সবাই কেবল সফলতার ভাগীদার হতে চায়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৪, ০৭:২৪ পিএম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি

কোটাবিরোধী আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করার পর আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় বিরাট পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। যখন ছাত্রলীগকে সক্রিয় করা হয়, সংঘর্ষের ইন্ধন দিয়ে কোটাবিরোধীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়নের চেষ্টা হয়, পরমুহূর্তে আওয়ামী লীগের নেতারা বুঝতে পারেন, ছাত্রলীগকে মাঠে নামানো বুমেরাং হয়েছে, কারণ ছাত্রলীগের ইমেজ এখন একেবারেই নেই। এই বোধ-বুদ্ধি জাগায় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগকে নিবৃত্ত করার পর মাঠ চলে যায় কোটাবিরোধীদের দখলে, ছাত্রলীগের হলরুম তছনছ করা হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার পর পুলিশও সংযত হতে বাধ্য হয়, ১৪৭ জনের মৃত্যুর পর গুলি বন্ধ হয়।

যখন কোটাবিরোধীদের অবস্থান সর্বত্র দৃশ্যমান, তখন আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার জন্ম নেয়, তারা বলতে থাকেন, ‘চীন বিষয়ক আলোচনায় নেত্রীর কোটা নিয়ে কথা বলা ঠিক হয়নি’।  ছাত্রদের বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের গুলি যখন ব্যর্থ হচ্ছিল তখন আওয়ামী লীগ ও সরকারের নানা দোষত্রুটি নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন পরস্পর আক্ষেপ করছিল। চীন সফরের ওপর আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে চীনের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা চুক্তি নিয়ে সাংবাদিকদের বুদ্ধিদীপ্ত কোনো প্রশ্ন ছিল না, ছিল কোটা নিয়ে প্রশ্ন। এ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সমস্যা ছিল না, বরং প্রধানমন্ত্রীকে উত্তেজিত করাই ছিল সাংবাদিকদের লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রীর প্রায় সব সাংবাদিক সম্মেলনে থাকে তোষামোদ আর স্তুতির বাক্য, যা দর্শক-শ্রোতাদের জন্য পীড়াদায়ক। প্রতিবারই সাংবাদিকদের এই তোষামোদী আচরণের কড়া সমালোচনা হয়, কিন্তু কোনো পরিবর্তন নেই; এ ধরনের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর ইমেজও নষ্ট হয়। বহু বছর আগে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অর্থহীন ও বোকাটে প্রশ্ন পরিহার করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।  

ছাত্র হত্যার পর ধ্বংসযজ্ঞ যখন বিনা প্রতিরোধে চলছিল, পুলিশ গুলি করার হুকুম পাচ্ছিল না, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রিপোর্টাররা আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করেছিল, তখন আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। কোটাবিরোধীদের দাবি মেনে না নেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ রাস্তাঘাটে সাধারণ জনগণও সরকারকে অভিযুক্ত করছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট ছাত্র ইউনিয়নের সায়মা জাহান পাপড়ী বারবার ফোন করে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাপড়ী সত্তর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে দুই দুইবার ভিপি ছিল। কোটা আন্দোলনের ছাত্রীরা কয়েক দিন আগে ছাত্রলীগের সভানেত্রী এবং সাধারণ সম্পাদিকাকে রোকেয়া হল থেকে বের করে দেয়, কয়েকজনকে পিলারের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো-এমন প্রশ্নের উত্তরে পাপড়ী বলল, ভদ্র, বিনয়ী, নিরহঙ্কারী না হলে শুধু ক্ষমতা দিয়ে দুর্দিনে টিকে থাকা যায় না।  

আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতা হারাত তাহলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ লক্ষ দোষত্রুটি উল্লেখ করে শত শত প্রতিবেদনে খবরের কাগজ ভরে উঠত; কিন্তু ক্ষমতা থাকাকালীন কেউ একটি কথাও বলছেন না, কারণ এখন বললে আওয়ামী লীগের নেতারা নাখোশ হবেন। আওয়ামী লীগ নেতারা নাকি সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। অবশ্য আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ঠিকমতো খবরের কাগজটাও পড়েন কিনা সন্দেহ। রাজনীতির মাঠে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে করতে তারা নেতা হয়েছেন, তাই তাদের ধারণা তারা সব জানেন। তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা অহঙ্কারী’। 

কোটাবিরোধীরা আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে হওয়ার কথা ছিল না; কারণ সরকার ২০১৮ সনেই কোটা বাতিল করেছে। হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখার পক্ষে রায় দিয়ে সরকারের কোটা বাতিলের আদেশকে অবৈধ বলেছে। সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। অর্থাৎ সরকারও কোটা চায় না, ছাত্র সমাজও চায় না। দুঃখজনক হচ্ছে, কোটাবিরোধী বা ছাত্রদের পক্ষে সরকারের অবস্থান থাকা সত্ত্বে আন্দোলন হলো সরকারের বিরুদ্ধে, কারণ সরকার তার অবস্থান সহজ সরল ভাষায় স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে।  

কোটা নিয়ে ছাত্র এবং সরকারের অভিন্ন মত ছিল। সরকারের অবস্থান কোটাবিরোধী ছাত্রদের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও ছাত্ররা কেন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামল তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। কোটার বিষয়টি আদালতের এক্তিয়ারে থাকায় সরকারের যে কিছুই করার ছিল না তা পরবর্তীকালে কোটাবিরোধীরা বুঝতে পেরেছিল এবং পেরেছিল বলেই তারা বিষয়টি সংসদে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সংসদেরও কিছু করার ছিল না। সংবিধান সরকারকে বলেই দিয়েছে কোটা নিয়ে বিধি প্রণয়ন করতে, কোন শ্রেণি বা কোন জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা দরকার এবং কার জন্য কতটুকু দরকার তা নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের নির্বাহী বিভাগের ওপর ন্যস্ত। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটাবিরোধী ছাত্ররা জেনেশুনে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল, কিন্তু দেশের সাধারণ জনগণ ও স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে কোটার বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি, আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার রাখে না সেই কথাটি তাদের জানা ছিল না। সরকারও স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাতে সফল হয়নি। একবার একটি বিষয় আদালতে গড়ালে তার চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়, এমনকি সরকারকেও। এই আইনগত বিষয়টি সহজ করে বারবার বলা হয়নি, যা বলা হয়েছে তা বিদগ্ধ জনের তাত্ত্বিক আলোচনা, সাধারণ জনগণের কানে তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছায়নি। জনগণ বুঝতে পারেনি বলেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও মনে করেছে সরকার ইচ্ছে করেই কোটা বিরোধীদের যৌক্তিক দাবি মানতে দেরি করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় দ্বারাই বিষয়টির সুরাহা হলো।  

আমাদের মনে থাকা দরকার, দেশে প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা বহির্ভূত পরিবারের সংখ্যা বেশি; এমনকি বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলার লোকও বেশি। কারণ আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কাউকে মুক্তিযুদ্ধের ভাগীদার হতে দেওয়া হচ্ছে না। ভাগীদার হতে না পারার আক্ষেপ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনা’ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অহর্নিশ ব্যঙ্গ করা হয়। যে পরিবারের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে না, অদূর ভবিষ্যতে পড়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই তারাও মুক্তিযোদ্ধা-কোটাবিরোধী। কারণ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা হয়েছে; এমন প্রচারও হয়েছে যে, স্বাধীনতার পর যাদের জন্ম তাদের নামও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছে। এমন প্রচারের উত্তর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়নি। এই মন্ত্রণালয়ের জন্য গতিশীল নেতৃত্ব প্রয়োজন, অভিজ্ঞতার চেয়ে জ্ঞানের প্রয়োজন বেশি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের নির্জীব ও নির্লিপ্ত মনোভাবে জনগণের মধ্যে বিশ্বাস জন্মিয়েছে যে, এই মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার হরিলুট হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাও এখন আর মুক্তিযোদ্ধা-কোটা চায় না।  

আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে আদালতের বাইরে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যে নিরুপায় তা যথাযথভাবে প্রচার পেলে রিকশাচালক, ঠেলাচালক বা আমার শিক্ষিত ভাতিজা শিমুল, আমার ছেলে অর্ণব এবং নাতি স্বপ্নীল কোটা বাতিলের জন্য সরকারকে দায়ী করত না। বিষয়টি বউকে বোঝাতে আমার গলদঘর্ম হতে হয়েছে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় শেষ মুহূর্তে সরকার বলেছে, কোটাবিরোধীদের দাবি তারা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে। সরকারের এই মানাটি বোকাটে ও অর্থহীন; কারণ আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই সরকার কোটাবিরোধী ছিল, কোটাবিরোধী ছিল বলেই সরকার ২০১৮ সনে কোটা প্রথা বাতিল করেছে এবং হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে; এই অবস্থায় পুনরায় নীতিগতভাবে মেনে নেওয়ার কিছু থাকে না। ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকারের বলা উচিত ছিল, ‘সরকারও তোমাদের মতো কোটাবিরোধী, এসো, আমরা উভয়ে মিলে আইনি লড়াই করি, আইনি লড়াইয়ে আমরা অবশ্যই জিতব’। অবশ্য আমার এই বক্তব্যটি সুবিধাবাদী, কারণ দেশের অবস্থা এত বিপর্যয়কর না হলে আমার মাথায়ও এই ধারণার জন্ম হতো না, সুপ্রিম কোর্টও শুনানির তারিখ হয়তো পরিবর্তন করত না।  

আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকার প্রচার-প্রচারণা এবং যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যা প্রদানে দুর্বল। অধিকাংশ নেতা খোঁচা মেরে কথা বলতে অভ্যস্ত। খোঁচা মেরে কথা বলাকে মানুষ পছন্দ করে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোঁচা দিয়ে বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে প্ররোচিত করে থাকেন। তিনি প্রায় উল্লেখ করেন যে, কোমরভাঙ্গা বিএনপির পক্ষে একটি আন্দোলনও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এই কথা দ্বারা আওয়ামী লীগ কী বেনিফিট পাচ্ছে তা জনগণ বোঝে না। তিনি যদি বলতেন, বিএনপির ডাকে জনগণ সাড়া দিচ্ছে না, তাহলে তা একটি তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারত। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সবাই ক্ষমতার আমেজে বুঁদ হয়ে আছে। সফলতা হাতছাড়া হয়ে গেলে সকলে শীর্ষ নেতাদের ঘাড়ে সব দোষত্রুটি চাপিয়ে দেবে; কারণ ব্যর্থতার দায়ভার কেউ নেয় না, সবাই সফলতার ভাগীদার হতে চায়।  

জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh