আবুল কাসেম ফজলুল হক
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ০৫:৫৩ পিএম
আবুল কাসেম ফজলুল হক
এটা বাস্তব যে, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ, বিদেশে অর্থ পাচার এগুলো নিয়ে অনেক দিন ধরেই খবর হয়েছে। তবে লক্ষণীয়, বছরখানেক ধরে জাতীয় সংসদেও এগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং এ ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে; ফলে এসব নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু আমরা মূলত দুর্নীতির খবর পেলেও কী করে দুর্নীতির সমস্যার সমাধান করা যাবে, সমাজে এ ধরনের চিন্তা কমে গেছে। আমি মনে করি, রাজনীতি যারা করেন তাদের থেকেই সমাধানটা আসা উচিত।
বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা আগে বুঝতাম স্বাধীন, চিন্তাশীল ও বিবেকবান মানুষকে। যারা ব্যক্তিগত স্বার্থকে পেছনে ফেলে সকলের কল্যাণ ও স্বার্থের কথা ভাবেন। বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে এসব ব্যাপারে বক্তব্য এবং মতামত প্রকাশ হলে, তাতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হতো। কিছুটা ফল আসতে পারত। কিন্তু এ জিনিসটা আমাদের দেশে ১৯৮০-এর দশক থেকেই আর আগের মতো নেই। বুদ্ধিজীবীরা সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন বলে নানান অর্গানাইজেশন করেছে। ইন্ডিয়াতে এ কথাটা খুব চালু আছে ‘সিএসও’, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন। আমাদের দেশে এনজিও কথাটা ব্যাপক। সিএসও মানে বুদ্ধিজীবীদের এনজিও। বৈদেশিক টাকা নিয়ে যারা কথা বলে, লেখালেখি করে তারা কার্যকর লেখালেখি করতে পারে না। এই টাকা নেওয়ার একটা চাপ আছে, এতে তারা সাহসের সঙ্গে কথা বলতে পারে না, এটাই মূল কারণ। এখন তো বুদ্ধিজীবীই নেই। এনজিও, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন এদের নাম দিয়েছে ‘বিশিষ্ট নাগরিক’। বুদ্ধিজীবী কথাটা বাদ দিয়ে বিশিষ্ট নাগরিক কথাটা চালু করেছে। বাইরের যেসব শক্তি এনজিওদের টাকা দেয়, তারা টাকার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মতও দিয়ে দেয়। এগুলো খুব গোপনে করা হয়, প্রকাশ্যে না। এ রকম একটি বাস্তবতায় বাংলাদেশের যারা খুব প্রভাবশালী, শক্তিশালী বুদ্ধিজীবী তাদের এসব ব্যাপারে মনোযোগ দিতে বা সরব হতে দেখা যায় না এখন। বারবার প্রতিবাদ করতে করতে মানুষের প্রতিবাদ করার মানসিকতাও বদলে যায়, আমরা সেরকম একটি অবস্থায় আছি। এটা ভালো না, বরং খুব খারাপ অবস্থা।
দুনিয়াজুড়েই এখন কৃষি উৎপাদন অভাবনীয় রকম বেড়েছে। তা ছাড়াও টেকনোলজি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আরও অনেক সুযোগ মানুষের সামনে আসছে। কিন্তু পশ্চিমা জাতিগুলোর মধ্যেও দেখা যায় যে এই সুযোগটা শুধু উচ্চশ্রেণির লোকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দরিদ্র ও নি¤œমধ্যবিত্তের কাছে এ সুফলটা পৌঁছায় না। আর এখন আগের মতো চিন্তাও নেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ১৯৯১ সালে হওয়ার পর থেকে সব ক্ষেত্রেই মানুষ মানুষকে দিয়ে খুব ভালো বা বড় কিছু আশা করে না। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস, অনাস্থা নানাভাবে কাজ করে। এগুলোই এখনকার নীরবতার মূল কারণ। এখন এ অবস্থাটা দূর করতে গেলে পত্রপত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাকিস্তান আমলেও ছিল। যেমন মানিক মিয়ার পত্রিকা ইত্তেফাক। তারা কিছু উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে পত্রিকা করত এবং ওই জায়গায় দৃঢ় থাকত। মাঝে মাঝে তৎকালীন সরকার তাদের জামানতের টাকা বাতিলসহ নানাভাবে বিরক্ত করেছে। কিন্তু নতুন করে টাকা দিয়ে তাদের আবার প্রকাশ করতে হয়েছে। এ রকম নানান ঘটনা ছিল।
সাংবাদিকতা, এ প্রফেশনটাই অনেক সম্মানিত ছিল, কিন্তু এখন সম্মানিত আর নেই। টাকা কার বেশি আছে, এখন তাদেরকেই সম্মান করা হয়। মানুষের মন, মত, মানসিকতা বদলে গেছে। যদি সমাজের ভেতর থেকে রাজনীতি ও তার নেতৃত্ব সৃষ্টি হয় তাহলেই এর প্রতিকার হবে। আর এখন রাজনীতির যে ধারা চলছে এই ধারায় অবস্থার চাপে সাময়িকভাবে এক বছর-দুই বছর ধরে হয়তো এ রকম থাকবে, কিন্তু এর পর আবার নতুন করে শক্তি নিয়ে বাড়বে।
আর এসব সমস্যার সমাধান করার জন্য যে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার দরকার, রাজনৈতিক দল কীভাবে গঠন করবে, দল কীভাবে শক্তিশালী হবে এসব চিন্তাধারা আমাদের দেশে একেবারেই নেই। পৃথিবীটা এখন যেভাবে চলছে তাতে চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম এ জাতীয় কিছু রাষ্ট্রের অবস্থা একটু ভিন্নরকম। আর বাকি সব রাষ্ট্রই তো একই ধারায় চলছে। চীন এবং রাশিয়ার পলিসি ওয়েস্টার্ন পলিসি থেকে ভিন্ন। এবং চীনকে রাজনৈতিকভাবে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া, ভেঙে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা ইউএসএ এবং ইউকে করেছে, চেষ্টা চলছে এখনো। কিন্তু ভেঙে দিতে পারছে না।
সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে মানুষ অনেক বেশি সহিষ্ণু হয়ে গেছে। অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতিতে... নানানভাবে ভুগতে ভুগতে এখন সেই চেতনাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তবে হতাশ হওয়া যাবে না। এ রকম সংকট প্রত্যেক জাতিরই কখনো কখনো দেখা দেয়, আবার একটা সময় গিয়ে মানুষ জাগে, চিন্তাবিদ-নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশেও সে রকম হবে, তবে নতুন সৃষ্টির লক্ষণ এখনো দেখা যায়নি।
তবে কেবল দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন করে দুর্নীতি দূর করা যাবে না, এর বিপরীতে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থায়-সর্বত্র একটা ন্যায়নীতি অবলম্বন করে এগোতে হবে। ভুল মানুষ মাত্রই হয়, সেটা একটু ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে হয়। আমাদের দেশে সেই ১৯৭২ সাল থেকেই ক্রমাগত দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন চলেছে। কখনো কখনো দুই-তিন বছর শান্ত থেকেছে আবার আরম্ভ হয়েছে। এ দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন দিয়ে তো আমরা কিছু অর্জন করতে পারিনি। মানুষ কেবল বর্তমান দেখে, কী সুবিধা পাবে সেটা দেখে। কিন্তু দূরদর্শিতার সঙ্গে আমার এবং এ দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ একত্র করে দেখতে হবে। অকারণে কারও কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। সব মানুষ তো সমান না, বুদ্ধি, শারীরিক শক্তির দিক থেকে। কাজেই যারা বেশি যোগ্য লোক তাদের সামনে এগোতে দিতে হবে। অন্যদের পর্যায়ক্রমে একটু পেছনে থাকতে হবে। এসব নীতি পাকিস্তান আমলে আমাদের এখানে কিছুটা আলোচনা হতো। এখন এগুলো কেউ আলোচনা করে না। ন্যায়-অন্যায়ের বিষয় এটা সম্পূর্ণ মোল্লা-মৌলবীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও মাধ্যমিক পর্যায়ে নৈতিক চেতনা ও ইসলাম, নৈতিক চেতনা ও হিন্দু ধর্ম, নৈতিক চেতনা ও খ্রিষ্ট ধর্ম, নৈতিক চেতনা ও বৌদ্ধ ধর্ম এভাবে ছাত্রদের শেখাচ্ছে। এবং এখানে আলাদাভাবে ছাত্ররা নিতে পারেনি, যে যেটা নেয় সবগুলো একসঙ্গে পড়তে হবে তাও না। এটার দ্বারা ধর্মের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখছে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা। মানুষ পেটের দায়ে আয় করছে, সম্পত্তিশালী হচ্ছে, আর এই সম্পদ অর্জনটা দুর্নীতির দিকে ভীষণভাবে চলে গেছে। বেনজীর আহমেদ, একজনের দৃষ্টান্তই তো ভয়ানক। যেখানে অনুসন্ধান করেছে সেখানেই বড় বড় দুর্নীতি বেরিয়ে আসছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ