অচেতন

মুর্শিদা জামান

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৪, ০৯:০০ পিএম | আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৪, ০৯:০১ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

পর পর কয়েকবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছি আমি। কেন যেন প্রতিবার মৃত্যু আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। হয়তো আজ এই পাইনের বনে একা একা হাঁটব তাই। বনের যত গভীরে প্রবেশ করছি তত নির্জনতা গ্রাস করে ফেলছে আমাকে। আরও এক-দু মাইলের পর টিলা পাহাড়ের মাথায় সবচেয়ে পুরোনো গাছটার কাছে পৌঁছাতে পারব। সেখানে ছোট কাঠের কুঁড়ে বানানো আছে, বিশ্রাম নিয়ে আবার বনে হাঁটার জন্য। আমি অবশ্য একটা রাত ছিলাম গত সপ্তাহে। প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো গাছের কোটর এমনভাবে হাঁ হয়ে আছে যেন বিদ্রুপ করছে গোটা বনটাকে।

সাইন বোর্ডে নির্দেশনা দেওয়া আছে কী কী করা যাবে, আর কী কী করা যাবে না। বিষাক্ত পোকামাকড় নেই বললেই চলে এখানে। নিরীহ লাল ছোট শেয়াল আর কিছু বন্য গরু আছে এই বনে। গরুগুলোর শিং সমান করে কেটে দেওয়া। ফলে বনে কেউ হাঁটতে এলেও ভয়ের কিছু নেই। প্রায় দু-বছর হলো এখানে আছি। হাতের তালুর মতো চেনা হয়ে গেছে জায়গাটা। চোখ বেঁধে দিলেও ঠিক নিজের কটেজে ফিরতে পারব। প্রথম দিকে অবশ্য এক ছুটে পালিয়ে যেতে চাইতাম। মনে হতো এর চেয়ে বাংলাদেশের জেলই ভালো ছিল। 

ধীরে ধীরে খেলে বিষ যেমন হজম হয়ে যায়, তেমনি এই ভিনদেশের নির্জন দ্বীপের ভেতরেও আমি সয়ে গেলাম। স্টকহোম থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটা দ্বীপে থাকি। থাকি বলতে এখানেই কাজ এখানেই বাস। দ্বীপটাতে প্রাচীন একটি সৃজনশীল স্কুল অবস্থিত। বছরজুড়ে নানারকম কোর্স চালু থাকে। এমনকি লোকে এই নির্জনতা উপভোগ করতে প্রতি গ্রীষ্মের ছুটিতে এটা সেটার ছুতোয় কটেজ ভাড়া করে চলে আসে। সেটা নিটিংয়ের কোর্স বা হার্ব চাষের শর্ট কোর্সই হোক বা না কেন। এখানে না এলে জানাই হতো না সামান্য পুদিনা চাষের জন্য কোর্স করা লাগে। কোন পাতা জলে ভেজালে চুল ঝলমলে হবে বিনা শ্যাম্পুতে, এ তো আমার দেশের লোক মায়ের পেট থেকে পড়েই জানে। এখানে অবশ্য ব্যাপারটা অনেক গভীর। যে কোনো কিছু শিখতে হলে তার নাড়ি নক্ষত্রসুদ্ধ জানানোর জন্য তৈরি সমস্ত কিছু। 

তো, আমি এই স্কুলে দুটো কোর্সের শিক্ষক। কাগজ দিয়ে পাখি, ফুল, মুখোশ এসব বানানো শেখাই একটা কোর্সে। আরেকটা কোর্সে চিঠি কত সুন্দরভাবে লেখা যায় তাই শেখাই তবে কাজের চাইতে অবসর বেশি আমার। অন্য শিক্ষকরা প্রতি সপ্তাহে স্টকহোম বা অন্য শহরে চলে যায়। আমি যাই না। ওরা যাবার আগে গাড়ির জানালা দিয়ে হাঁক ছাড়ে, বেল্লাল তোমার জন্য কিছু আনব? আমি হাসি ছুড়ে দিই পাল্টা। জানি ফোন ছুঁয়েও দেখবে না ছুটির দিনে। আর তাছাড়া আমার যা লাগবে ওরা এই সুইডেন চষে বেড়ালেও আনতে পারবে না। বাবলা ফুলের ঘ্রাণ লাগবে, তেলাকুচি পাতার ভেতর পাকা তেলাকুচি লাগবে। শিউলি ফুলের সকাল লাগবে। লাগবে কলাপাতায় মাখা কই মাছের ভাপা ভাত মাখা। এসবের জন্য প্রাণ কেমন করে জেলে ছিলাম যখন লিখে চিঠিতে জানাতাম মাকে, বন্ধুকে। কোনো চিঠি শালারা পাঠাত কোনো চিঠি কোনো দিনই কেউ পড়ত না। আমি প্রতিদিন ঠিক করতাম জেল থেকে মুক্তি পেলে কি কি করব। ভালো হয়ে যাব, একটা মিথ্যে কথাও বলব না; কিন্তু না মিথ্যে না বললে অনেক কিছুই হয় না। কারণে অকারণে মিথ্যে বলি। জেলে থাকার সময়ই প্রথম জানতে পারি মুক্তা আপার প্রথম বাচ্চাটা আসলে আমার সন্তান ছিল। জন্মের পর মারা যায়। ও যেদিন এলো দেখা করতে আমি সেদিনও জানতাম না আমাকে মেরে ফেলা হবে না কি মুক্তি দেওয়া হবে। মুক্তা আপার স্বামী দেশের অনেক বড় সাংবাদিক। মুক্তা আপা নিজেও। মুক্তা আপা কালো মোটা সামান্য গোমড়া মুখের একটা সুন্দর মানুষ। জেলে যে কটা মুহূর্ত কথা হয়েছিল তার মধ্যেই জানলাম আমি শুধু বেল্লাল না আমি একজন বাবাও হয়েছিলাম, তবে তা অসফল এক গল্প। এর ঠিক কুড়ি দিনের মাথায় আমি ছাড়া পেলাম। সেটা মুক্তা আপার জন্য নাকি অচেনা অদেখা একটা অনুভবের শক্তিতে জানি না আজও। তবে আশ্চর্যজনক সত্যি হলো আমি মিথ্যে কথা ছাড়তে পারিনি। যা যা ভেবেছিলাম করব কিছুই করতে পারিনি। কোথাও কারও সাথে দেখা করিনি। সোজা গ্রামে গিয়ে মাটিতে মাদুর পেতে ঘুমিয়েছি। ছয় মাসের জেল জীবন আমার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু আবার অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রথম চোটেই মানুষ চিনতে শিখিয়েছে। 

আমার ভেতরের অসভ্য জন্তুটাকে শান্ত হতে সাহায্য করেছে। অনেক কিছু হারানোর বিনিময়ে আমি আজ যা, তা হলো শান্ত এক মিথ্যা। মুক্তা আপার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। আমি করিনি। চুপিসারে দেশ ছেড়েছি। তাছাড়া আর উপায়ও ছিল না। একটা খামখেয়ালি বৃষ্টির বিকেলে আমরা দুজন মানুষ সম্পর্ক ভুলে শুধু শরীরের তাগিদে মিলিত হয়েছিলাম। মুক্তা আপা অবশ্য এই নিয়ে কোনোদিন আমার সাথে কথা বলেনি। যেন মেঘ করেছিল তাই বৃষ্টি হয়েছিল। 

তখন মাস্টার্স শেষ করে আমরা কয়েক বন্ধুরা মিলে এফএম রেডিওতে জয়েন করেছি। হৈহৈ করে কাজ করি, আড্ডা মারি আর এটা সেটা নিয়ে আন্দোলন করি। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের উপরে থাকি কজন বন্ধু। শিপার কীভাবে কীভাবে যেন জার্মানি চলে গেল। পরে জানতে পারলাম ডয়েচেভেলের এক প্রোগ্রামে গিয়ে আর ফেরত আসেনি। তখন হাতে বেশ টাকা, বন্ধুদের দু-একজন কাপড়ের ব্যবসায় পয়সা খাটাতে শুরু করে দিল। আমি ওদের দেখে হতাশ হয়ে গেলাম। অনার্সের দুটো বছর আমরা এক সঙ্গে নানা পাঠচক্রে গিয়েছি। দেশে শুদ্ধ ভাষার চর্চার জন্য যা যা পদক্ষেপ নিতে হবে সব কিছুর জন্য আমরা দিন-রাত এক করেছি। ক্যাম্পাসের ব্যানার লেখা, দেয়াল লেখা সবখানের বানান আর শুদ্ধ বাক্য লেখার জন্য আমাদের নাম ছিল সবার আগে। সেই হাফিজ কথায় কথায় হালার গুষ্টি কিলাই রপ্ত করা থেকে সব রকম গালাগাল ঠোঁটের আগায় নিয়ে কথা বলে। শুধু হাফিজ না একে একে আমাদের সব কেমন অচেনা হয়ে উঠল দ্রুত। যে আজিজের সিঁড়িতে গল্প কবিতা আর্ট বিপ্লব করে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চা আর সিগারেট খেয়ে কাটিয়েছি সেই আজিজের বই পত্রিকার দোকানপাট ভরে উঠল বুটিক আর খাবারের ব্যবসায়। যে বন্ধুটি প্রথম বিদেশ চলে যাবার ভিসা পেল ও যাবার আগে বেছে বেছে লোকদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াল। আমরা যেন মাছের কাঁটা গেলে গলায় আটকে যেতাম। অভিমান হলেও আমরা তাকে ভুলিনি। আমরা মানে নীলাক্ষি খাস্তগির, আর অপরেশ দা আর আমি। অপরেশ দা বেঁচে নেই আর। শুধু লেখার জন্য তাকে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। এর পর অনেকেই গা-ঢাকা দিয়ে দিল। আমি আর নীলা মানে নীলাক্ষি চষে বেড়িয়েছি গ্রামের পর গ্রাম কাজের জন্য। তখন কাজ না করলে আসলে মারা পড়তাম দুজনই। ঢাকা নিরাপদ ছিল না মোটেও। আমার কিছু লুকানো পয়সা ছিল। এফএম রেডিওতে কাজের সুবাদে একটা মোটা অঙ্কের টাকা আমরা দু-তিনজন সরিয়ে ফেলি। অতগুলো টাকা ভাগাভাগি করে নিয়ে আমরা দিব্যি শুদ্ধ বাংলার চর্চা চালিয়ে যেতাম। আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে গলা ছেড়ে গাইতাম শাহবাগে। 

শুধু নীলাক্ষির ব্যাপারে ভান করতে পারিনি। অপরেশ দা ওভাবে মরে যাবার পর হাতটা আমি শক্ত করে ধরেছিলাম ওর। গ্রামে কাজের চাপ কমিয়ে আমরা শহরের একদম ঘিঞ্জি অঞ্চলে দুই কামরার একটা ভাড়া বাড়িতে সংসার পাতলাম। নীলাক্ষির জন্য আমি যা যা অনুভব করতাম অন্য কোনো নারীর জন্য করিনি কখনো। ওর তলপেটে একবার নাকি অপরেশ দা রাগের চোটে লাথি মেরেছিল। সে কথা শুনে সারাটা দিন সেদিন চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিলাম ওর পেট। কাজ তেমন ছিল না তাই লুকোনো পয়সায় মাস চালাতে হচ্ছিল। একটা অনলাইন পত্রিকার জন্য বেগার খেটে যাচ্ছিলাম। তবু কোথাও সেই অর্থে ডাক পাচ্ছিলাম না। কারণ ততদিনে আমার মতো কয়েকজনকে ভয় পেতে শুরু করে দিয়েছে লোকজন। এমনকি ছবি তুলতে চাইত না এক সাথে। নীলা এই নিয়ে খুব মন খারাপ করত। নীলাই প্রথম ভালো কাজ পেল। আমরা সেই খুশিতে বিউটি বোর্ডিংয়ে গিয়ে খেলাম। লালবাগের কেল্লায় ঘুরলাম। কিন্তু ও যখন ব্যস্ত হয়ে গেল পুরোপুরি আমি রান্না সারি আর লিখি। কিন্তু মন বসাতে পারি না কিছুতেই। বাজারে ঘুরিফিরি অহেতুক। মাঝে মাঝে সাহস করে শাহবাগের আজিজে চলে যাই। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে সবাই। পরিচিত জটলার সেই মধু যেন কোথাও উধাও। দেশে কী চলছে আর কী চলছে না! সবখানে বলাবলি হচ্ছে কোন কোন মাথা বিক্রি হয়ে গেছে আর কাদের কিনে নেবার পাঁয়তারা চলছে। এসব নিয়ে শিগ্রি মাঠে নামবে কেউ কেউ। হত্যা, গুম আর কথা বলতে না দেয়ার ইশারার এবার দাঁত ভাঙা জবাব দিতে হবে! এসব শুনি যখন পিঠের হাড়গুলো কথা বলে ওঠে মুহূর্তে, জেলের বেদম মারপিট খাওয়া শরীর আর আন্দোলনে নামতে চায় না। এই শরীর এখন শুধুই নীলার জন্য কাতর হয়ে থাকে। আমি নীরবে বাড়ি ফিরি। ঘর মুছি, রান্না করি, কাপড় কাচি, নিজেকে গোছাই। নীলা অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি ওর ঘুমন্ত শরীরে নিজেকে ঘষি। একদিন আমরা দুজন অদ্ভুতভাবে আলাদা হয়ে যাই। দোষ খুঁজে দেখি আমি ভালো মানুষের মতো কাঁদছি। জেলে বসেও কাঁদিনি যত নীলা চলে গেলে কেঁদেছি আমি পাগলের মতো। আত্মহত্যা করতে গিয়ে দেখি সেখানেও আমাকে পরিত্যাগ করা হচ্ছে। নীলার জিনিসপত্র আর কাপড়চোপড় ঘরের চারি দিকে যেমন ছিল তেমনই আছে এমনকি ওর ঘ্রাণ এক মাসজুড়ে ছিল বালিশে, সোফায়, দেয়ালে, মেঝেতে সবখানে। আমি সারাদিন কোথাও যেতাম না। ফোনে কথা বলতাম না। মনে হতো এই বুঝি নীলা চাবি ঘোরাবে দরজায়। নীলা কল করবে বলে ফোন হাতে বসে থাকতাম। ফেসবুক থেকে শুরু করে সবখানে আমাকে ব্লক করে দিল ও। ছবিগুলো লুকিয়ে ফেলল। যেন আমি ছিলাম না কোনোদিন পৃথিবীতে। 

বুকের ভেতরটা ব্রাশফায়ার করে দিয়েছিল নীলা। আমার প্রত্যেকটা পল মনে হতো ছাদ থেকে লাফ দেই। অসহ্য চিৎকার গলা দিয়ে বের করে দিতাম যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্লান্ত হতাম। বারবার রেকর্ড করতাম, নীলা প্লিজ ফিরে এসো। আমি পারিনি নীলার আঘাত মেনে নিতে। পারিনি ওর চলে যাওয়া সহ্য করতে। আমি তো জেল খাটা একটা লোক! পুলিশের পেটন খাওয়া লোক! দেশের নোংরা রাজনীতির বুলডোজারে পিষ্ট হওয়া একটা মানুষ হয়েও নীলার দেয়া আঘাত সহ্য করতে পারিনি। ও আমার ভালোবাসা বুঝতে পারেনি। আজও জানি না নীলার সেই মনের রহস্য। আমি একটা অনলাইন পোর্টালে সদ্য ঢুকেছি। অফিস আর বাড়ি যাওয়া আসা শুধু। আচমকা একদিন একটা মোটরসাইকেল এসে ধাক্কা দিল। মাস দুয়েক শয্যাশায়ী ছিলাম। নীলাই একজন ফিজিওথেরাপিস্ট জোগাড় করে দিল। সপ্তাহে দুবার এসে কিছু ব্যায়ামের প্রশিক্ষণ দিয়ে যায় খাবারের মেন্যু এসব ঠিক করেটরে দেয়। বেশ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু তত দিনে শয্যাসঙ্গী নীলা সেই ফিজিওথেরাপিস্টের। ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই ছিলেন তিনি। কিন্তু কাকে বিশ্বাস করবে মানুষ! সারা দুনিয়া জুড়ে বিশ্বাসঘাতকতা, ধোঁকাবাজি তবু আমরা মানুষের কাছে থাকতে ভালোবাসি তাদের জন্যই বারবার চিৎকার করে বলি, তোমাকে ছাড়া নিজেকে ভাবা কতটা কঠিন। এসব লিখে লিখে আমি ফেসবুকে বেশ অন্য রকম নাম কামাই করলাম। লোকজন হু হু করে আমাকে ফলো করা শুরু করে দিল; কিন্তু সেটাও সরকারের পাহারাদার খ্যাত কিছু লোকজনের পছন্দসই হলো না। জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক হয়রানির পর্যায়ে বিপর্যস্ত আমি যখন, ঠিক সেই মুহূর্তে ফেরেস্তার মতো হাজির এক বান্দা। 

আমি সেই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হলাম সত্যি কিন্তু কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেওয়ার অনুভূতি নিয়ে দেশ থেকে বের হলাম একদিন। দেশ! মানচিত্র, পতাকা আর এক বুক ভালোবাসা সমস্ত কিছু ছেড়ে পাড়ি দিলাম যখন বেশ গোসা হচ্ছিল সব কিছুর প্রতি। তব্ওু বেঁচে থাকার লোভ আমাকে পেয়ে বসে আবার। বেঁচে থাকা যেন আদিম সেই ইচ্ছের মতো বুনো শুয়োরের সাথে পাল্লা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিযোগিতা করে যাওয়া। শুধু শুধু বোঝা নেব না বলে কিচ্ছু নিয়ে আসিনি আমি। এক সুটকেসে কিছু বইপত্র আর হালকা জামাকাপড়। মার সেলাই করা নরম কাঁথা আনার কথা ভুলে যাওয়াতে বুকটা মোচড় দেয় থেকে থেকে। সে কথা স্টকহোমে এক বাঙালি পরিবারে খেতে গিয়ে বলেছিলাম দেখে সে কী হাসি সবার! আপনি পুরুষ মানুষের জাত মেরে দিলেন ভাই! বিদেশে আসা চাট্টিখানি কথা! 

লোকে আসার জন্য গু চাটতে বলল্লে তাই চাটবে। আর আপনি আছেন মায়ের কাঁথার শোক নিয়ে! ধুর কদিন ঘোরেন মজা নেন, দেখবেন জীবন কী জিনিস! কানে কানে একজন বললেন, জানেন তো এদের অনেক রকম শোয়ার জ্ঞান, পাহাড়ে, বনে, রাতে দিনে, বাথরুমে সবখানে এরা সত্যিকারের শুতে জানে। সেই স্বাদ নিন না বেল্লাল ভাই। আর আমাদের মহিলাদের মতন না কিন্তু ভীষণ সাদা সবখানে! বলেই কুৎসিত ইঙ্গিত করলেন লোকটা। আমি এর পর নাকে খত দিলাম কোনো বাঙালি শালার বাড়ি খেতে যাব না। কোনো কথা শালাদের সঙ্গে ভাগ করব না। শালা হারামির দল।

কিন্তু ছয় মাস যেতেই আমি নিজেই নিজের সঙ্গে বেঈমানি করলাম। বেড়াল বলে মাছ ছোঁব না তাই কী হয় কোনোদিন। রাজধানীর পাট চুকিয়ে আমি চলে এলাম এই নির্জন দ্বীপের কাজে। শোকে হোক আর আর শখে আমি ব্যাপারটা তলিয়ে দেখিনি প্রথম দিকে। কাজ জুটে গেছে থাকার সুব্যবস্থা আর কী চাই। কিন্তু আমার শরীরের ঝুলন্ত ঘুমন্ত শরীর জানান দিচ্ছিল তার খাদ্য চাই। তার আরাম চাই। ভয়ানক একটা যৌন তাড়না আমাকে পেয়ে বসলো। কিন্তু নীলার স্মৃতির প্রতি ফুল নিবেদন তখনো চলছে ভেতরে ভেতরে। প্রকৃতি আমার মনের আকুতির অংশটুকু হতে বুঝি বিচ্ছিন্ন নয় কোনোভাবেই। সে আমার সব রকম খাদ্যের দায়ভার নিয়ে আমাকে টিকিয়ে রাখবেই। 

মেয়েটি তার দাদির জন্য বই লিখবে বলে শর্ট কোর্স করতে এসেছে এখানে। খুব পড়াশোনা আর লেখার জন্য মেয়েটি জন্মেছে যেন। এত শান্ত মুখ খুব কম দেখেছি আমি। নিস্তব্ধ তাল পুকুর তাতে আকাশ উপুড় হয়ে পড়েছে যেন। লম্বা সাদা ধবধবে পা ফেলে হাঁটে যখন মনে হয় ঘাসগুলো আনন্দে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছে। এই রকম আকাশ পাতাল ভাবছি একদিন দুপুরের লাঞ্চে বসে তখন এলো মেয়েটি। সোজা প্রশ্ন করল, তুমি কি ইন্ডিয়া থেকে এসেছো? আমার এত রাগ হলো কেন কে জানে প্রশ্নটা শুনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললাম, তুমি কি মক্কা থেকে এসেছ? মেয়েটি অবাক হলো না। 

চেয়ারে ওর নিতম্ব একটু সহজ হলো আরও। আমি বার্লিন থেকে এসেছি। আমার দাদি সুইডিশ। এইটুকু বলেই শান্ত হয়ে নিজের কোর্সের কথা জানালো। আমার সূক্ষ্ম রাগটা লুকালাম না। বললাম, বাংলাদেশের নাম শুনেছ? আমি সেই দেশ থেকে এসেছি। নাট্যকলার ডিগ্রি নিয়ে রেডিওতে শুদ্ধ ভাষার অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছি। ইন্ডিয়া বাপের জন্মে যাইনি। তবে আমরা এক সময় আলাদা ছিলাম না। জানো তো ব্রিটিশরা এই স্যান্ডউইচ কেটে খাওয়ার মতো ভাগ করেছে আমাদের। আমার এসব কথায় ওর সোনালি চুল উড়ল মাত্র। তুমি কি জানো পৃথিবীতে এসব গল্প পুরনো হয়ে গেছে। হাত উঁচু করে দেখিয়ে বলল, আরও আরও গ্রহ আছে যেখানে মানুষ বাস করতে পারে, তুমি যেমন এখানে এসেছ তেমনি একদিন মানুষ সেসব গ্রহে যাবে বাস করতে। সেদিন মানুষ প্রশ্ন করবে, তুমি কোন গ্রহ থেকে এসেছ? 

এর পরের দুটো সন্ধ্যা শুধু আমরা গল্প করেছি। তিন দিনের দিন সমস্ত খিদে আর আগ্রহ আমাদের দুজনের শরীরে তছনছ হতে শুরু করল। কে যে কত অভুক্ত ছিলাম বলা মুশকিল। তবে ও জানতে চাইছিল আমি কী বলছিলাম বাংলায়। আসলে নীলাকেই চিৎকার করে বলছিলাম, আমাকে শক্ত করে ধরো। আরও কামড় বসাও। ইত্যাদি সুখের উল্লাস বিনিময়ের সময় ভুলে গিয়েছিলাম আমি একটা হাফ জার্মান হাফ সুইডিশ নারীর শরীরে অবগত হয়েছি। এর পরের বার অবশ্য ভুল করিনি। ইংরেজিতে ইচ্ছেমতো জানিয়েছি শরীরের ধ্বনি প্রতিধ্বনির সারগম। মেয়েটিও ভয়ানক চেঁচাতে পারে। 

শুধু তাই না, আমার পিঠের পুরোনো ব্যথাদের জাগিয়ে দিয়েছিল। কী বাদামি তোমার ত্বক! বলেই জিভ বোলাতে শুরু করে যখন আমি আবার হামলে পড়ি। আমাদের দুজনের শরীরের ভাষাই বলে দিচ্ছিল পরস্পর কতটা পিপাসা নিয়ে ছিলাম। অথচ মেয়েটি যাবার আগে এমনভাবে গেল যেন আমরা শুধুই সহপাঠী। আমি হাত ধরে বসে কফি খেয়ে চুমু দিতে যাব যখন অদ্ভুত সটান হয়ে বলে উঠল, কখনো বার্লিন এলে মেইল কোরো দিন দশেক আগে। ভালো থেকো। ব্যস আর যোগাযোগ হয়নি কোনোদিন। আমি আবার বনে ঘুরি। কাগজের পাখি বানাই। গ্রিনহাউস চাষাবাদ নিয়ে পড়াশোনা করি। বাংলায় কথা বলার জন্য কাউকে খুঁজি। কিচ্ছু না শুধু কথা বলতে বলব এই আক্ষেপ নিয়ে ঘুমাই আর পরদিন নির্জনতার ভেতরে আমি আরও থকথকে হয়ে যাই।

অনেক দিন পর আমি আজ জেনেছি মালমো এসেছে আমার এক সময়কার সহকর্মী বন্ধু বাবলি। আমাকে মেইল করেছে দেখা করতে আসবে আগামীকাল। আমি সুখের আলোয় ভেসে যাচ্ছিলাম শুধু। বাবলি শুধু মেয়ে না রীতিমতো গবেষণা করার মতো একজন মানুষ। ওর সাথে আড্ডা দেয়ার অভিজ্ঞতা যার নেই সে অতি দুর্ভাগা। আমি আজ বনে এসে নিজেকে শান্ত করার মিথ্যা কসরত দেখিয়েই যাচ্ছি। আসলে পারছি না। বাবলি আন্তর্জাতিক মানের একজন সফল মানুষ। নিজেকে কোথা থেকে কোথায় নেয়া যায় সেটা ও করে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের মতো আধা বিপ্লবী আধা সুযোগ সন্ধানীদের। জেলে থাকার সময় বাবলি আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলো সেই চিঠি অনুযায়ী আমি চেষ্টা করেছি ভাবতে যে আমরা প্রকৃতির বিশাল অংশের কত তুচ্ছভাগ। কত সহজে সময় ফুরিয়ে যায়। তাই প্রতিটি মুহূর্তের জন্য যেন আমরা 

প্রকৃতির কোথাও থেকে যেন নিজেকে আলাদা অনুভব না করি। সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে মানা আমার মতো মানুষের কর্ম নয়। আমি আত্মহত্যার কাছাকাছি বসবাস করি হয়তো। অথবা ভীষণ মিথ্যুক একটা লোভী কেউ। যে ঝুলে পড়ে বা ছাদ থেকে লাফ দেয় তার মতো সাহস নেই আমার। তাই বাবলির জন্য অপেক্ষা করছি। সাহস নেই নীলাকে দেখিয়ে একটা প্রেম করার। বা খুব হেস্তন্যস্ত কিছু করে পতাকা নিয়ে ছবি তুলে দেশকে জানানোর দেখো আমি কে? দেখ আমার কত যোগ্যতা। আমি এই বিশাল দ্বীপেই ঠিক আছি। আমার একটা সংসার ভাঙা ভৌতিক যন্ত্রণা আছে সেটাই ঠিক আছে। দেশ ছেড়ে আসা বিপাক আছে সেটাই ঠিক আছে। এসব কথা কাউকে জানানো যায় না। মানুষের জন্য বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে হয়। বানানো জীবন শুধু পাওয়া যায় না।

সারা বিকেল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু সময় যায় না মোটে। অনেক দিন পর ফুলার রোডের জারুল গাছগুলোর কথা মনে পড়ল। কৃষ্ণচূড়ার কথা মনে পড়ল। টিএসসিতে শুদ্ধ ভাষা শুদ্ধ বানানের জন্য আমি আর বাবলি কোর্স করাব বলে পোস্টার লাগাচ্ছিলাম একদিন দেয়ালে। রিকশা করে যাচ্ছিলেন এক অধ্যাপক। আমাদের ডেকে বললেন, কোনো ভাষাই অশুদ্ধ না। সবই সুন্দর। সব উচ্চারণেরই মাধুর্য আছে। তুমি কি রিকশা ডাকো যখন তখন শুদ্ধ ভাষায় ডাকো? নাকি ওর বুঝতে সুবিধা হবে সেই ভাষায় ডাকো? বাবলি চটপট করে বলতে চাইল, তবুও মাধুর্য রক্ষার জন্য রঙ না শুধু ঘ্রাণ লাগে, মধু লাগে। তবেই বাগান মনোযোগ কাড়তে পারে। আপনি টিভিতে খবর পড়েন আমি দেখেছি। আসুন না আমাদের একটা ক্লাস নেবেন একদিন। এরপর বাবলি সেই লোকটির বউ হয়। কী মেয়ে রে বাবা। শুধু কথার প্রেমে কেউ পড়ে বাবলিকে না দেখলে জানতাম না।

আমার অনেক কিছু জানা হয় না আজকাল। খবর দেখি না ফেসবুক না কিচ্ছু না। নীলাকে ভুল করে দেখে ফেলি যদি এই ভয়ে আমি কোথাও উঁকি দেই না; কিন্তু বাবলি নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেছে তবু আসছে না দেখে মালমো থেকে ছেড়ে আসা সব ট্রেনের খবর নিলাম। না সব ঠিক সময়মতো এসেছে স্টকহোম। আমার অনেক দিন পর পেট খারাপের অনুভব হলো। এবং বারবার টয়লেট যেতে লাগলাম। কেননা বাবলি আমার মতো মিথ্যাবাদী না। ওর কথা দেওয়ার দাম আছে। আসছে না যখন নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হয়েছে। আমি সন্ধ্যার পর নড়েচড়ে বসলাম; কিন্তু সব কিছু তো আমি চাইলেই সম্ভব না। বীভৎস একটা রাত কাটালাম। অপেক্ষার চাইতে এখন এই না আসার জবাব চাই আমার। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চাকু দিয়ে আমার কলিজাটা কেউ যেন খাচ্ছে, চিবাচ্ছে আর নুন মাখিয়ে রেখে দিচ্ছে। এই বিষম যন্ত্রণা হলো আমার। আমি অপেক্ষা করে আছি দীর্ঘকাল ধরে আড্ডা দেব শুধু, হা হা হাসিতে এই বন বনানী কাঁপিয়ে তুলব দুই বন্ধু মিলে। আমাদের অনেক গল্প আছে বলার। অথচ নিখুঁত সেলাই করে আমার সেই আশাকে বন্ধ করে দিয়েছে অদৃশ্য কোনো কিছু যেন। কোথাও কোনো উত্তর নেই। তবু নীরবে বনের ভেতর হেঁটে এলাম। গাছগুলোকে জড়িয়ে ধরে বলেছি বাবলি যেন আজ আসে। 

আমি এত কিছু সহ্য করতে পারছি না। ভীষণ দুর্বল আর অসহায় বোধ করছি। জারুল রঙের মতো দুলছি রোদের নির্মম তাপে। এই সুইডিশ রোদ নয় বাংলাদেশের রোদের তাপে। হ্যাঁ প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব আসে তবে জীবন যেভাবে দেবে সেভাবে। আমি উত্তর পেলাম সাত দিন পর। বাবলি আসবে না আর। আসতে পারবে না। ও বলতে পারত অনন্ত আসার আগে। আমি অপেক্ষা করব না হয়তো আর কিন্তু তীব্র কষ্ট আর বোবা ব্যথায় অচেতন হয়ে থাকবে আমার মন। আমি আর বাবলি কেন কারও জন্যই অপেক্ষা করব না। সাহস দ্যাখো মেয়েটার! ভ্রমণে এসে মনে হয়েছে অমনি বাল্টিক জলের অতলে ঝাঁপ দিলি! আত্মহত্যা কার করার কথা আর কে করে! না বাবলি মনে করেছে ওর আর টিকে থাকার দম নেই চলে গেছে। অহেতুক লেগেছে হয়তো। জীবনে অনেক কিছু নিয়ে লম্বা লম্বা কথা বলা সহজ কিন্তু আমি জানি কত অল্পতে ফুরিয়ে যায় সময়। আমাদের আড্ডা হবে এখন বিনা শব্দে বিনা বাক্যে। এই অগাধ নির্জনে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh