আকবর বাদশাহর সকাল-সন্ধ্যা

শেখ লুৎফর

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪, ০৬:৫৪ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৪, ০৬:৫৮ পিএম

গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল

গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল

ব্যাংকের কর্মজীবী হলেও আফজল সাহেবের মনটা আকবর বাদশাহর মতো। বয়স আটত্রিশ। এক ছেলে, সুন্দরী স্ত্রী ও গোছানো একটা সংসারে কর্তা তিনি। সুযোগ পেলে ছুটিছাঁটার বিকেলে বউ-ছেলেকে নিয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হাঁটাহাঁটি করেন। ছোট ভাইদের কেউ কেউ সালাম দেয়। তবু তার হিসাবি চোখে হঠাৎ হঠাৎ আগুন ঝলক মারে। রঙিন পাঞ্জাবির বোতামে হাত দিয়ে নিজেকে অনুভব করেন। তারপর স্বপ্নপুরী জর্দা দিয়ে পান খান। সিগারেট ধরিয়ে হয়ে যেতে চান আনমনা।

অফিসে যাওয়া-আসার পথে তাকে রোজ রোজ কাজীর বাজারের পুল পেরোতে হয়। সেখানে তিনি একটা ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। বান্ডিল বান্ডিল টাকা মেশিনের হোগার মধ্যে ভরে দিয়ে মরা চোখে তাকিয়ে থাকেন। ফড়ফড়...শব্দ হয়। তার কামনা জাগে। মাথাটা খুব পরিষ্কার লাগে। ইচ্ছা করে এইসব নিয়ম-শৃঙ্খলার মুখে একবার হাত মেরে, সুন্দরী কলিগকে বগলদাবা করে, হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু তিনি অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে বহু দূর থেকে ভেসে আসা কলুর তেলের ঘানির ক্যাঁড়র...ক্যাঁড়...শব্দ শুনতে পান। মনটা একটু উদাস হয়। মুখটা মা-মরা ছেলের মতো শুকনা শুকনা লাগে। আফজল সাহেব কি নিজেকে কলুর বলদ ভাবতে শুরু করেছেন?

দুই

শেখঘাট হয়ে কাজীর বাজারের দিকে হাঁটতে থাকলে দেখা যায় সুরমা নদী আড়াল করে শুয়ে আছে বিশাল পুল। শহরের তরুণ-তরুণীরা আদর করে তাকে ডাকে সেলফিব্রিজ। বিকালে এখানে মেলা জমে। রেলিং ঘেঁষে সারি সারি চটপটির দোকান বসে, রঙিন হিজাব আর জিন্সের লীলা। মোকামে মোকামে কামের বাতি জ্বলতে থাকে। সেলফি ওঠে দশ-বিশ...। মাজারের দিক থেকে শাহজালালের কবুতরের ঝাঁক সবার মাথার উপর দিয়ে, শাহপরানের দরগার দিকে পতপত করে ছুটে যায় আর জগতের আলো-অন্ধকার লাইটপোস্টের মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ে। নিচে সুরমা নদীর মরা বুক, জলকষ্টে প্রাণ যায় যায়।

তিন

সেলফিব্রিজ পেরোলেই খোজারখলা। শত শত বছর আগে খোজারখলাতে ইরানিরা বাস করত। বাজার থেকে তাগড়া তাগড়া ক্রীতদাস কিনে এনে লিঙ্গ কেটে বলদ বানাত। তারপর জাহাজ বোঝাই করে মুর্শিদাবাদ, হায়দরাবাদ কিংবা দিল্লি। একজন আকবর বাদশাহর বেগম ছিল পাঁচ হাজার। জেনানা মহলের খরচ বাবদ বরাদ্দ ছিল সোবেবাংলার সবটুকু আয়।

চার

আফজল সাহেব একজন ভদ্রলোক। অফিসে লাঞ্চ টাইমে জোহরের নামাজ আদায় করেন। মিনি ভুঁড়িসহ এসির বাতাসে বসে থাকতে থাকতে শরীরের চামড়া কুনো ব্যাঙের পেটের মতো ফ্যাকাসে। সন্ধ্যায় অফিসের ঠান্ডা ঘর থেকে বেরোতেই ড্রেনের পচা গন্ধ-গরমের সাথে নাকে লাগে নদীর দিক থেকে ভেসে আসা পানির আঁশটে গন্ধ। দুষ্ট বালকের কৌতূহলে মনটা নেচে ওঠে। দেহযন্ত্রের হাডডিস্ক-মাদারবোর্ড সব বুঝি ভাইরাসে অচল করে দিচ্ছে! চিন্তা লাগে। তাই তিনি হাঁটেন। পান চিবাতে চিবাতে সিগারেটে টান দেন। মিষ্টি ধোঁয়ার সাথে বেরিয়ে আসে স্বপ্নপুরী জর্দার সুঘ্রাণ। এরকম স্বপ্নস্বপ্ন মুহূর্তে তিনি সেলফিব্রিজে ওঠেন। ইতিহাস তাকে তাড়া করে। অহেতুক একটা আতঙ্কে তার হাত চলে যায় নিচের একটা বিশেষ অঙ্গে। ব্রিজ থেকে তার চোখ চলে যায় খোজারখলার দিকে। মন সফর করতে থাকে ইরানিদের ঘরে ঘরে। কানে লাগে টগবগে তরুণ ক্রীতদাসের আর্তনাদ। চোখে ভাসে ছুরির একটানে কেটে ফেলা লিঙ্গের মুণ্ডু। মনে মনে আফজল সাহেব আরেকবার কেঁপে ওঠেন।

পাঁচ

 ভদ্রলোক একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস দেওয়া মানুষ। তিন বছর প্রেমের পর বান্ধবীকে বিয়ে করেছেন। এবং বর্তমানে তার এক মহিলা কলিগের সাথে চুমোচাট্টার মতো কিঞ্চিৎ পাপে লিপ্ত। বিষণ্ণতায় ভোগা, চারপাশের সবকিছু বাজে বাজে লাগা কিংবা নিজের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা তার নিয়তি। তবু এসবের মধ্যে ইদানীং সিএনজি স্ট্যান্ডে প্রায়ই তার সাথে দেখা হয় প্রাথমিকের এক শিক্ষিকার। মহিলার উঁচু বুক ও ভারী পেছন দিকটার দিকে তিনি বারবার চোরা চোখে তাকান। মেয়েটিও চুরি করে তাকে হাসি উপহার দেয়। হাসি দেখে তিনি লজ্জা পান। হাসির মাঝে মেয়েটি তাকে বুঝি বলছে, আমি বুঝেছি আপনার চোখে কী? তার শরীর-মনে শিহরণ লাগে। বুক ভরে দম টানতে ইচ্ছা করে। একজন আকবর বাদশাহ একা সামলাতেন পাঁচ হাজার। বর্তমানে তিনি সামলাচ্ছেন মাত্র দুইজন। অবশ্য আফজল সাহেব মনে মনে তিন নম্বর জনের কথাও ভাবতে পারেন। সেইটা সময় দেখবে। শ্যামল দাদার একটা বই আছে, ‘সময় বড় বলবান’। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh