তাহজীব আহমেদ
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪, ০৬:১৯ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৪, ০৬:২৩ পিএম
মকবুল ফিদা হুসেন ও মাধুরী দীক্ষিত। ছবি: সংগৃহীত
একজন চিত্রশিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে আমার আপনার সাধারণ মানুষের কল্পনার জগৎকে প্রকাশ করে থাকেন তার তুলির আঁচড়ে নানা রঙের মিশ্রণে দুরন্তপনা মনের হাজারো আকুতি নিয়ে। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে গ্রিক সভ্যতা থেকে শুরু করে আজ অবধি এমন অসংখ্য চিত্রশিল্পী নানান বিষয় নিয়ে এঁকেছেন নানান রকমের চিত্র। কখনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গতি-অসঙ্গতি, আবার মানুষের হৃদয়ের রিক্ততা-শূন্যতা কিংবা ঝড় তোলা মনের হাহাকার অথবা পাওয়া না পাওয়ার বেদনার্ত হিসেবের সমীকরণের সরল বা বক্ররেখায় তুলে ধরেছেন মনের ক্যানভাসের বিচিত্র নানা কথা। কাউকে যদি বিশ্ববিখ্যাত গোটা কয়েক শিল্পীর নাম জিজ্ঞেস করা হয়, হয়তো নিঃসন্দেহে আওড়াবেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভ্যান গগ কিংবা পাবলো পিকাসোর কথা; কিন্তু আমাদের উপমহাদেশেও এমন অনেকেই রয়েছেন যাদের নিভৃতচারী পথচলায় এ মুহূর্তে হয়তো তাদের কারও নাম বিস্মৃতিতে তলিয়ে গেছে। আর এমন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর কথাই আজ তুলে ধরব।
নারীর কোমল হৃদয়ের নানান দিক নিয়ে যার ক্যানভাসে উঠে এসেছে অদ্ভুত রকমের সব চিত্রকর্ম। যাকে তার নিজ দেশেই বলা হয়ে থাকে আরেক পাবলো পিকাসো। যার হাতেখড়ি বাণিজ্যিক ছবির পোস্টার আঁকার মধ্য দিয়ে, এ পর্যন্ত তার ৬০ হাজারেরও বেশি চিত্রকর্ম রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তার চিত্রকর্মকে অনেক বোদ্ধাই বলে থাকেন ‘সৌভাগ্যের প্রতীক’। আজও যার অসাধারণ সব কর্ম বিক্রি হচ্ছে কয়েক মিলিয়ন ডলারে। যার একটি ছবি কোনো আর্ট গ্যালারির সংগ্রহে রাখার অর্থ হলো-বিরল সম্মানের ছোঁয়া লাগানো সেই গ্যালারির পলেস্তরে, এমন একজন শিল্পীর নাম চট করেই মনে না আসলেও বলার পরক্ষণেই আমার-আপনার নিউরন ঠিক বলে ফেলবে-‘ও হ্যাঁ, তাকে তো জানি!’ বলছিলাম ভারতের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের কথা। সংক্ষেপে যিনি এম এফ হুসেন নামে পরিচিত। এতটাই বর্ণিল তার সৃষ্টিকর্ম যে সামান্য কিছু বাক্য ব্যয়ে ছোট্ট এই লেখার ফ্রেমে তার পুরো জীবনের কর্মযজ্ঞ তুলে ধরা অসম্ভব। নানা জীবন দর্শন, নানা ভিত্তির ওপর রচিত হয়েছে তার অসামান্য সব চিত্রকর্ম।
দেশ বিভাগের সমসাময়িক সময়ে শিল্পকলায় জাতীয়তাবাদের মতাদর্শের সংকীর্ণ পরিসর ভেঙে আন্তর্জাতিকতার বিশালতা খুঁজতে চল্লিশের দশকের শুরুতে যেসব নবীন সম্ভাবনাময় শিল্পীরা এগিয়ে এসেছিলেন, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালে সাও পাওলো বিয়েনালে শিল্পী পাবলো পিকাসোর সঙ্গে শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনকেও বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়।
ক্যানভাসের মাধ্যমে নিজের দর্শন তুলে ধরার পাশাপাশি পোস্টার, ম্যাগনেটস ও কোস্টার আকারে তার আঁকা নানা কাজ আজও বিশ্ববাসীর কাছে সমাদৃত ও আলোড়িত। রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে ব্রিটিশ-শাসিত উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটসহ ভারতের নগর ও গ্রামীণ জনপদের কথা উঠে এসেছে তার চিত্রকর্মে। হুসেনকে নিয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অ্যাঞ্জোলি ইলা এভাবেই বর্ণনা করেছেন, “ÒUndoubtedly the megastar whose persona, performance, and productivity all combine to make him the mighty ‘M’.” তার আঁকা উল্লেখযোগ্য ও কালজয়ী চিত্রকর্মের মধ্যে ‘ভারত মাতা’ অন্যতম। মায়ের মুখ খুঁজতে গিয়েই বোধ করি হুসেন সৃষ্টি করেছেন মাদার তেরেসার উপরে আঁকা সিরিজগুলো। মহাত্মা গান্ধীর জীবনী এঁকেও কুড়িয়েছেন প্রশংসা। অন্যান্য শিল্পকর্মের মধ্যে ‘অভিসারিকা’ ও ‘গণেশ’ ছিল অন্যতম।
১৯১৫ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের পাণ্ডারপুরে এক মুসলিম পরিবারে হুসেনের জন্ম। তার প্রাথমিক স্কুলজীবন কেটেছে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। যদিও এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ‘সানডে টাইমস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘I was fond of drawing since childhood. I never threw tantrums for anything else apart from eraser, pencil, paint and brush. I used to draw on every possible empty space. My relatives gave up on me.’ পরবর্তীকালে ১৯৩৫ সালে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) পাড়ি জমান। আর সেখানেই যৎসামান্য মজুরিতে হিন্দি ছবির পোস্টার, বিলবোর্ডসহ অন্য নানা বিষয় নিয়ে আঁকার কাজ শুরু করেন। আর তার এ বিষয়টি নিয়ে বিবিসির এক নিবন্ধে এক প্রাবন্ধিক লিখেছিলেন, ‘Working on billboards and hoardings helped him paint using bold lines and deep colours on large canvases when he turned to painting murals and large works of art. He embraced the street around him, living in bazaar lanes where prostitutes and street vendors peddled their wares.’
সম্ভবত হুসেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি কিনা সিনেমার পোস্টার আঁকা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে চিত্রকর্ম এঁকে বিশ্বে ফেলে দিয়েছিলেন হৈচৈ। এভাবেই একের পর এক আঁকা তার অনবদ্য সব সৃষ্টির বদৌলতে ১৯৪০ সালে তাকে ‘ভারতের পাবলো পিকাসো’ হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
তার কর্মের বড় এক অংশ জুড়েই ছিল বলিউড। হবেই বা না কেন-যেখানে বাণিজ্যিক ছবির পোস্টার আঁকিয়েই তার কর্মজীবন শুরু, সেখানে বলিউডের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা থাকাটা খুব স্বাভাবিক। বলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি আঁকায় তার ছিল বিশেষ উৎসাহ। এ ছাড়াও হিন্দু দেবদেবী, গাড়ি-ঘোড়া, জীব-জন্তু ও নানা পদের বাড়িঘরের ছবি আঁকাই ছিল পরম নেশা। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের সময় তিনি ‘প্রগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপ’ নামে একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন। হুসেন মূলত পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন করা যায় কীভাবে সে দিকটাতেই বেশি নজর দিতেন তার চিত্রকর্মের মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়েই অসামান্য সব ইউনিক চিত্রকর্মের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি।
দুবাইভিত্তিক বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘দ্য ন্যাশনাল’ তাকে নিয়ে বলেছিল, ‘Husain was above all a figure who radically changed contemporary painting in India. He was unafraid to probe the issues that were boiling up as his country underwent its various transformations.’ ১৯৬৭ সালে তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘থ্রু দ্য আইস অব এ পেইন্টার’ জিতে নিয়েছিলেন বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কার। এরপর ‘গজগামিনী’তে মাধুরী দীক্ষিতকে আমরা পাই, সেটির প্রধান চরিত্রে। সেই শাশ্বত প্রেমিকার চরিত্র, যাকে দেখে কালিদাস রচনা করেন শকুন্তলা আর ভিঞ্চি এঁকেছিলেন মোনালিসা।
এম এফ হুসেন ছিলেন প্রেমিক। তার মতে, একজন শিল্পী তার কর্মে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে যতক্ষণ না প্রেমের মাধুর্যে নিজেকে বিমোহিত করতে না পারে। এমন দর্শন থেকেই হয়তো বা হুসেনের জীবনেও প্রেম উঁকি দিয়েছিল একবার নয় অজস্রবার। নারী-পুরুষ জীবনে
প্রাকৃতিক এক চাহিদা ও জৈবিক আকর্ষণ মকবুলের প্রথম জীবন নারীর প্রশ্রয় থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু প্রৌঢ় বয়সে অনেক তরুণী ছায়ার মতো তাকে ঘিরেই কল্পনার জাল বুনত। হুসেন তার বিয়ে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি যখন সিনেমার বিলবোর্ড, ব্যানার আঁকতাম, আর রাতে ফুটপাতে শুয়ে থাকতাম, (১৯৪১ সাল) তখন আমার হবু-শাশুড়ির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমি যেখানটায় কাজ করতাম তার পাশের বিল্ডিংযে তিনি থাকতেন। বিধবা। আর সেখানে যাওয়া-আসার সুবাদেই একদিন তার মেয়ে ফাজিলার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়।’ ফাজিলা বিবির ঘরে হুসেনের ৬ সন্তান। বাউণ্ডুলে শিল্পীমন ঘর-সংসারের বেড়াজাল এড়িয়ে চলতেন। থাকতেন নিজের ভুবন নিয়ে। হুসেনের জীবনে এসেছিল নানা বর্ণের উচ্ছলতা নিয়ে নানা বয়সী নারী। যাদের প্রতি অমোঘ আকর্ষণে নিজেকে হারিয়েছেন বারংবার। ইলা পাল ছিলেন হুসেনের বান্ধবী ও ছবির ছাত্রী। তার সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়লে মকবুল তাকে দেখতে হাসপাতালে গেলে সেখানেই ঘটনাক্রমে ‘পাকিজা’ সিনেমার নায়িকা মীনা কুমারীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। হুসেনের গলার আওয়াজটা অনেক নারীর কাছেই আকর্ষণীয়। তার গলার আওয়াজে আর চেহারায় মীনা কুমারী মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু লাজুক প্রকৃতির হওয়ায় হুসেন কোনো বাক্যবিনিময় করেননি। পরবর্তী সময়ে হুসেনের ওপর লেখা একটা বইতে ইলা (Husain: Portrait of an artist) জিজ্ঞেস করেছিলেন, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন কথা বলেননি। হুসেন উত্তরে বলেছিলেন, ‘তিনি এমন করে আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন যে আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
১৯৫৫ সালে হুসেনের শক্তিশালী একটি ছবি ‘জমিন’ ললিতকলা একাডেমিতে জাতীয় পুরস্কার জিতে নেয় এবং পরের বছর প্রাগে (Prague) আরও একটি একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় সেটির ওপরেই। হুসেন ১৯৫৫ সালেই অর্জন করে নিয়েছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার পদ্মশ্রী। এ ছাড়াও তার কাজের অনন্য স্বীকৃতি হিসেবে জিতে নেন পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ। ১৯৫৬ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় (Czechoslovakia) হুসেনের ৩৪টি শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীটির এক সন্ধ্যায় মকবুল লক্ষ্য করলেন, এক তরুণী গভীর মনোযোগে তার আঁকা চিত্রগুলো দেখছেন। উৎসাহী হয়ে মকবুল হাসি মুখে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। কোনো কথা, পরিচয় ছাড়াই শুধু ওই নারীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে ৩৪টি ছবি উপহার দেওয়ার প্রস্তাব দেন। বিস্মিত হয়ে ওই নারী মকবুলের দাড়ির প্রশংসা করে বলেন, ‘আপনাকে একজন ভারতীয় শিল্পীর মতোই লাগে।’ সেই নারীর নাম মারিয়া জুরকোভা। মারিয়া ধর্মতত্ত্বের একজন স্কলার এবং ভাষাতত্ত্ববিদ ছাড়াও হিন্দু দর্শনে অধ্যয়নরত ছিলেন। তিনি ছবি ভাস্কর্য সম্পর্কে খুব আগ্রহী ছিলেন। গ্যালারির কাছেই একটি নারী সন্ন্যাসীদের মঠে নান (Nun) হিসেবে থাকতেন।
পরবর্তী সময় মারিয়াকে বিয়ের প্রস্তাবও দেন হুসেন। প্রদর্শনী শেষে প্রাগে থাকার সময় তার গাইড, সহচর এবং দোভাষী হয়েছিলেন। হুসেন বলেন, তার কাছ থেকে তিনি পশ্চিমের মানসিকতা বুঝতে এবং তাদের প্রশংসা করতে শিখেছিলেন। হুসেন একবার বলেছিলেন, ‘আমরা প্রাগের রাস্তায় হেঁটেছি, যেন স্বপ্নে। আমি তার সঙ্গে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণের দর্শনের কথা বলতাম এবং সে কাফকার বিষয়ে কথা বলত।’ যদিও ঘটনাক্রমে তাদের বিয়ে আর আলোর মুখ দেখেনি। আর হুসেন তার জীবনের এই গল্পের একটি অংশ তার চলচ্চিত্র ‘মীনাক্ষী : এ টেল অব থ্রি সিটি’তে চিত্রায়ণ করেছিলেন। মারিয়ার চরিত্রে টাবুকে দিয়ে অভিনয় করান এবং মারিয়াকে চলচ্চিত্রটি দেখার অনুরোধও করেন হুসেন।
এভাবেই নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে আরেক দর্শন ও বোধ থেকে হুসেনের জীবনে আসে রাশদা সিদ্দিকী নামের আর্ট কলেজের এক ছাত্রী। লখনৌতে স্থানীয় আর্ট কলেজের ছাত্রী ছিলেন। যাকে নিয়ে একশরও বেশি ছবি আঁকেন হুসেন। রাশদা খবরের কাগজ থেকে হুসেনের প্রকাশিত ছবি ভাস্কর্যের খবর কেটে রাখতেন, আর মনে মনে তাকে কল্পনা করতেন তার প্রিয়জন হিসেবে। আকবর হোটেলে আবার দেখা হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাকে হুসেন ছবি আঁকা শেখাবেন কি না। এভাবে পরিচয় ও প্রেম পরিণতির দিকে এগিয়েছিল। উচ্চবিত্ত শিল্পপতি নারীরা হুসেনকে নিয়ে অনেক উৎসাহী ছিলেন। হুসেনের ছবির কদর তাদের কাছে ছিল বেশি। প্রেম মুদ্রার মতো দুটি পিঠ, একদিকে স্বর্গ অন্যদিকে নরক। হুসেনের নারীরা বা হুসেন-কেউই ভুল করেনি বলেই তারা আজ গৌরবের অধিকারী।
হুসেনের জীবনের অন্যতম টুইস্ট হয়তো ছিল বলিউডের ধক্ ধক্ কন্যা মাধুরী দীক্ষিতের আবির্ভাবের বিষয়টি। মাধুরীর ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ ছবিটি মুক্তির পর সেটি হুসেন ৯৫ বার দেখেন। এই সুপারহিট ছবিতে মাধুরী উচ্ছল তরুণী নিশার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তিনি পর্দায় নিশার ভূমিকায় মাধুরীকে দেখে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, মুম্বাইয়ের লিবার্টি সিনেমা হলের নির্দিষ্ট আসন তার জন্য বুকড করা থাকত। মাধুরীর ‘আজা নাচলে’ দেখার জন্য পুরো প্রেক্ষাগৃহটি ভাড়া করেছিলেন। তার প্রিয়দের তালিকায় ছিলেন মাধুরী, উর্মিলা মার্তন্ডকার, অমৃতা রাও, বিদ্যা বালান, আনুশকা শর্মা, সুস্মিতা সেন, টাবু।
এফএম হুসেন সিনেমার অনেক নায়িকার ছবি ৮-১০ বার করে দেখতেন ও তাদের দিয়ে কিছু সিনেমা করার প্রস্তাবও দিতেন। সুস্মিতা সেনকে বলেছিলেন তাকে দিয়ে একটি সিনেমা বানাবেন ‘দো কদম চালকে দেখো’। আর বিদ্যা বালানকে নগ্ন করে একটা পেইন্টিং করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। অবশ্য বিদ্যা সেটা প্রত্যাখ্যান করেন; কিন্তু ঘুরেফিরে যেন প্রৌঢ় বয়সে এসে আটকে যান মাধুরীর উষ্ণতা খুঁজতেই। পরবর্তীকালে তার অন্তর্নিহিত ভালোবাসার রুপালি উন্মোচন ঘটান মাধুরীকে নিয়ে ‘গজগামিনী’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। যদিও ব্যবসা সফল হয়নি চলচ্চিত্রটি; কিন্তু অসম্ভব সুখানুভব করেছিলেন অন্তত নীরবে ভালোবেসে যাওয়া তার মহানায়িকার দৃশ্যমান উপস্থিতিতে। শুটিংয়ের সময়কার স্মৃতিকথায় একবার মাধুরী বলেন, ‘ফিদা হুসেনকে প্রায়শই স্পটে পেতাম না। জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অবশ্য বলতেন-আমি তো ছিলাম, খুঁজে নিলেই হয়।’
হুসেনের জীবনে যত নারী এসেছেন তাদের মধ্যে অদৃশ্য কিংবা দৃশ্যমান সর্বোচ্চ ভালোবাসার প্রকাশ যেন মাধুরীর বেলাতেই ছিল অন্যমাত্রার। তার কাছে সৌন্দর্য কিংবা প্রেমের সংজ্ঞার সকল পূর্ণতা ছিল যেন মাধুরীকে নিয়েই। যার ছোঁয়া নানা সৃষ্টিকর্মে তিনি রেখে গেছেন জীবন সায়াহ্নে এসেও। মাধুরী ম্যাজিকে বুঁদ ছিল বলিউডের আশি ও নব্বইয়ের দশক। আর একই পথেই বিশ্বমানের চিত্রশিল্পী এম এফ হুসেনও হেঁটেছিলেন ভালোবাসায় জমে থাকতে। বয়স আশির কোঠায় গিয়ে এই শিল্পী মাধুরীর প্রেমে এতটাই মোহিত ছিলেন যে, নিজের নাম থেকে পোশাক, সবই পাল্টে ফেলেছিলেন! এমনকি মাধুরীর জন্য তাকে যেতে হয়েছিল হাসপাতালেও। জীবনের এ পর্যায়ে এসে এমন প্রেমে পাগল হওয়ার ঘটনা বিরল। সে সময় মাধুরীর ছিল ২৭ আর হুসেনের ৭৯।
মাধুরীর সৌন্দর্য ও হাসিতে ‘অবসেসড’ চিত্রশিল্পী ঠিক করলেন তার সঙ্গে দেখা করবেন। মাধুরীর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাতের সময় ঠিক হলো। নিজের হাতে মাধুরীর প্রিয় বিরিয়ানি রান্না করে হুসেন মার্সিডিজ চালিয়ে পৌঁছান নায়িকার বাড়িতে। সে দিন মাধুরীর পরিবারের সবার সঙ্গে হুসেনও জমিয়ে বিরিয়ানি খেয়েছিলেন। মাধুরীর ছবির সেটে প্রায়ই হাজির থাকতেন হুসেন। বলা যায়, মাধুরীকে নিজের জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল মাধুরীর ছবি ‘মহব্বত’। ছবির প্রযোজক ছিলেন মাধুরীর সেক্রেটারি রাকেশ নাথ। পরিচালক ছিলেন রাকেশ নাথের স্ত্রী রিমা। সেই ছবির সেটেও ছিলেন এম এফ হুসেন।
অবশ্য হুসেনের মাধুরী প্রেম নিয়ে চিত্রগ্রাহক মনোজ কুমার খাতৈ ইন্ডিয়া টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি এখন বুঝি কেন মাধুরীর বিষয়ে যত্নশীল ছিলেন হুসেন। তার সৌন্দর্য ও অভিনয় দক্ষতার প্রতি বিমোহিত হয়ে না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক। যদিও অনেকে এই সম্পর্কের মধ্যে রহস্যের সন্ধান করেছেন। ফিদা আর মাধুরী দুজনই সবসময় তাদের এই সম্পর্ককে বলেছেন, শিল্পীর প্রতি শিল্পীর ভালোবাসা। ফিদা নির্মিত ‘গজগামিনী’ ছবি নির্মাণের পরিকল্পনাও নাকি করেছিলেন মাধুরী, যা তিনি নিজেই অবশ্য অনেক গণমাধ্যমে পরবর্তী সময় বলেছিলেন।
২০১১-এর ৯ জুন লন্ডনে ৯৫ বছর বয়সী ফিদা মকবুল হুসেনের মৃত্যুর পর তার অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর মতোই মাধুরীও শোকাহত হয়ে পড়েন। ফিদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সেসময় মাধুরী বলেছিলেন, হুসেনের মন সর্বদাই উত্তেজনা ও প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরপুর থাকত। এই মহান চিত্রকর বলিউডের ছবি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। ভারতীয় সিনেমাকে ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার ছিল গভীর আকাঙ্ক্ষা। মৃত্যুর মাত্র এক মাস আগে তার সঙ্গে মাধুরীর দেখা হয়েছিল। সে সময় ফিদা ভারতে ফিরে আসার প্রতি তার একান্ত ইচ্ছের কথা মাধুরীকে জানিয়েছিলেন। শিল্পী তাকে বলেছিলেন, ‘ভারতের মাটিতে মারা গেলে আমি সুখ পাব।’ কিন্তু দুঃখজনক হলো, তিনি ভারতে ফিরতে পারেননি।
ফিদার সঙ্গে দেখা হওয়ার সর্বশেষ স্মৃতি মনে করে মাধুরী বলেন, ভারতীয় সিনেমার শতবর্ষ পূর্তিতে খুবই পুলকিত ছিলেন ফিদা। তার কাছে অবসর বলে কিছু ছিল না। মাধুরী তার এই প্রিয় মানুষকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘তিনি আমার জন্য ভীষণ গর্বের বিষয়। তিনি আমার জীবনের এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি আমার জীবনে ভিন্নতার স্বাদ দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে আমার বাড়িতে ফিদা সাহেব ঘরের মানুষের মতোই আপন ছিলেন। এমনকি আমার সন্তানদের কাছেও তিনি ছিলেন প্রিয়। গজগামিনী ছবিটির প্রতিটি দৃশ্যই তিনি চিত্রকর হিসেবে ফ্রেমের মতো সাজিয়ে আমার সামনে উপস্থাপন করেছেন। তিনি আমার সকল সরলতা এবং আকর্ষণ কাজে লাগিয়ে ছবিটিতে নারীত্বের প্রতিকৃতি আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। আমি জানি না তার চাওয়ার কতটুকু আমি পূর্ণ করতে পেরেছি। তবে তিনি আমাকে নিয়ে নতুন একটি ছবি নির্মাণের চিন্তা করেছিলেন বলে আমি জানতে পেরেছি। এখানেই আমার সার্থকতা।’
তবে বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে থাকাই ছিল হুসেনের আজন্ম স্বভাব। ভয় নয়, ভালোবাসতেন বিতর্ককে, ভালোবাসতেন সমালোচনার মুখোমুখি হতে। এমনকি ১৯৯৬ সালে দেবী সরস্বতীর একটি নগ্ন ছবি আঁকায় তাকে নিয়ে শুরু হয় চরম বিতর্ক। আর তার সৃষ্ট ‘ভারত মাতা’ চিত্রকর্মের জন্য শুনতে হয়েছিল নানান কথা।
নিজভূমি ভারত থেকে বহুদূরে লন্ডনে ২০১১ সালের ৯ জুনে, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের অসাধারণ আর বর্ণিল জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ৯২ বছর বয়সে তাকে দেওয়া কেরালা সরকারের ‘রাজা রবি বর্মা পুরস্কার’ নিয়েও বেশ প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ভারতজুড়ে। তথাপি নিজস্ব মহিমায় ভাস্বর শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন সফল হয়েছিলেন স্বতন্ত্র একটি জীবনধারাবোধ গড়ে তুলতে। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লম্বা তুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। যেমনটা ফরাসি শিল্পী অঁরি মাতিস তার লম্বা লাঠির ডগা দিয়ে শিল্প জগতে রাজত্ব করতেন, বা স্প্যানিশ পরাবাস্তব শিল্পের ক্ষ্যাপা রাজা শিল্পী সালভাদর দালিও তার জাদুর কাঠির লম্বা তুলি নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বিশ্বময়।
ফিদা হুসেন এমন একজন শিল্পী যিনি শুধু নিজের শিল্পকর্মে মাধ্যমেই পরিচিত হননি সারা বিশ্বে, তার জীবনজুড়ে রয়েছে অসীম সাহসিকতার ইতিহাস। শিল্পীরূপে একজন চিরায়িত প্রেমিকের স্বরূপ আবার কখনো এক মাতৃহারা শিশু কিংবা সুতীব্র আবেগময় দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করিয়েছেন বিশ্বব্যাপী। তিনি আধুনিক শিল্পকলার জগতে ভারতের নাম চিরস্থায়ী করেছেন, আর তাকেই মৃত্যুবরণ করতে হলো স্বদেশ ছেড়ে বহু দূর প্রবাসভূমে। ফিদা হুসেন একদা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ বেঁধে রাখতে পারবে না, আমি কালই ফিরে যেতে পারব, কিন্তু জানবেন, আমি যেখানেই যাই না কেন প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক বা কাতার, আমি চিরকাল এক ভারতীয় শিল্পী হয়েই থাকব।’