আমীন আল রশীদ
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৪, ০৯:১৫ পিএম
আমীন আল রশীদ। ফাইল ছবি
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠার আগমুহূর্তে দেশের গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার আলোচিত চরিত্র ছিলেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী। যার বিপুল বিত্ত-বৈভবের খবর গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হওয়ার পর এ নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন: প্রশ্নফাঁসে যা কামাইছি সব আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছি। (চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, ৮ জুলাই ২০২৪)। ধর্ম ও ধর্মীয় লেবাস যে আবেদ আলীর মতো দুর্নীতিবাজদের একটি বড় হাতিয়ার-সেটি এই ঘটনায় আরও একবার প্রমাণ হলো।
আবেদ আলীর ঘটনাটি নিয়ে যখন সারা দেশে তোলপাড়, তখন ছড়াকার পলাশ মাহবুব নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘আগে প্রবাদ ছিল চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। কিন্তু এখন চোরে শোনায় ধর্মের কাহিনি!’
আবেদ আলীর ফেসবুক ওয়ালে ঘুরলে দেখা যায় তিনি তার অপরাধ ঢাকার জন্য; শুধু ধর্ম নয়, রাজনীতিকেও হাতিয়ার করেছেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যেমন পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকতার সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। প্রশ্ন হলো, ওই কর্মকর্তারা কি আবেদ আলীর পরিচয় জানতেন না?
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
১. আবেদ আলী তার ফেসবুকে একটা ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘আমার জীবনে কোনোদিন অসদুপায় অবলম্বন করিনি। গায়ে খেটে ভাগ্য পরিবর্তন করেছি।’ অথচ গণমাধ্যমের অনুসন্ধান বলছে, জীবিকার তাগিদে সদরঘাটে কুলির কাজ করেন। রাতে থাকার মতো বাসস্থান না থাকায় ঘুমিয়েছেন ফুটপাতেও। কিন্তু গাড়ি চালানো শিখে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) গাড়িচালকের কাজ নেওয়ার পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। অর্জন করেন বিপুল সম্পদ, সঙ্গে ক্ষমতা। উপজেলা চেয়ারম্যান হতে চেয়ে তিনি যে পোস্টার লাগিয়েছেন, সেখানে তিনি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের কথা বলেছেন। অর্থাৎ চোর শুধু ধর্মের কাহিনি শোনাচ্ছে না, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছে!
২. মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার বাসনা ছিল আবেদ আলীর। ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ডাসার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হওয়ার পর থেকেই আমার প্রতিপক্ষ বন্ধুরা আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, আমার অভিভাবক কে? এর উত্তর হলো, আমার অভিভাবক স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এবং এই উপজেলার সাধারণ জনগণ। আমি আমার ভাগ্যকে আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। ডাসারের আপামর জনতা নির্ধারণ করে দেবে আমি সৈয়দ আবেদ আলী তাদের সেবক হওয়ার যোগ্য কি না। আল্লাহ ভরসা।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভোট পেতে হলে ধর্ম যে প্রধান কার্ড, সেটিও আবেদ আলী জানেন এবং মানুষের সেই অনুভ‚তিই কাজে লাগিয়েছেন।
৩. আরেক দিনের ফেসবুক পোস্ট, ‘পবিত্র মক্কা মদিনা যাওয়ার সুযোগ বহুবার হয়েছে, যতদিন বেঁচে থাকব বারবার যেতে চাই।’
৪. ফেসবুকে আবেদ আলীর ধর্মকর্মের নানাবিধ ছবি আছে। বিশেষ করে মসজিদ বানানো এবং মসজিদে গিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার ছবিও আছে। একটি ছবিতে দেখা যায় তিনি গাড়ির সিটে বসেই নামাজ পড়ছেন। আরেকটি ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘আপনারা জানেন যে এলাকাবাসীর দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমি আমার নিজ খরচে মসজিদ নির্মাণ করি। আমার মসজিদের ইমাম সাহেবকে কিছুদিন আগে ওমরাহ করিয়ে নিয়ে এসেছি। আজকে ইফতার শেষে আল্লাহ তায়ালার কাছে এই ফরিয়াদ করি, প্রতিবছর যেন আমার ডাসার উপজেলার অন্ততপক্ষে একজনকে হলেও পবিত্র নগরীতে ওমরাহ করার জন্য পাঠাতে পারি।’
বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে হিরো হওয়ার আরেকটি বড় উপায় হলো মানুষকে ওমরাহ বা হজ করতে পাঠানো। আবেদ আলী সেই কাজটিও করেছেন। কিন্তু কোনোদিন তার এলাকার কোনো মানুষ তাকে এই প্রশ্ন করেনি যে, আপনি যে এত মসজিদ বানাচ্ছেন, মানুষকে হজ ও ওমরায় পাঠাচ্ছেন, এত টাকা কোথায় পেলেন? কেননা মানুষ জানত আবেদ আলী বিরাট শিল্পপতি! আবেদ আলী বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস করে যা কামিয়েছেন তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছেন। তার এই কথাও তাহলে ঠিক।
৫. আবেদ আলী জানেন রাজনীতি করতে এবং দুর্নীতি করে টিকে থাকতে এই আমলে বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙাতে হবে। গত ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে তিনি একটি ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু এবং আমার বড় ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে এই মসজিদে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছি, আলহামদুলিল্লাহ।’ এদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কেক কেটে বঙ্গবন্ধুর ১০৪তম জন্মদিন পালনেরও ছবি দিয়েছেন।
আবেদ আলী একা নন। বিসিএসসহ আরও বহু সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম গণমাধ্যমে এসেছে এবং আসছে। নিচু পদের অনেক লোকের বিপুল বিত্ত-বৈভবের খবর জানা যাচ্ছে। অতি সামান্য বেতনের এসব লোকের শতকোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়ার খবর রীতিমতো বিস্ময়কর। তবে এসব ঘটনায় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মতো এত জটিল ও কঠিন কাজটি তারা কীভাবে করতেন? বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি, ছাপা, সুরক্ষা এবং বিতরণের পুরো প্রক্রিয়াটিই বেশ গোপনীয়। তবু তারা কীভাবে প্রশ্ন জোগাড় করে লাখ লাখ টাকায় বিক্রি করতেন? তার মানে পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। এমনকি উঁচু পদের কারও না কারও এর সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা। সেই নামগুলোও কি জানা যাবে?
আরও যে প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে তা হলো, সারা দেশে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী মসজিদ-মন্দির নির্মাণ এবং গরিব মানুষদের সহায়তার নামে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করেন, তাদের টাকার উৎস নিয়ে মানুষ কি এখন থেকে প্রশ্ন শুরু করবে? মানুষ যদি এসব লোকের দান-খয়রাত এবং তাদের ধর্মীয় লেবাস দেখেই বিমোহিত হয়ে তাদের আসল চেহারাটা চিনতে না পারে, তাহলে সমাজ থেকে দুর্নীতি কোনোভাবেই দূর হবে না। সর্বোপরি, সরকারি চাকরি যে অনেকের কাছেই আলাদিনের চেরাগে পরিণত হলো, সেটি বন্ধের জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন।
আমীন আল রশীদ
সাংবাদিক ও জীবনানন্দ গবেষক