায়া কাটিয়ে চিরতরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিজরত করার দরখাস্ত করেছিল। পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ, চাট্টিখানি কথা নয়। মোট জনসংখ্যার তেইশ ভাগের এক ভাগ। মার্কিনী কর্তৃপক্ষ তাদের কোন ভদ্রজীবন যাপনের নিশ্চয়তা দেয়নি। গতরে খাটবে আর খেয়ে পরে বেঁচে থাকবে-এইটুকুই শুধু প্রতিশ্রুতি। এটুকু আশ্বাসে এই দেশের তেইশ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা বিশ্বকবির সোনার বাংলার সমস্ত মায়া, মমতা অগ্রাহ্য করে চিরদিনের জন্য-শেকড়ের সমস্ত টান, সমস্ত আকর্ষণ অগ্রাহ্য করে-বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি দেয়ার জন্য দিনের পর দিন, রাতের পর রাত মার্কিন দূতাবাসের দুয়ারে মাথা ঠুকছে। এই দেশটি মনুষ্য বসবাসের এখনো উপযোগী রয়েছে-এর চেয়ে বড় মিথ্যা, এর চাইতে বড় ধাপ্পা আর কিছুই হতে পারে না।” 

প্রশ্ন হইতেছে : এই দেশ এতদিনে আর মানুষের বসবাসযোগ্য রহিল না কেন? এ প্রশ্নের কোন উত্তর কি আছে আদৌ? একটা উত্তর কিন্তু সকলেই জানেন : সুখের আশায়, স্বাচ্ছন্দ্যের বাসনায় দেশ ছাড়িয়া যাইবার জন্য-অপরচুনিটি আর ডাইভারসিটি প্রভৃতি বাহারি নামের ভিসার আশায়-দরখাস্ত ঠুকিয়াছে মানুষ। আধপেটা স্বাধীনতার চাহিতে ভরপেটে দাসত্ব করাও শ্রেয়। আহমদ ছফার কথায়, ইহার মধ্যে “কিছুটা সত্য তো অবশ্যই আছে। গাছের শাখা সূর্যালোকের দিকে অভিসার করে। আত্মরক্ষার চেষ্টা তো প্রাণীমাত্রেরই ধর্ম।” 

তবে এই ব্যাখ্যায় ষোল আনা সন্তুষ্টও নহেন তিনি। তাঁহার মনে বরং প্রশ্ন জাগে : “তথাপি এটা পুরো সত্য নয়, হতে পারে না। কষ্টের ভয়ে সকলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইছে এ কথা যদি সত্য হত, তাহলে যুদ্ধের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে দেশ স্বাধীন করার জন্য দেশ-বিদেশের বাঙালি মত্ত মাতঙ্গের মতো এমনভাবে ছুটে এসেছিল কেন?’ পার্থক্যটা কোথায়? আশায় ও আশাভঙ্গের বেদনায়। আহমদ ছফা নীরবে বলিতেছিলেন, যে আশায় বিদেশে স্থিত বাংলাদেশের মানুষ একদিন-সেই ১৯৭১ সালের মহাসিন্ধুর কল্লোলে-মাতৃভূমিতে ছুটিয়া আসিয়াছিল আজ সে আশার গুড়ে বালি পড়িয়াছে। তিনি লিখিতেছেন : “যে দেশটিকে আমি ভালোবেসেছি স্বেদবিন্দু দিয়ে, যে দেশের মাটিতে ফসল ফলাবার স্বপ্ন দেখেছি, রক্তবিন্দু দিয়ে যে দেশটি স্বাধীন করেছি, সেই দেশটিকে আমার নিজের দেশ মনে করার কোন অধিকার যদি না থাকে, ভবিষ্যতে উত্তর-পুরুষের বসবাসের উপযোগী করে নির্মাণ করার পরিকল্পনায় যদি আমার শ্রম, মেধা কাজে খাটাতে না পারি, সেই দেশে অবস্থান করে কি লাভ!” 

সমস্যার মধ্যে, ঘটনার শেষ এখানেই নয়। মার্কিন কর্তৃপক্ষ-বা আর আর দেশের পাঁচজন মেজবান-চাহিয়াছেন শ্রমিক কিন্তু পাইয়াছেন শুদ্ধ শ্রমিক নয়, অন্য কিছু। পাইয়াছেন যাহাদের তাহারাও মানুষ, মানে তাহারাই স্বয়ং বাসনা অর্থাৎ স্মৃতিও তাহাদের সঙ্গে গিয়াছে। শামস আল মমীন ‘স্মৃতি’ শিরোনামক কবিতায় এই বিদগ্ধ বিরোধ নীলকণ্ঠের বিষের মতো ধারণ করিয়াছেন। নিছক গতরে খাটিবে আর খাইয়া পরিয়া বাঁচিয়া থাকিবে-এইটুকুই মাত্র মানুষ নয়। মানুষের আশা নয়। মানুষের ভালোবাসা নয়। মানুষ হইলেই স্মৃতি থাকিবে। আগেই কবুল করিয়াছি, ‘স্মৃতি’ তো বাসনারই অপর নাম। ‘স্মৃতি’ শব্দের সংস্কৃত মূল ‘স্মরা’-মানে প্রেমে পড়া। মানুষ প্রেমে পড়া প্রাণী। সে স্মরণ করে। তৃষ্ণায় তাকাইয়া থাকে ভাঙা বাড়িটার দিকে। আল মমীন এই সত্যই রচিয়াছেন ‘স্মৃতি’ কবিতায় :

আমাদের কোন বাগান ছিল না। বাড়ির সামনে

বিষণ্ণ যে ক্ষেতটুকু ... সেও

তৃষ্ণায় তাকিয়ে থাকে ভাঙা বাড়িটার দিকে

পথে পথে কারা যেন ফেলে রাখে ব্যথিত বকুল।

আমি বার বার

এখানে এসেই ঝরে পড়ি

এখানে এলেই দেখি উঁকি দিয়ে যায় শীতল বাতাস।

শঙ্খধ্বনি,

গির্জার ঘণ্টাধ্বনি,

আলোক ছড়ানো সাঁঝে আজানের দীর্ঘ সুর শুনি।

সেই সব মুখরিত কোলাহল প্রার্থনার 

মতো মনে হয় আজ; মনে হয় কত স্মৃতি

এখনো দাঁড়িয়ে আছে পুরনো দরজা ধরে।

এখানে এলেই শীতল বাতাস উঁকি দিয়ে যায়,

কারা যেন নীরবে ছড়ায় কামিনীর ঘ্রাণ 

পথে পথে ফেলে রাখে ব্যথিত বকুল... 

স্মৃতিই একদিন ফিরাইয়া আনে। আবার সেই ফেরাও আরেক রাতের মধ্যে স্মৃতিতে ঘেরাও হইয়া যায়। স্মৃতি মাত্রেই ফেরারি। এই দোলাচল চলিতেই থাকে। কবিতার নাম ‘ফেরা’। সকল কবিতাই এক অর্থে ফেরা। প্রথম দৃষ্টিতে প্রেম বলিয়া কিছু যে নাই-থাকিতে পারে না-তাহার কারণ এখানেই। প্রেমই-বলা ভালো-কারণ-কারণবারি।

জেলা শহর রংপুর ছেড়ে বদরগঞ্জ স্টেশনে

নেমে পড়ি। দাদা বলেছিল, ‘এতটা অচেনা পথ

কি করে আসবি?’ ‘জন্মভূমি! ঠিক চিনে নেবো’-বলে

অস্থির দাদীকে শান্ত করি।

হাতের ব্যাগটা কাঁধে। আঙুলের

ফাঁকে মার্লবোরো।

ফ্লাস্কে দুধ ছাড়া কফি। নগরের

শেষ চিহ্ন বিদ্যুৎখুঁটিতে রাতজাগা ক্লান্ত 

বাল্ব। চার স্টলে দাঁড়াই, আমার পিঠছোঁয়া চুল, 

কানে দুল। চোখে ওদের রাজ্যের কৌতূহল। 

কয়েকটা ডালবড়া চোখ মেলে

আছে অসহায়। ঝাপসা বৈয়ামে মলিন নিমকি।

বুড়োর দগদগে ঘা থেকে উড়ে যায়

একজোড়া মাছি। টলটলে অ্যাভিয়ান

উপহাস করে গ্লাসের ঝাপসা পানি।

এখানে সভ্যতা বিবস্ত্রা নারীর মতো লজ্জা পায় প্রতিদিন।

খাল পার হয়ে সরু পথে হাঁটি আরো দু মাইল।

সেয়ানা মেয়েরা তড়িঘড়ি

শাড়ি টেনে দেয় বুকে। আমাকে দেখেই

একজন তসবিতে বৃদ্ধাঙুল চালালো। অদূরে

এক প্রৌঢ় দলছুট

দুরন্ত গরুর গায়ে কষে দেয় রোষদণ্ড। তাকে

বলি, ‘আর কতদূর, হাজীপুর?’ ‘এই তো সামনে

বাঁশঝাড়, তারপর ধানক্ষেত পার

হলেই ...’। আঙুল দিয়ে ও যেন চাঁদের

দূরত্ব দেখালো।

মাথার ওপরে টান টান রোদ।

অল্প অল্প কাদা আর ধুলা গায়ে পৌঁছে যাই। দাদা

আমাকে জড়িয়ে। তার

মরুবুক ডুবে যায়

স্নেহে। অন্ধ দাদী আমার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে রুয়ে 

দেয় ভালোবাসা; যেন সে ডুবছে টাইটানিকের

মতো আরো বিপুল অন্ধকারে।

মিনিটে তামাম গ্রাম ভেঙে আসে। ছোট ছোট কথা, 

‘মানুষটা কি সোন্দর, ব্যাটা না মাইয়া?’ ওরা

কেউ আমার চাচার ছেলে, কেউ বিধবা ফুফুর

মেয়ে। ইচ্ছে হয় বুকে নিয়ে বলি, ‘বাবা কেন রক্তে

কুড়াল দিয়েছে?’

ভাতের ফেনের মতো ঘন হয় অভিমান।

হারিকেনের আলোয় ধেড়ে আর নেংটি ইঁদুরের কাড়াকাড়ি।

মাথার ওপরে দাদার কোমল হাত

চোখে ফোটা নির্মম আনন্দ যেন

হাত বাড়ালেই ছোঁওয়া যাবে

আমাদের ছাদে আজ পূর্ণচাঁদ। 

সংক্রান্তি

শামস আল মমীন লিখিয়াছেন, “আমার সাথে আধুনিক বাংলা কবিতার পরিচয় শামসুর রাহমানের ‘রৌদ্র করোটিতে’ পড়ে।” তিনি আরো জানাইয়াছেন, “১৯৭৬ সালের দিকে বইটি কিনেছিলাম কমলাপুর স্টেশনের প্লাটফরম থেকে। আর তখন থেকেই এই নতুন কবিতার নির্মাণ কৌশল আমার মাথার ভিতর যায় আসে, আসে যায়।”  কথাটা ষোল আনা খাঁটি। তিনি ইচ্ছা করিলে একথাও লিখিতে পারিতেন, “আমার সহিত আমার পরিচয় শামসুর রাহমানের মধ্যস্থতায়”। শুদ্ধ শামসুর রাহমান কেন, আল মাহমুদও হাজির আছেন আল মমীনের আত্মচরিতে। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ যে মিলিত হইয়াছেন শামস আল মমীন নামের মধ্যে তাহা একান্ত অকারণ নহে। মুম্বাইয়ের অদূরে স্থিত সালসেত মন্দিরের পুরোহিতের মতন মৃত মানুষের রোদে পোড়া খুলি কিংবা ‘রৌদ্র করোটিতে’ ঢালিয়া কারণ পান করিয়াছেন তিনি।

একদিকে তিনি দুই কবির গোড়ালি স্পর্শ করিয়াছেন, আর একদিকে নতুন দিগন্তের দিকে পা ফেলিয়াছেন যে দিগন্তে অন্য কবির পা পড়ে নাই। ‘কেউ যাহা কহে নাই, কোন এক বাণী, আমি বহে আনি।’ শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ, রফিক আজাদ আর মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ আর আবুল হাসান কিংবা অন্য কোন কবির পা সেখানে পড়ে নাই। আল মমীনের সঙ্গে কোথায়ও কোথায়ও তাঁহার গলায় গলায় ভাব। তবে তিনি অন্য সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। কোথায়ও বা তাঁহাদের-বাংলাদেশের কবিদের-মুকুটে নতুন একটি পালক গুঁজিয়া দিয়াছেন। আর মাত্র একটি কবিতার দেহ উদ্ধার করিয়াই আজ এই উদ্ধৃতি-কণ্টকিত নিবন্ধের উপসংহার করিতে হইবে আমাকে। কবিতার নাম ‘কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা’।

দূর গাঁও থেকে আসে বড় বুবু। ঠেলে কাঠখড়ি, চাখে নুন

মসলার ঘ্রাণ। তুষের ছিটায় ফুঁসে ওঠে আগুনের ফুলকি। 

কলতলে ভিড়। প্রায় ডজন ফকির করে নবীর জিকির।

লেপা ঘরবাড়ি, নিকানো উঠান, ওড়ে মিহি গোবরের ঘ্রাণ।

ভিতর-কোঠায় সখিদের ঢলাঢলি। মায়ের পরান বোঝে

অনিষ্টের ধ্বনি। খানকায় পানদানি। ভাবী কুটুমের ঝাঁক

বাউল্যার মতো আসে মাগরেব বাদ। পড়শীর চোখ উঁচা,

কুটনির কান খাড়া। হ্যাজাকের আলো তাড়া করে

অন্ধকার। ও বাড়ির বাউদিয়া হাট থেকে ফিরে, মাগুরের 

লেজ নড়ে ছাতার আগায়। ঝাঁপির মাছের মতো যাচে চোখ 

নাক, কোমরের বাঁক। রূপের ভিতর খোঁজে কেউ কত আনা

মুসলমানি। পানের কষে ভেজা ঠোঁট হাসে, বলে, ‘মেয়ে নয়

যেন পরী, সামান্য এ দাবী, সোনা সাত ভরি।’ মাঘের বাতাসে

কাঁপে বাঘ, বনবীথি, ঘামে ভেজে একা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। 

আগেই বলিয়াছি, শামস আল মমীন বাংলা কবিতার অভিজ্ঞতা প্রসারিত করিয়াছেন। সৌভাগ্যের মধ্যে, এখনও করিতেছেন তিনি। এই অভিজ্ঞতা কতটুকু অভিজ্ঞানে পরিণত হইয়াছে তাহা দেখিবার অবকাশ আমার এখন পর্যন্ত হয় নাই। শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ প্রভৃতি কবি যৌবনেই কাব্যসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন, লাভ করিয়াছিলেন সামাজিক স্বীকৃতি, এমনকি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও। ১৯৭৯ সালে ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত সমাজ ঘটা করিয়া শামসুর রাহমানের পঞ্চাশ বছরপূর্তি পালন করিয়াছিলেন। আল মমীনের বয়স এতদিনে পঁয়ষট্টি ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তাঁহার ভাগ্যে-অন্তত আজ পর্যন্ত-তেমন কিছু সংবর্ধনা জোটে নাই। এই না জোটার দুর্ভাগ্য তাঁহার নিজের নয়-আমাদের সমাজ চুত্তির। এই সমাজের শ্বাসকষ্ট চলিতেছে। তাঁহার কবিতার ভালোমন্দ লইয়া কোন কবি কিংবা সমালোচক কি আজ পর্যন্ত শুনিবার মতো পাঁচ কথা লিখিয়াছেন? তাঁহারা কি জিজ্ঞাসা করিয়াছেন কোথায় এই কবির নতুনত্ব? আমার কানে অন্তত সেই অমৃতবাণী পশে নাই। আরেকবার আহমদ ছফার শরণ লওয়া যাইতে পারে : “সমাজের ভালো কাজ করলে কেউ যখন তারিফ করে না, খারাপ কাজ করলে কেউ যখন নিন্দা করে না, তখন সমাজের শ্বাসকষ্ট চলতে থাকে। এই অবস্থাটিকে খুব সহজ কথায় অবক্ষয় বলা যেতে পারে।” 

সত্যের খাতিরে বলিতে হইবে, আহমদ ছফা যাহাকে বলিয়াছিলেন ‘অবক্ষয়’, এদেশের শাসক শ্রেণী আজ তাহাকেই ‘উন্নয়ন’ বলিতেছেন। এই উন্নয়নের সূত্রপাত ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে। তখন তাঁহাদের ব্যবহৃত শব্দটা ছিল ‘উন্নতি’। পাকিস্তানী জমানায় ‘উন্নয়ন’ শব্দটা চালু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে আর নতুন কিছু ঘটে নাই। এই উন্নয়ন সেই উন্নয়নই। মামলাটা মাত্র পরিমাণের, অনুপানের-মোটেও গুণের নহে। যাহা সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছিষ্ট তাহাই সর্বোচ্চ সোপানে পৌঁছিয়াছে বাংলাদেশে। আমরা যাহা হইয়াছি তাহার নাম উপনিবেশ নয়, পরের নিবেশ-তাহা অপরের অধীন নয়, পরমের অধীন। এই অবক্ষয়ের (বা উন্নয়নের) যুগেই একদা শামসুর রাহমানের আবির্ভাব ঘটিয়াছিল। শামসুর রাহমানের দ্বিতীয় এবং-সৈয়দ আবুল মকসুদের বিচারে ‘শ্রেষ্ঠ’-কবিতার বই ‘রৌদ্র করোটিতে’ প্রকাশ করিয়াছিলেন পাকিস্তানের শাসক আইয়ুব খান প্রতিষ্ঠিত লেখক সংঘ বা রাইটার্স গিল্ড। এই বইয়ের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার পাইয়াছিলেন ১৯৬৩ সালে। পুরস্কারের কথা বলিতে ব্যাকুল হইলেও রাহমান কোনদিন সেই বইয়ের প্রকাশক বা পৃষ্ঠপোষকের নাম ভুলেও মুখে আনেন নাই। কারণ তিনি জানিতেন-সৈয়দ আবুল মকসুদের তুলনায় ভালো জানিতেন-কাজটি অমর্যাদাকর।

‘কালের ধুলোয় লেখা’ নামধেয় স্মৃতিকথায় শামসুর রাহমান লিখিয়াছেন, “পুরস্কারটি গ্রহণ করতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হাত থেকে যাঁর বিরুদ্ধে ‘হাতির শুঁড়’ কবিতাটি লিখেছিলাম। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমাদের বসতে হয়েছিল একেবারে প্রেসিডেন্টের পাশে। কথা প্রসঙ্গে আইয়ুব খান আমাকে আমার বইয়ের নাম এবং তার অর্থ অনুবাদ করতে বললেন। আমি নির্দ্বিধায় বললাম, ‘সানরেইস অন দ্য স্কাল’। সেই মুহূর্তে আমার মুখে “রৌদ্র করোটিতে” [কথাটার] ইংরেজি এ রকমই এসেছিল। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব মৃদু হাসলেন।’  এই স্বীকারোক্তি শামসুর রাহমানের সাহসী চরিত্রের পরিচায়ক। সৈয়দ আবুল মকসুদ জানাইতেছেন, “শামসুর রাহমান তাঁর স্মৃতিকথায় বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন, [তাতে] লেখক সংঘ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য নেই, যদিও লেখক সংঘের পরিক্রম [পত্রিকার] তিনি ছিলেন নিয়মিত লেখক এবং সেখান থেকে লেখার জন্য সম্মানী পেতেন। লেখক সংঘের বর্ধমান হাউসের ছোট্ট ঘরের আড্ডায়ও তিনি যোগ দিতেন।” 

সৈয়দ মকসুদের বৃত্তান্ত পড়িয়া জানিতে পারিলাম, পাকিস্তান লেখক সংঘ [পূর্বাঞ্চল শাখা]-অন্যান্য কাজের মধ্যে-পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা, গল্প, ও প্রবন্ধের গোটা তিনটি সংগ্রহ প্রকাশের একটি প্রকল্পও হাতে নিয়াছিলেন। কবিতা, গল্প, ও প্রবন্ধ সংকলন তিনটি যথাক্রমে সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন শামসুর রাহমান, মুনীর চৌধুরী এবং আহমদ শরীফ। আবুল মকসুদ পুনশ্চ টুকিয়া রাখিয়াছেন: “লেখক সংঘে জড়িত থাকার কথা শামসুর রাহমানের কোন স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায় না।” এই অকরুণ ইতিহাস ব্যবসায়ীর মন্তব্য পড়িলে করুণাই হয়: “লেখক সংঘে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা আমাদের সাহিত্যের উপকার করেছেন। বাংলাদেশ ও বাঙালির তাতে কোন ক্ষতি হয়নি [কথাটা সত্য নয়]। আইয়ুব সরকারের প্রশংসা করে প্রচারণাও সেখান থেকে হয়নি [কথাটা মোটেও সত্য নয়]। কিন্তু লেখক সংঘের সঙ্গে জড়িত থাকাকে স্বাধীনতার পরে কেন তাঁরা অমর্যাদাকর মনে করেছেন তা বোধগম্য নয়।’ 

সৈয়দ মকসুদের যাহা ২০১৯ সালেও বোধগম্য হইল না তাহা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে-১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে-আহমদ ছফা একটি দৈনিক পত্রিকায় চাঁছাছোলা ভাষায় লিখিয়াছিলেন : “লেখক সংঘ মানে লেখকরা কি ভাববেন, কি চিন্তা করবেন, কি লিখবেন, কিভাবে লিখবেন, জঙ্গীলাট নির্দিষ্ট করে দেবেন। তিনি যা বললেন-এঁরা তা লিখবেন। বিনিময়ে লেখকদের দেয়া হলো অঢেল সুযোগ-সুবিধে। তাঁদের জন্য আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন, ঘন ঘন বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সেদিন বাংলাদেশে একজন লেখকও লেখকের সুস্থ এবং স্বাধীন মননশীলতার বিরোধী এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করেননি। বরং সকলে বগল বাজিয়ে আপনা থেকেই এগিয়ে এসে অংশগ্রহণ করেছেন।”  শামসুর রাহমান ছিলেন এই সর্বজনীন নিয়মেরই অধীন, ব্যতিক্রম ছিলেন না তিনি। তিনি হয়তো জানিতেন, আমগাছে কাঁঠাল আশা করা বাতুলতা।

আজ বাংলাদেশেও নতুন নতুন নামে আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার ইত্যাদির মতো উপস্থের ব্যবস্থা হইতেছে, সুযোগ-সুবিধার বিলিবণ্টন হইতেছে অঢেল। সেদিন পূর্ব বাংলা ছিল পরাধীন জাতির আবাসভূমি। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন, আমাদের নতুন উপাধি জুটিয়াছে সার্বভৌম অর্থাৎ আমরা এখন আর পরাধীন নই, আমরা বিশ্বজনীন। বিশ্বজনীন হওয়া মানেই কিন্তু স্বাধীন হওয়া নয়। আমরা কিছু স্বাধীনতা বিসর্জন অর্জন করিয়াছি, কিছু স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়াছি। দিতে বাধ্য হইয়াছি। সান্ত্বনার মধ্যে, উত্তর আমেরিকার গতরে-খাটা, খাইয়া-পরিয়া-বাঁচিয়া-থাকা গতরজীবী সমাজে বাংলা কবিতার দুই একটি ব্রত বা পাপড়ি গজাইতেছে। শামস আল মমীন-মানে ‘বিশ্বাসীর সূর্য’-পশ্চিমদিকে উঠিতেছেন। ফরাশি মনীষী জাক লাকাঁ যে এক জায়গায় কহিয়াছেন ‘ভালোবাসা মানে রৌদ্রালোকে হাস্যোজ্জ্বল একখণ্ড নুড়ি’-তাহা হয়তো অকারণ নয়। 

ভালোবাসা থাকিলে সূর্য পশ্চিমেও ওঠে। 

ঢাকা, ২৫ বৈশাখ ১৪৩০

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh