আহসান হাবীব সুমন ও মীর ইফতেখার উদ্দিন ফাহাদ
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৫:১৮ পিএম | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৫:২৯ পিএম
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে ভারত। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে অনুষ্ঠিত নবম আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে ভারত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের পর ভারতের নামের পাশে যোগ হলো দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, যা প্রথমবার টিম ইন্ডিয়া জিতেছিল ২০০৭ সালের অভিষেক আসরে। শুধু তাই না, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে ভারতীয়রা ‘অপরাজিত’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
ভেঙেছে ভাগ্যদেবীর অভিমান
সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটে ভারত দুর্ধর্ষ দল। যে কোনো টুর্নামেন্টে টপ ফেভারিট থাকে তারাই। কিন্তু ভাগ্যদেবীর রুষ্ট আচরণে ধরা দিচ্ছিল না শিরোপা। ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের পর থেকে পাঁচটি আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলেছে ভারত। টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি সবই আছে এরই মধ্যে। কিন্তু জিততে পারেনি একটিও। সর্বশেষ ২০২৩ সালে নিজেদের মাটিতে টানা ১০ ম্যাচে প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে একদিনের বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠা টিম ইন্ডিয়া হেরে যায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে।
সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ভারত দেখিয়েছে নিজেদের শক্তি। গ্রুপ পর্বে ভারত টানা হারায় আয়ারল্যান্ড, পাকিস্তান আর যুক্তরাষ্ট্রকে। কানাডার বিপক্ষে ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ভারতের সুপার-৮-এ উঠতে কোনো সমস্যা হয়নি। সেরা-৮ পর্বে ভারতের কাছে পাত্তা পায়নি আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া আর বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে তারা হারায় ইংল্যান্ডকে।
ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তারাও ফাইনালে উঠে আসে শতভাগ সাফল্যে। গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কা, হল্যান্ড, বাংলাদেশ আর নেপাল পরাজয় স্বীকার করে প্রোটিয়াদের কাছে। সুপার-৮ পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার উজ্জীবিত নৈপুণ্যের সামনে মাথানত করে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর সেমিফাইনালে প্রোটিয়াদের কাছে পাত্তা পায়নি আফগানিস্তান।
দক্ষিণ আফ্রিকা কখনো আইসিসি আয়োজিত কোনো বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলেনি। বড়জোর সেমিফাইনালে থেমেছে তাদের পথচলা। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জিততে জিততে হেরে যাওয়া যেন আফ্রিকানদের মজ্জাগত অভ্যাস। তাই তাদের নামের পাশে যোগ হয়েছে ‘চোকার্স’ বিশেষণ। যদিও ১৯৯৮ সালে ঢাকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছিল আইসিসি নকআউট ট্রফি। ক্রিকেটের সেরা আট দলের প্রতিযোগিতা পরিচিত ছিল ‘মিনি বিশ্বকাপ’ নামে। কিন্তু তা অনেকেই বিস্মৃত।
নবম বিশ্বকাপ ফাইনালেও শিকে ছেঁড়েনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্যে, ভারতের কাছে হেরে রানার আপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের প্রতিনিধিদের। ২৯ জুন কেনিংটন ওভালের ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করা ভারতের ৭ উইকেটে ১৭৬ রানের জবাবে প্রোটিয়া ইনিংস থামে ৮ উইকেটে ১৬৯ রানে। অথচ ম্যাচটি নিশ্চিত জয়ের পথে ছিল এইডেন মার্করামের দল। একটা সময় প্রয়োজন ছিল ৩০ বলে ৩০ রান। হাতে ৬ উইকেট। ক্রিজে হেনরিক ক্লাসেন আর ডেভিড মিলার। কিন্তু ১৭তম ওভারের শুরুতেই ২৭ বলে ৫২ রান করা ক্লাসেনকে ফেরান হার্দিক পান্ডিয়া। ২০তম ওভারের প্রথম বলে পান্ডিয়া তুলে নেন কিলার মিলারের উইকেট। মাঝে বুমরাহর বলে ২ রানে প্যাভিলিয়নে ফেরেন মার্কো জানসেন। বদলে যায় ম্যাচের দৃশ্যপট। নিশ্চিত হারা ম্যাচ জিতে নেয় ভারত।
বিরাট কোহলি বড় আসরের বড় তারকা
ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার কোহলি। ২০১৪ আর ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পেয়েছেন সেরা খেলোয়াড়ের সম্মান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আয়োজিত বিশ্বকাপে ভারতের সাবেক অধিনায়ক ছিলেন ভীষণ ম্লান। ফাইনাল বাদে টুর্নামেন্টের শুরু থেকে ৭ ম্যাচে (১, ৪, ০, ২৪, ৩৭, ০ ও ৯) বিরাট কোহলি সব মিলিয়ে করেছেন মাত্র ৭৫ রান। কিন্তু ফাইনালেই করলেন ৫৯ বলে ম্যাচের সর্বোচ্চ ৭৬ রান। ৩৪ রানে ভারতের ৩ উইকেটের পতনে যখন পুরো দল বিপর্যয়ের শঙ্কায়, তখনই হাল ধরেন ‘কিং’ কোহলি। চতুর্থ উইকেটে আক্সার প্যাটেলকে সঙ্গে নিয়ে ৫৪ বলে গড়েন ৭২ রানের জুটি। তাদের এই জুটিতেই বিপদ কাটিয়ে চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়ার পুঁজি পায়। যা শেষ পর্যন্ত জয়ে পরিণত করেন ভারতীয় বোলাররা।
দুর্দান্ত ইনিংসে পুরো টুর্নামেন্টে ফ্লপ কোহলি পান ‘ম্যান অব দ্য ফাইনাল’
স্বীকৃতি। এ ছাড়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১২৯২ রান এসেছে কোহলির ব্যাট থেকেই।
সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রোহিত শর্মা
ফাইনালে ৫ বলে মাত্র ৯ রান করে বিদায় নেন ভারতীয় অধিনায়ক। কিন্তু পুরো আসরে রোহিত ছিলেন দারুণ ছন্দে। করেছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৫৭ রান। মেরেছেন ২৪টি চার আর ১৫টি ছক্কা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২০ রানের মালিক তিনি।
দলগত পারফর্ম্যান্সে সফল ভারত
বলা হয়, ভারতীয় জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা সম্পন্ন খেলোয়াড়দের নিয়ে আরও দুই-তিনটি বিশ্বমানের ক্রিকেট দল বানানো সম্ভব। ভারতীয় দলের ব্যাটিং গভীরতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। দলের ১ থেকে ১১ পজিশনের সবাই প্রয়োজনে ব্যাট করতে পারেন। কিন্তু ক্রিকেট শুধু ব্যাটারদের খেলা না। বোলার আর ফিল্ডারদের দায়িত্ব নিতে হয় ম্যাচ জেতাতে। ফাইনালে বিপজ্জনক হয়ে ওঠা ক্লাসেন, মিলার আর শেষে কাগিসো রাবাদাকে ফিরিয়ে পান্ডিয়া ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন। আর্শদিপ সিং আর জাসপ্রিত বুমরাহ দুটি করে উইকেট নিয়ে বড় ভূমিকা রাখেন শিরোপা জয়ে। বুমরাহ ১৫ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের সেরাই নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া আর্শদিপ নিয়েছেন আফগানিস্তানের ফজলহক ফারুকির সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৭ উইকেট।
ফিল্ডিংয়েও ভারত ছিল অনন্য। ফাইনালের শেষ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্য প্রয়োজন ১৬ রান। ডেভিড মিলার থাকায় যা খুবই সম্ভব মনে হচ্ছিল। পান্ডিয়ার প্রথম বলেই তার নিশ্চিত ছক্কার প্রচেষ্টা লং-অফের বাউন্ডারিতে তিনবারের প্রচেষ্টায় ধরেন সূর্যকুমার। বাউন্ডারির বাইরে চলে যাবেন বলে বুঝতে পেরে বলটা শূন্যে ছুড়ে দেন তিনি। তারপর বাউন্ডারির মধ্যে ঢুকে পড়েন। ফিরতি বলে ক্যাচটা ধরার জন্য লাফিয়ে বাউন্ডারির মধ্যে ঢুকে আসেন। আর সেই অবিশ্বাস্য ক্যাচটা পূর্ণ করেন সূর্যকুমার। দলের জন্য নিজেকে শতভাগ নিংড়ে দেওয়ার মানসিকতা ছিল ভারতীয়দের মধ্যে।
অঘটনের বিশ্বকাপে হতাশ করেছে বাংলাদেশ
এবারের বিশ্বকাপকে অঘটনের আসর বলা যায়। গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা। সুপার-৮ পেরুতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বে তিনটি জয় পায়। যা এক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টাইগারদের সর্বোচ্চ জয়ের রেকর্ড। কিন্তু সুপার-৮-এ টানা তিন ম্যাচে অসহায় পরাজয় শান্তর দলকে দাঁড় করিয়েছে কাঠগড়ায়। বিশেষ করে জটিল সমীকরণে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় পেলে সেমিতে খেলার সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু সবাইকে অবাক করে রয়েসয়ে খেলার মানসিকতায় উল্টো হেরেছে বাংলাদেশ। সৌম্য, লিটন, শান্ত, সাকিব আর মাহমুদুল্লাহদের মধ্যে ছিল না টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার মানসিকতা। সব মিলিয়ে অঘটনের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যেন ছিল নবিশ এক দল।
যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান
যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষের ক্রিকেট সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। কিন্তু শক্তিশালী অর্থনীতির দেশটিতে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টায় ‘আইসিসি’ নেয় বিশ্বকাপ আয়োজনের ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। পিচের পাগলাটে আচরণ নিয়ে স্বাগতিকদের সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু সব সমালোচনা উড়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র সুপার-৮-এ ওঠায়। যুক্তরাষ্ট্র হারিয়েছে পাকিস্তানের মতো পরাশক্তিকে। জয় পায় কানাডার বিপক্ষেও। আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার সুবাদে পাওয়া পয়েন্টে দলটি পায় সুপার-৮-এর টিকিট। এ ছাড়া মার্কিন মুল্লুকের ভারতীয়, পাকিস্তানি আর বাংলাদেশি ক্রিকেট ভক্তরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে হাজিরা দিয়েছেন। তাতে দর্শক উপস্থিতির বিচারেও আয়োজক যুক্তরাষ্ট্র সফল। এতে চওড়া হয়েছে আইসিসির হাসি।
ব্যক্তিগত সেঞ্চুরি ছাড়া ২০২৪ বিশ্বকাপ
সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দেখা মেলেনি কোনো সেঞ্চুরির। সুপার-৮-এ আফগানিস্তানের বিপক্ষে নিকোলাস পুরানের ৫৩ বলে ৯৮ রানের ইনিংসটি আসরের সর্বোচ্চ। এক ম্যাচে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন ফজলহক আর ক্যারিবিয়ান আকিল হোসেন। দুজনই উগান্ডার বিপক্ষে পূর্ণ করেন ‘ফাইফার’। টুর্নামেন্টে সর্বাধিক আটটি ক্যাচ নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার মার্করাম।
বিস্ময় জাগানিয়া আফগানিস্তান
সেমিফাইনাল লাইনআপে ভারত, ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ছিল আফগানিস্তানের নাম! বিস্ময়কর হলেও যোগ্য দল হিসেবেই প্রথমবার ক্রিকেটের কোনো বিশ্ব প্রতিযোগিতার সেমিতে নাম লিখিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে আফগানরা। গ্রুপ পর্বে আফগানিস্তান তিনটি জয় পায় নিউজিল্যান্ড, উগান্ডা আর পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে। স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারলেও সুপার-৮-এ ওঠা আফগানরা বধ করে অস্ট্রেলিয়ার মতো পরাশক্তিকে। হারায় বাংলাদেশকে। ভারতের সঙ্গে পারেনি। হেরেছে সেমিতে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেও। কিন্তু পুরো আসরে আফগানদের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স মুগ্ধ করেছে সবাইকে।
আফগান ওপেনার রহমানুল্লাহ গুরবাজ করেছেন টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ২৮১ রান। ইব্রাহিম জার্দান ২৩১ রান করে ছিলেন সেরা পাঁচে। বোলারদের মধ্যে ফজলহক নিয়েছেন যৌথ সর্বোচ্চ ১৭ উইকেট। ১৪ উইকেট পেয়েছেন অভিজ্ঞ রাশিদ খান। সব মিলিয়ে আফগানরা ছিল বিশ্বকাপের ‘বিস্ফোরক প্যাকেজ’।